-->
শিরোনাম

তেলের দাম বাড়াল কারা

জুনায়েদ হোসাইন
তেলের দাম বাড়াল কারা
সয়াবিন তেল

লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে ভোজ্যতেলের দাম। সরকারিভাবে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগেই আবারও বোতলজাত ভোজ্যতেলের দাম লিটারে ১০ টাকা বাড়ানো হয়েছে। নতুন মূল্যের মোড়ক বোতলজাত সয়াবিন তেলে লাগিয়ে তা বাজারে সরবরাহ করা হয়েছে। তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, গত ৬ জানুয়ারি নেওয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আগামী ৬ ফেব্রুয়ারির আগে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানোর সুযোগ নেই। মন্ত্রণালয় বলছে, কেউ দাম বাড়ালে সংশ্লিষ্টের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বাজার ঘুরে ও ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতি লিটার সয়াবিন তেল গত সপ্তাহেও বিক্রি হচ্ছিল ১৪৫ থেকে ১৫০ টাকায়, এখন তা ১৫৫ থেকে ১৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর ৫ লিটারের সয়াবিন তেলের বোতল বিক্রি হচ্ছে ৮০০ টাকায়। আগে এর দাম ছিল ৭৫০ টাকা।

রমজানের আগে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে দেশের বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানো বা কমানোর সিদ্ধান্ত হবে বলে জানিয়েছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার অজুহাতে ব্যবসায়ীদের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রী জানিয়েছেন, আগামী ৬ ফেব্রুয়ারির আগে বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানোর কোনো সিদ্ধান্ত নেই।

তবে সরকারের সিদ্ধান্তের আগেই ইতোমধ্যে দাম বাড়িয়ে ১ লিটার ও ৫ লিটারের নতুন মূল্যের বোতলজাত সয়াবিন তেল বাজারে সরবরাহ হওয়ায় প্রশ্ন উঠেছে সরকারকে একেবারেই অন্ধকারে রেখে কীভাবে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ালেন তেলমিল মালিকরা।

বুধবার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার খুচরা বাজারে গিয়ে নতুন দামে সয়াবিন তেল বিক্রি হতে দেখা গেছে। তবে বিষয়টি সামনে আসায় পরিবেশকরা ইনিয়ে-বিনিয়ে বলছেন, বাজারে নতুন দামের তেল সরবরাহ হলেও তা আবার তুলে নেওয়া হচ্ছে। আর এ নিয়ে খুচরা ব্যবসায়ীদের মধ্যে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। সাধারণ গ্রাহক বা ভোক্তারা বলছেন, বাজার পর্যবেক্ষণে সরকারের গাফলতির কারণে আমদানিকারক ও সরবরাহকারীরা ইচ্ছেমতো পণ্যের মূল্য ঠিক করছেন। যার মাসুল দিতে হচ্ছে সাধারণ গ্রাহককে।

জানা গেছে, দেশে ভোজ্যতেলের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ২০ লাখ মেট্রিক টন। যার প্রায় সম্পূর্ণটাই আন্তর্জাতিক বাজার থেকে আমদানির মাধ্যমে পূরণ করা হয়।

এদিকে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য বিপণন পরিবেশক নিয়োগ আদেশ, ২০১১ অনুযায়ী বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একটি জাতীয় কমিটি রয়েছে। কমিটি গত ৬ জানুয়ারি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা অংশগ্রহণ করেন এবং প্রতি লিটার ভোজ্যতেলের মূল্য ৮ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব দিলেও তা সভায় গৃহীত হয়নি বলে মন্ত্রণালয়ে সূত্রে জানা গেছে।

অন্যদিকে, আগামী ২ ফেব্রুয়ারি থেকে এই দাবি বাস্তবায়নের সিদ্ধান্তে অটল সমিতির নেতারা। এ হিসাবে বাজারে নতুন দামের বোতলজাত তেল সরবরাহ হচ্ছে বলে জানা গেছে। তবে সরকারি সিদ্ধান্ত না থাকায় অনেকে এসব পণ্য সরিয়ে নিচ্ছেন বলেও একটি সূত্র দাবি করছে। আবার গ্রাহক পর্যায়ে বাড়তি দামে তেল কেনারও অভিযোগ রয়েছে।

এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান ভোরের আকাশকে বলেন, গত ১৯ জানুয়ারি বাণিজ্যমন্ত্রী যে বক্তব্য দিয়েছেন তাই সঠিক। আমাদের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত ভোজ্যতেলের মূল্য বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেই। এর আগে গত ৬ জানুয়ারি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকে হয়। ব্যবসায়ীরা আমাদের জানিয়েছিলেন, ২ ফেব্রুয়ারির মধ্যে প্রতি লিটারে ৮ টাকা বাড়াবেন। কিন্তু তখন কোনো সিদ্ধান্তে আসেনি সংশ্লিষ্ট কমিটি। এর মধ্যে হয়তো কোনো কোনো কোম্পানি তাদের মূল্য সংক্রান্ত তথ্যসহ হলোগ্রাম ছাপিয়ে ফেলেছে। সেগুলো হয়তো বাজারে আসতে পারে। এই নিয়ে আমাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। যদি কেউ সরকারি সিদ্ধান্ত অমান্য করেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

তিনি বলেন, আগামী ৬ ফেব্রুয়ারি সংশ্লিষ্ট কমিটির বৈঠক হবে, তখন সিদ্ধান্ত হবে ভোজ্যতেলের দাম কী হবে। এর আগে কেউ বাজারে প্রভাব তৈরি করতে পারে না। প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

গতকাল বুধবার রাজধানীর কয়েকটি বাজার ঘুরে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপে জানা গেছে, পুরাতন দামেই বেশিরভাগ দোকানে বোতলজাত সয়াবিন তেল বিক্রি করছেন তারা। তবে ইতোমধ্যে নতুন দামের বোতল বাজারে আসতে শুরু করেছে। এর মধ্যে যাদের মজুত রয়েছে তারা আগের দামে এবং যাদের মজুত শেষ তারা নতুন দামে বিক্রি করছেন বলে জানিয়েছেন।

বাজার পরিস্থিতি বিষয়ে সরকারের কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মূল্য তালিকায় সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে এমন তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। সংস্থাটির তথ্য বলছে, সয়াবিন তেলের মূল্য সারাদেশে ৫ দশমিক ৩৫ শতাংশ বেড়ে ১৪৫ থেকে ১৪৭ টাকায় প্রতি লিটার বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে সরকারি বিপণন সংস্থা টিসিবির প্রতিদিনের হালনাগাদ তথ্য জানাচ্ছে, বাজারে বুধবার প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল ১৪৫ থেকে ১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বোতলজাত প্রতি লিটার ১৫৫ থেকে ১৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর প্রতি ৫ লিটার ৭২০ থেকে ৭৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

টিসিবির হিসেবে প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম গত সপ্তাহের তুলনায় দাম বেড়েছে ৫ টাকা, গত মাসে ছিল ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা, আর গত বছর এই সময়ে ছিল ১২০ থেকে ১৩০ টাকা। এই হিসেবে এক সপ্তাহে দাম বেড়েছে ৩ দশমিক ২৩ শতাংশ এবং এক বছরে বেড়েছে ২৮ শতাংশ পর্যন্ত।

অন্যদিকে, ৫ লিটারের সয়াবিন তেলের দাম গত সপ্তাহের তুলনায় বেড়েছে ১০ টাকা করে। যা গত সপ্তাহে ছিল ৭১০ থেকে ৭৫০ টাকা। গত মাসে ছিল ৭০০ থেকে ৭৬০ টাকা। ফলে মাসের ব্যবধানে দাম বেড়েছে এক দশমিক ৩৭ শতাংশ। আর বছর হিসেবে দাম ছিল ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকায়। শতাংশ হিসেবে দাম বেড়েছে ২৮ দশমিক ৭০ শতাংশ পর্যন্ত।

সরেজমিনে ঢাকার মুদির দোকানগুলোতে গিয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, তারা দুই সপ্তাহ পূর্বে সরবরাহকরা মূল্যে সয়াবিন তেল বিক্রি করছেন।

শান্তিনগর বাজারের মেসার্স ফরিদপুর সরোয়ার হাফিজ স্টোরের বিক্রেতা জানান, প্রতি লিটার সয়াবিন তেল (রূপচাদা) ১৫৭ থেকে ১৬০ টাকায় বিক্রি করছেন। আর ৫ লিটার ৭৬০ টকায় বিক্রি করছেন। অন্য কয়েকটি দোকানে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতি ৫ লিটার বসুন্ধরা ব্যান্ডের সয়াবিন তেল ৭৩০ টাকা, তীর ৭৬০ টাকা, রূপচাঁদা ৭৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। আর মানভেদে প্রতি দুই লিটার ৩১৮ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। এর মধ্যে নতুন দামের তেল দোকানে থাকলেও তারা সত্যতা নিশ্চিত করেনি। একে অপরকে দায়ী করছেন। বিষয়টি এড়িয়ে তারা বলার চেষ্টা করছেন, হয়তো কোনো দোকানে আছে বা কেউ কেউ বিক্রি করছেন।

