-->

মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্প অবৈধ অস্ত্রের মজুতখানা

খুন-সংঘর্ষ আতঙ্কে ঘুম নেই বাসিন্দাদের

এমদাদুল হক খান
মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্প অবৈধ অস্ত্রের মজুতখানা

রাজধানীর মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্প এখন অবৈধ অস্ত্রের মজুতখানা। সরকার পরিবর্তনের পর কয়েক ধাপে শতাধিক আগ্নেয়াস্ত্র ঢুকেছে আটকে পড়া পাকিস্তানি নাগরিকদের এই ক্যাম্পে। আর এসব অস্ত্রের জানান দিতে প্রতিদিনই ঘটছে অপ্রীতিকর নানা ঘটনা। শুধু তাই নয়, গত তিন মাসে এই ক্যাম্প এলাকায় খুনের ঘটনাও ঘটেছে বেশ কয়েকটি। অধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে আহত হয়েছে পাঁচ শতাধিক মানুষ।

গত তিন মাসে জেনেভা ক্যাম্পের ভেতরে একাধিক গোলাগুলি ও সংঘর্ষের ঘটনার বেশ কয়েকটি ভিডিও ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। এসব ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, চাইনিজ অস্ত্র, শটগান, পাইপগানসহ বিভিন্ন আধুনিক অস্ত্র হাতে ক্যাম্পের চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের। ক্যাম্পের ভেতরে কীভাবে এবং কারা এসব আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে এলো, কতগুলো আগ্নেয়াস্ত্র ঢুকেছে ক্যাম্পের ভেতরে—এ ব্যাপারে জেনেভা ক্যাম্পের একাধিক বাসিন্দা এবং বেশ কয়েকজন গোয়েন্দা কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জেনেভা ক্যাম্পে তিন ধাপে শতাধিক আগ্নেয়াস্ত্র ঢুকেছে। মূলত জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলন ঠেকাতে স্থানীয় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ক্যাম্পের কয়েকজন আওয়ামী লীগ ও যুবলীগ নেতাকর্মীকে অন্তত ১০টি অস্ত্র দেওয়া হয়েছিল। এরপর ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর মোহাম্মদপুর থানা, আদাবর থানা এবং শেরেবাংলা থানায় লুটপাটের সময় বিভিন্ন ধরনের অন্তত আরও ৪০টি আগ্নেয়াস্ত্র হস্তগত করে সন্ত্রাসীরা। এরপর ক্যাম্পের মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিতে চুয়া সেলিম ও তার ক্যাডাররা টাকার বিনিময়ে বাইরে থেকে তৃতীয় ধাপে অন্তত আরও ৩০টির বেশি আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে আসে।

জানা গেছে, বিগত সরকারের আমলে ক্যাম্পে মাদক ব্যবসার বিস্তার ঘটায় আওয়ামী লীগের নেতা মোল্লা বশির ও বুনিয়া সেলিম। এছাড়াও ৭ নম্বর সেক্টরের ক্যাডার জয়নাল আবেদিন জয়, ইকবাল ও আমির ছিলেন ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতা। আর যুবলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিল ক্যাম্পের আরমান, সেলিম, নাছির ও মাহমুদসহ আরও কয়েকজন ক্যাডার। জুলাইয়ে ছাত্র আন্দোলন ঠেকাতে মূলত এদের মাধ্যমে ক্যাম্পে বেশ কয়েকটি আগ্নেয়াস্ত্র দেয় স্থানীয় সাবেক এমপি ও ডিএনসিসি ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক এক কাউন্সিলর।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ৫ আগস্টের পর সরকার যখন অস্ত্র জমা দিতে বলেছিল, তখন ক্যাম্পের আশপাশের ময়লার স্তূপ থেকে তিনটি অস্ত্র সেনাবাহিনীর সদস্যরা নিয়ে গিয়েছিল। এরপর গত তিন মাসে পুলিশ, র‌্যাব ও সেনাবাহিনীর যৌথ অভিযানে ১০টি আগ্নেয়াস্ত্র ও শতাধিক দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। বুনিয়া সোহেলসহ দুপক্ষের প্রায় ৫০ জন মাদক কারবারি ও ক্যাডারকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

