বাংলাদেশে দুর্নীতি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা নতুন কিছু নয়। ব্যবসা খাতেও দুর্নীতির চিত্র উঠে এসেছে নানা গবেষণায়।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা- সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বলছে, ব্যবসায় সবচেয়ে বড় বাধা দুর্নীতি।
আর বিশ্লেষক এবং ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, শুধুমাত্র একটি পক্ষের কারণে দুর্নীতি বা ঘুষ লেনদেন হতে পারে না। ব্যবসায়ীদের অতি আগ্রহী এবং অশুভ আমলাদের কারণে এটি হচ্ছে। যাতে সাধারণ ব্যবসায়ী ও সেবাগ্রহীতারা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। যা দেশ ও সার্বিক অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর।
সংস্থাটির সর্বশেষ জরিপে বলা হয়েছে, অংশগ্রহণকারী ৭৩ জন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৬৮ শতাংশ ব্যবসায়ী মনে করেন ব্যবসায় সবচেয়ে বড় বাধা দুর্নীতি। ৬৭ শতাংশ মনে করেন অদক্ষ আমলাতন্ত্রও ব্যবসায় বড় বাধা, ৫৫ শতাংশের দাবি পুঁজির জোগান কম থাকায় সমস্যা। ৪৫ শতাংশের দাবি করোনার ক্ষতি কাটাতে ৩ বছর সময় লাগবে।
২৮ শতাংশ বলেছেন, করোনায় লোকসান কমাতে শ্রমিক ছাঁটাই হচ্ছে। ২২ শতাংশের মতে তারা নতুন ক্রেতার সঙ্গে কাজ করছেন এবং ১৯ শতাংশ বলেছেন, তারা ব্যবসা বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছেন।
তবে জরিপের তথ্যে দেখা যায়, টাকা পাচার বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসায়ীরা অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক ঝুঁকি তৈরির হওয়ার আশঙ্কা করছেন।
ব্যসায় দুর্নীতি প্রতিরোধে একটি ‘জাতীয় জবাবদিহি কমিশন’ গঠনের পরামর্শ দিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্নীতি, অদক্ষ আমলাতন্ত্র ও পুঁজির জোগানের সীমিত সুযোগ এ তিন চ্যালেঞ্জ ব্যক্তি খাতের জন্য সুখকর নয়। অথচ দেশের অর্থনীতির ৮০ শতাংশই আসে ব্যক্তি খাত থেকে।
এ বিষয়ে ঢাকা চেম্বারের সভাপতি রিজওয়ান রাহমান ভোরের আকাশকে বলেন, ’দুর্নীতির ব্যাপারটা বাংলাদেশে নতুন কিছু না। আজকে ৫০ বছর হয়ে গেছে বাংলাদেশের বয়স। কিন্তু এর মধ্যে কোনো পরিবর্তন আসেনি। বরং ধারাবাহিকভাবে এটা বাড়ে।
‘এর মূল কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশে দুর্নীতি প্রতিরোধে প্রাতিষ্ঠানিক কোনো জবাবদিহিতা নেই। এটি শুধু সরকারি খাত নয়। বেসরকারি খাতেও হচ্ছে। আমার একটা মন্তব্য সবসময় থাকবে, ঘুষ আগে দেয়, পরে নেয়। কাজেই যে ঘুষ দেয় তাকে বন্ধ করতে হবে। তাহলে ঘুষ নেওয়া বন্ধ হতে পারে।
‘এমন কর্মচারী আছে, যাদের স্বাক্ষরের দাম হচ্ছে কোটি টাকা, কিন্তু তাদের বেতন হচ্ছে ৩০ হাজার টাকা। সে কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে ভুল পথে যেতে অনেকটা বাধ্য। যেখানে সে দিন এনে দিন খেতে পারছে না, অথচ তার একটি স্বাক্ষরে শত শত কোটি টাকার কাজ পাস হয়ে যাচ্ছে।’ বলেন রিজওয়ান রাহমান।
দুর্নীতি প্রতিরোধে ব্যবসায়ীদের এই নেতা একটি ‘জাতীয় জবাবদিহি কমিশন’ গঠনের পরামর্শ দেন। যেখানে সরকারি-বেসরকারি খাতের সব প্রতিষ্ঠানকে যেকোনো সময় শুনানির জন্য ডাকা যাবে। আর এর গঠন প্রক্রিয়ায় সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের বিশিষ্টজনদের নেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
সিপিডি জানায়, কোভিড-পরবর্তী ব্যবসায় পরিবেশের পরিস্থিতি জানার জন্য মার্চ থেকে জুন ২০২১ সময়কালে একটি উদ্যোক্তা জরিপ পরিচালনা করে। এ জরিপে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, ফরিদপুর ও চট্টগ্রামের ৭৩ জন উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ী অংশগ্রহণ করেন।
এ জরিপকালে উদ্যোক্তারা মোট ১২টি সুনির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর তাদের মতামত প্রদান করেন। এসব বিষয়ের মধ্যে রয়েছে - প্রতিষ্ঠান, পরিবেশ, অবকাঠামো, জনস্বাস্থ্য, সামাজিক সুরক্ষা, শিক্ষা এবং দক্ষতা, শ্রমবাজারের দক্ষতা এবং ব্যবসার উদ্ভাবন ইত্যাদি। জরিপে জানুয়ারি-ডিসেম্বর ২০২০ সময়কালের ব্যবসা সম্পর্কিত তথ্য-উপাত্ত এক্ষেত্রে বিবেচনা করা হয়।
জরিপ বিষয়ে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেছেন, দুর্নীতি, অদক্ষ আমলাতন্ত্র ও পুঁজির জোগানের সীমিত সুযোগ এ তিন চ্যালেঞ্জ ব্যক্তি খাতের জন্য সুখকর নয়। অথচ দেশের অর্থনীতির ৮০ শতাংশই আসে ব্যক্তি খাত থেকে।
ব্যবসায় দুর্নীতির বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান ভোরের আকাশকে বলেন, ‘দুর্নীতি কমানোর ক্ষেত্রে সম্ভাবনা আছে, কিন্তু তা বাস্তবায়নে অনেক বাধা রয়েছে। আমাদের প্রতিষ্ঠান আছে, আইন আছে এবং রাজনৈতিক অঙ্গীকার আছে।
‘রাজনীতির শীর্ষ পর্যায় থেকে এই অঙ্গীকার করা হয়। সুন্দর সহশীলতার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা দেখা দেয়। ঘুষ লেনদেনের বিষয়ে ব্যবসায়ীরাও সমানভাবে দায়ী বা দোষী। কারণ সরকারি দপ্তরে কাজ করা বা কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরাই প্রতিবন্ধকতার সুযোগ নিয়ে থাকে। নিজেদের স্বার্থেই কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে। সরকারি খাতে ব্যবসায়ীদের দুর্নীতির কারণ হলো সরকারি কাজের (প্রকল্প) ব্যবসা।’
তিনি বলেন, দুর্নীতি সত্যিই বিকাশ হচ্ছে, দুর্নীতিকে বাস্তবাতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হচ্ছে। এই জায়গায় পরিবর্তন লাগবে।
মন্তব্য