তবে গত রাতে (মঙ্গলবার) রাজন নামের একজন ক্রেতা ভোরের আকাশকে জানান, তিনি এক লিটার বোতল সয়াবিন তেল ১৬৮ টাকায় কিনেছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সফিকুজ্জামান ভোরের আকাশকে বলেন, বাজারে দাম বেড়েছে বলে আমাদের জানা নেই।

তবে রাজধানীর আহাম্মদবাগ, বাসাবো এলাকায় খুচরা দোকানে গতকাল পাঁচ লিটার সয়াবিন তেল ৮০০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে।

এদিকে গত ১৯ জানুয়ারি রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে জেলা প্রশাসক সম্মেলনে ডিসিদের সঙ্গে দ্বিতীয় দিনের বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, ‘এখন তেলের যে দাম আছে, এটিই থাকবে আগামী ১৫ দিন। আমি ব্যবসায়ীদের অনুরোধ করেছি একটু সময় দিতে। আমরা আগামী ৬ তারিখ (৬ ফেব্রুয়ারি) মানে ১৬ দিন পর বসে দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হলে বাড়াব, আর কমানোর প্রয়োজন হলে কমাব। সবকিছু বিবেচনা করে যেটি সুবিধাজনক হয়, সেটি করা হবে। এটি করলে রমজানে তেলের দাম স্বাভাবিক থাকবে। না হলে ব্যবসায়ীরা তেল আমদানি করতে নিরুৎসাহিত হবে।’

এর আগে আমদানি ব্যয় বাড়ার কারণ দেখিয়ে দেশের ভোজ্যতেল পরিশোধনকারী মিল মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন তেলের দাম লিটারে ৮ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব করে। গত ৬ জানুয়ারি সংগঠনটির সঙ্গে বৈঠক শেষে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, দেশের বাজারে আপাতত সয়াবিনের দাম বাড়ছে না।

অন্যদিকে, বাজারে সয়াবিন তেলের দাম বাড়ার বিষয়টির সত্যতা একটি বেসরকারি কোম্পানি ভোরের আকাশকে নিশ্চিত করেছে। নাম উল্লেখ না করার শর্তে তিনি জানান, বাজারে বর্তমানে প্রতি ৫ লিটার সয়াবিন তেল ৮০০ টাকায় ছাড়া হয়েছে। দাম আবার কমিয়ে আনা হচ্ছে বা সরবরাহ বন্ধ রাখা হচ্ছে। এর কারণ হিসেবে সরকার পক্ষের সঙ্গে বৈঠকে দাম বাড়ার সম্ভাবনাকে দায়ী করছেন তিনি। তবে নতুন মূল্যের পণ্য বাজারে পুরোপুরি সরবরাহ না হলেও সরকারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষা রয়েছেন তারা।

খোলা সয়াবিন তেলের বাজার সম্পর্কে বাংলাদেশ পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সিনিয়র সহ-সভাপতি মোহাম্মদ আলী ভূট্টু ভোরের আকাশকে জানান, ডিসেম্বর মাসের থেকে জানুয়ারি মাসের বর্তমান সময় পর্যন্ত লিটারে ৩ থেকে ৪ টাকা বেড়েছে। এটি স্বাভাবিকভাবে হয়েছে বলে তিনি দাবি করেন। তিনি জানান, ২০৪ লিটারের ড্রাম হিসেবে তারা খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি করে থাকেন। তাদের হিসেবে পাইকারি বাজারে প্রতি লিটার তেল বিক্রি হচ্ছে ১৩৬ থেকে ১৩৭ টাকা। যা খোলা বাজারে ভ্যালু অ্যাড (মূল যোগ) হয়ে ১৪০ থেকে ১৪২ টাকায় বিক্রি হতে পারে। কিন্তু নিত্য বাজারের প্রতি লিটার সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ১৫০ টাকায়। যা গত সপ্তাহেও ছিল ১৪৮ টাকা।

 

মন্তব্য

Beta version