ক্যাম্পের বাসিন্দারা জানান, জেনেভা ক্যাম্পে বুনিয়া সেলিম ও চুয়া সেলিমের দুই পক্ষের একাধিক সংঘর্ষে অনেকের হাতে পিস্তল, রিভলভার, শটগান, পাইপগানসহ বিভিন্ন ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র দেখা গেছে। এর মধ্যে চুয়া সেলিম গ্রুপের চুয়া সেলিমের হাতে একাধিকবার পিস্তল ও রিভলভার দেখা গেছে। এছাড়াও তার গ্রুপের কিলার আকরাম, পারমনু, শাহ আলম, গালকাটা মনু, পিচ্চি রাজা, উলটা সালাম, বোবা বিরিয়ানির আলতাফ, ফরমা কামরান, বিল্লা ইমরান, এরশাদ, আলতাফের ছেলে ইরফান, পিচ্চি শাকিব ও মোল্লা বশিরসহ অনেককে অস্ত্র নিয়ে সংঘর্ষে জড়াতে দেখা গেছে কয়েকটি ভিডিও ফুটেজে। বুনিয়া সোহেল গ্রুপের বুনিয়া সোহেল, তার ভাই রানা, টুনটুন, রাজন ও কালোর হাতে বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র দেখা গেছে। এছাড়াও একাধিক সংঘর্ষে অস্ত্র হাতে দেখা গেছে সৈয়দপুরিয়া বাবু, লাড্ডু কসাই ও তার ছেলে পারভেজ, পিচ্চি শাকিল, নিয়াজ, কালো আনোয়ার, কলিম জাম্বু, মো. দ্বীন, নওশাদ, ডানো, আমির, জয়নাল আবেদিন জয়, আরমান, চাকু ওরফে নূর ইসলাম, গাপ্পি দালাল, নিয়াজ, ইকবাল, মোটকি শিমার ছেলে ফরিদ, আরিফ, সৈয়দপুরিয়ার ডানো, বোম, নওশাদ, রকি, হীরা, জামাই আমিন, কানা আনোয়ার, ভাগিনা মুক্তার, এসকে জিলানির ছেলে নাসিম, কামাল বিরিয়ানির ইরফান, দিল্লি সাহিদ, গোলি জাহিদ, জিন্দা মোহাম্মদ আলি, মুরগি সুমনকে।

জেনেভা ক্যাম্পের বাসিন্দারা জানান, জেনেভা ক্যাম্পের ৫৩ বছরের ইতিহাসে আগ্নেয়াস্ত্রের এরকম প্রকাশ্যে অস্ত্রের ব্যবহার আগে দেখা যায়নি। বিগত সময়ে ক্যাম্পের ভেতরে মারামারিতে লাঠিসোটা ও ইটপাটকেলের ব্যবহার ছিল। সংঘাতের সময় দুর্বৃত্তদের হাতে কখনও কখনও দেশীয় অস্ত্র ছুরি-চাপাতি দেখা গেছে। গত ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর রাত থেকেই ক্যাম্পের ভেতরে তুমুল সংঘর্ষ শুরু হয়। ক্যাম্পজুড়ে গোলাগুলি ও ককটেল বিস্ফোরণের শব্দ। সবার মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। হঠাৎ কেন এমন সংঘর্ষ, গুলি করছে কারা—ক্যাম্পে বিএনপি সমর্থিত চুয়া সেলিমের গ্রুপ, যারা বিগত ১৫-১৬ বছর আন্ডারগ্রাউন্ডে ছিল, এখন তারা প্রকাশ্যে এসেছে। চুয়া সেলিম পুরো ক্যাম্প নিয়ন্ত্রণে নিতে চাইলে আওয়ামী লীগ সমর্থিত বুনিয়া সোহেল ও তার গ্রুপের সদস্যরা প্রতিরোধ শুরু করে। কেননা এরই মধ্যে তাদের কাছে বেশ কিছু অস্ত্র ছিল। ক্ষমতা তারাও ধরে রাখতে চায়। এ অবস্থায় ৫ আগস্ট রাত থেকে শুরু হয় ক্যাম্পে দুই গ্রুপের সংঘর্ষ। পরদিন ৬ আগস্ট গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান হোটেল কর্মচারী শাহেন শাহ ওরফে কালো। এরপর একে একে দুজন শিশুসহ সাতজনের প্রাণ গেল। এখনও সংঘাত থামার কোনো শঙ্কা নেই। অস্ত্রের আতঙ্কে সবাই।

