-->

আর্থসামাজিক অবস্থার মোড় ঘোরাবে অর্থনৈতিক জোন

জাফর আহমদ
আর্থসামাজিক অবস্থার মোড় ঘোরাবে অর্থনৈতিক জোন

আর্থসামাজিক অবস্থার আমূল পরিবর্তনের লক্ষ্য নিয়ে অর্থনৈতিক জোনের যাত্রা শুরু হয়। যেখানে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আসবে। সৃষ্টি হবে কর্মচাঞ্চল্য। বৃদ্ধি পাবে কর্মসংস্থান। সাম্প্রতিক সময়ে অর্জিত উচ্ছ প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে। এর সুফল পাবে মানুষ। অর্থনৈতিক মুক্তির যে অভিপ্রায় নিয়ে স্বাধীনতা অর্জন হয়েছিল তা পূর্ণ হবে। 

২০১৬ সালে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক জোন কর্তৃপক্ষ-বেজা প্রতিষ্ঠার পর থেকে সাত বছরে ৯৭টি অর্থনৈতিক জোনের অনুমোদন দেওয়া হয়। পাশাপাশি ঠিক করা হয়েছে এর স্থান। এর মধ্যে উৎপাদনে গেছে ৮টি জোন। যেখানে কর্মসংস্থান হয়েছে ৪১ হাজার মানুষের।

এর বাইরে আরো ২৮টি জোনের উন্নয়নকাজ চলমান আছে। অর্থনৈতিক জোনের জন্য ৬১ হাজার একর জমির অধিগ্রহণ করা হয়েছে। ৬৮টি জোন হবে সরকারি। বাকি ২৯টি জোন বেসরকারি। সরকারি-বেসরকারি অংশিদারিত্বের ভিত্তিতে হবে দুইটি। 

ইতোমধ্যে ৫টি অর্থনৈতিক অঞ্চল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর, মহেশখালী, শ্রীহট্ট, জামালপুর অর্থনৈতিক অঞ্চল ও সাবরাং ট্যুরিজম পার্কে ১৬৮টি বিনিয়োগকারীর অনুকূলে সর্বমোট ৭২১৫ একর জমি ইজারা প্রদানে নির্বাচন করা হয়েছে। যার প্রস্তাবিত বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ২৪.৯৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

এ ছাড়া প্রায় ৩.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ হয়েছে বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলসমূহে। এর ফলে সর্বমোট বিনিয়োগ প্রস্তাবের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৮.২৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। প্রস্তাবিত বিনিয়োগ বাস্তবায়নের মাধ্যমে প্রায় ১০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।

বিশেষ অর্থনৈতিক জোন বাংলাদেশের অর্থনীতির গেম চেঞ্চার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্ভনর ড. আতিউর রহমান।

তিনি ভোরের আকাশকে বলেন, কৃষি থেকে হালকা শিল্পে উন্নীত হওয়া বাংলাদেশকে বৃহৎ শিল্পায়নের পথে মোড় পরিবর্তনে চালকের ভূমিকা পালন করবে বিশেষ অর্থনৈতিক জোন। অর্থনৈতিক জোন প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সেখানে যে কর্মসংস্থান হবে তা চলমান প্রবৃদ্ধির ধারাকে আরো গতিশীল করবে।

আতিউর রহমান বলেন, দেশের এক-তৃতীয়াংশ কর্মশক্তি তরুণ। এই সম্পদকে পরিকল্পিতভাবে কাজে লাগানো এখন সবচেয়ে বড় কাজ। অর্থনৈতিক জোন প্রতিষ্ঠার ফলে বিদেশি বিনিয়োগ আসছে। বিদেশি বিনিয়োগ মানে টেকনোলোজি ট্রান্সফার হবে। এর ফলে তরুণ শ্রমশক্তিকে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তর করতে হবে।

তিনি বলেন, সরকার অবকাঠামো ও জ্বালানিসহ বিভিন্ন খাতে বড় বড় প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এর ফলে সরকার ২০৪১ সাল নাগাদ জিডিপির যে ৯ দশমিক ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধির অভীষ্ট ঠিক করেছে তা বাস্তবায়নে সহজ হবে। এ জন্য দ্রুততম সময়ের মধ্যে অর্থনৈতিক জোনের উন্নয়নকাজ শেষ করতে পারে- এ রকম অন্তত একটি অর্তনৈতিক জোন সম্পন্ন করতে হবে। এর ফলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এগিয়ে আসবে। 

দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানো, পরিকল্পিত ও শ্রমঘন শিল্প স্থাপন, পরিবেশ সংরক্ষণ, উচ্চ উৎপাদনশীলতা অর্জন, রপ্তানি বৃদ্ধি ও অধিক মূল্য সংযোজনকারী শিল্প স্থাপন এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক গতিধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসী সিদ্ধান্তে ২০১০ সালে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল আইন জাতীয় সংসদে গৃহীত হয়।

অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের মাধ্যমে দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন সাধন বর্তমান সরকারের অন্যতম লক্ষ্য। সুবিধাজনক স্থান নির্ধারণ, বিনিয়োগবান্ধব নীতিমালা প্রণয়ন, প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা, ওয়ান স্টপ সার্ভিস নিশ্চিতকরণ ও বিনিয়োগ প্রচারণা কৌশল চিহ্নিত করার কার্যক্রমকে বেগবান করা এবং অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনায় বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করেছে।

দেশের ক্রমবর্ধমান কর্মশক্তির কর্মংস্থানের সুদূরপ্রসারি চিন্তাকে সামনে রেখে সৃষ্টি করা হয়েছে অর্থনৈতিক জোন। প্রতি বছর ২০ লাখ শ্রমশক্তি শ্রমবাজারে আসছে। এর বড় অংশ কর্ম পাচ্ছে না, বেকার থাকছে। অথচ এই যুবশক্তির দিক থেকে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দেশগুলোর অন্যতম বাংলাদেশ।

নতুন নতুন যেসব অর্থনৈতিক জোন প্রতিষ্ঠা হবে সেখানে এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন সম্ভব। বর্তমানে বাংলাদেশের ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্টের যে সুবিধা রয়েছে তা ২০৪০ সালের পর শেষ হয়ে যাবে। এখনই পরিকল্পিত কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা না গেলে দেশের সব চেয়ে বড় সম্পদ শ্রমশক্তি হাত ছাড়া হয়ে যাবে।

বিপুল এই জনশক্তিকে কাজে লাগানোর লক্ষ্য নিয়ে পরিকল্পিত অর্থনৈতিক জোন তথা শিল্প নগরী গড়ে তোলা হচ্ছে, যেখানে উৎপাদনের সঙ্গে সম্পর্কিত সব কিছু মিলছে। এখানে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এক কোটি লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং ২০৩০ সালের মধ্যে বার্ষিক অতিরিক্ত ৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানির প্রত্যাশা নিয়ে অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক জোন কর্তৃপক্ষ।

দেশীয় বিনিয়োগকারীরা যেসব বিনিয়োগ প্রস্তাব করেছে সেগুলো হলো- মেট্রো স্পিনিং লিমিটেড, ম্যাকসন স্পিনিং ও টেক্সটাইল, সামুদা ফুড প্রডাক্ট, উত্তরা মটর্স লিমিটেড, বিজিএমইএ, সিম্যান বিস রিসোর্চ লিমিটেড, মাফ সুজ, সাইফ পাওয়ার টেক, ডেলটা ফার্মা লিমিটেড, এশিয়া কমপোজিট ও এশিয়া কমপোজিট শিলস লিমিটেড।

অর্থনৈতিক জোন প্রতিষ্ঠার অব্যাহত কার্যক্রম অর্থনৈতিক উন্নয়নে বড় ধরনের অবদান রাখবে। এ জন্য অর্থনৈতিক জোন প্রতিষ্ঠা করতে যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তা উন্নয়নমুখী হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর।

তিনি ভোরের আকাশকে বলেন, ১০০টি অর্থনৈতিক জোন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে সরকার। কিন্তু দ্রুত উৎপাদনে আসবে, কর্মচাঞ্চল্যে ভরে আসবে- এমনভাবে কোনোটিই করা হচ্ছে না। অন্তত একটি শিল্প অঞ্চল সম্পন্ন করা হোক, যেখানে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আসবে এবং শিল্প-সেবায় পরিপূর্ণ হবে।

অর্থনৈতিক জোনের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর। বলা হচ্ছে, এটি বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পিত শিল্পনগরী। এ শিল্পনগরের মোট আয়তন প্রায় ৩০ হাজার একর। এ শিল্পনগর হতে যাচ্ছে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ শিল্পনগর।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুশাসন অনুযায়ী ২০১৯ সালে এর মাস্টার প্ল্যান চূড়ান্ত করা হয়। মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী এই শিল্পনগরকে কয়েকটি জোনে ভাগ করে বিভিন্ন ধরনের শিল্প স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরি করার কাজ চলছে।

শিল্প ছাড়াও একটি পূর্ণাঙ্গ শহরের সম্ভাব্য সব ধরনের নাগরিক সুযোগ-সুবিধাসহ এ অর্থনৈতিক অঞ্চলের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এ শিল্পনগরে থাকবে হালকা, মাঝারি, বৃহৎ এবং ভারী শিল্প।

শিল্পপ্রতিষ্ঠান ছাড়াও এই শিল্পনগরে থাকবে আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকা, নগর কেন্দ্র, বিজনেস হাব, সার্ভিস জোন, প্রশাসনিক/প্রাতিষ্ঠানিক এলাকা ও পুনর্বাসন এলাকা। পরিকল্পনায় শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য সুবিধা প্রদানের জন্য নির্দিষ্ট এলাকা চিহ্নিত করা হয়েছে। সমুদ্রপথে আমদানি-রপ্তানির জন্য শিল্পনগরে একটি সমুদ্রবন্দর এবং সংশ্লিষ্ট পরিবহণ সুবিধা প্রদান করার জন্য রাখা হয়েছে লজিস্টিক এলাকা।

মন্তব্য

Beta version