বিহারি জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন এসপিজিআরসির আহ্বায়ক সৈকত আলী মাস্টার বলেন, প্রায় তিন মাস ধরে আমরা ঠিকমতো ঘুমাতে পারছি না। সন্ধ্যা হলেই মারামারি, ককটেল বিস্ফোরণসহ গোলাগুলি হচ্ছে। এদিক থেকে এক গ্রুপ গুলি ছোড়ে, আবার ওদিক থেকে আরেক গ্রুপ গুলি ছোড়ে। এরা সবাই মাদক ব্যবসায়ী। প্রতিবাদ করার মতো কেউ নেই। তারা মানুষ মারা থেকে শুরু করে বাড়িঘর ও দোকানপাট ভাঙচুর এমনকি লুটপাটও করছে। গত তিন মাস ধরে ক্যাম্পের কোনো বাসিন্দা ঠিকমতো ঘুমাতে পারছে না।

এসপিজিআরসি সংগঠনের যুগ্ম আহ্বায়ক মো. ইকবাল হোসেন বলেন, গত ২৭ অক্টোবর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে ক্যাম্পের সার্বিক বিষয় জানিয়ে আমরা একটা চিঠি দিয়েছি। প্রধান উপদেষ্টার এপিএস সাব্বির হোসেন চিঠি রিসিভ করেছেন। এরপর থেকে সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ক্যাম্পে নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে। কী ছিল সেই চিঠিতে—এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমাদের ক্যাম্পের ভেতরে কী কী অসুবিধা আছে, আমাদের কী কী চাহিদা আছে, এই ক্যাম্পে আমরা কেন থাকতে পারছি না, এসব বিষয়ে উল্লেখ করা আছে চিঠিতে। এছাড়াও জেনেভা ক্যাম্পে কারা সংঘর্ষ করছে, কেন সংঘর্ষ হচ্ছে, কারা কারা মাদক ব্যবসা করছে, আমাদের পক্ষ থেকে এসব বিষয় প্রধান উপদেষ্টার কাছে জানানো হয়েছে।

অস্ত্র উদ্ধারে জেনেভা ক্যাম্পে সাঁড়াশি অভিযান চালানো হবে জানিয়ে সেনাবাহিনীর মোহাম্মদপুরে অস্থায়ী ক্যাম্পের ক্যাম্প কমান্ডার ও ২৩ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসার মেজর নিয়ামুল বলেন, জেনেভা ক্যাম্পে পুলিশ ও র‌্যাবসহ সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে একাধিক যৌথ অভিযান চালানো হয়েছে। বর্তমানে ক্যাম্পের পরিস্থিতি কিছুটা উন্নত হয়েছে। তবে আমরা ক্যাম্পকে মনিটরিংয়ে রেখেছি, যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমরা প্রস্তুত রয়েছি। এরই মধ্যে জেনেভা ক্যাম্প থেকে কয়েকটি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। ক্যাম্পে আরও যে কয়েকটি অস্ত্র রয়েছে, তার জন্য পুলিশ, র‌্যাবসহ আমাদের গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা কাজ করছেন। তথ্যের ভিত্তিতে অস্ত্র উদ্ধারে খুব শিগগিরই সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করা হবে।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) মো. ইসরাইল হাওলাদার বলেন, জেনেভা ক্যাম্পের ভেতরে মাদক সংশ্লিষ্ট ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দুটি গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। আমরা শুনেছি, বিভিন্নভাবে ক্যাম্পে কিছু অস্ত্র ঢুকেছে। তবে কী পরিমাণে আছে, এটা নিশ্চিত নয়। ক্যাম্পে সংঘর্ষ ঠেকাতে এবং অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে আমাদের গোয়েন্দা কার্যক্রম এবং অভিযান চলমান আছে। ক্যাম্পের দুই পাশে সব সময়ের জন্য পুলিশ সদস্য মোতায়েন রয়েছে। এরই মধ্যে ক্যাম্পের এক শীর্ষ সন্ত্রাসী ও মাদক কারবারি বুনিয়া সোহেলসহ বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে। অপরাধী কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।

ভোরের আকাশ/রন

মন্তব্য

Beta version