-->
শিরোনাম
করোনার অভিঘাত

বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির প্রভাব বাংলাদেশেও

জাফর আহমদ
বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির প্রভাব বাংলাদেশেও
প্রতীকী ছবি

করোনার অভিঘাত কাটিয়ে উঠতে বিশ্বজুড়ে চলছে অর্থনৈতিক উদ্ধার কার্যক্রম। এরই মধ্যে বেড়েছে কাঁচামাল ও জ্বালানির দাম। চাহিদা বেড়ে যাওয়ার ফলে খাদ্যের দামও বেড়েছে। টান পড়েছে সরবরাহে। এর প্রভাব পড়েছে প্রত্যেকটা দেশে। বাদ যায়নি বাংলাদেশের অর্থনীতিও। বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম। ফলে প্রাক্কলিত মূল্যস্ফীতি ধরে রাখা যাচ্ছে না। বছর শেষে এর হার আরো বৃদ্ধির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ৫ দশমিক ৯৮ শতাংশ। এর মধ্যে খাদ্যে ৫ দশমিক ৪৩ শতাংশ। আর খাদ্যবহির্ভূত খাতে মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৮৭ শতাংশ। যা আগের বছরের চেয়ে বেশি। জ্বালানি, ভোজ্য ও খাদ্যের মূল্য বৃদ্ধির ফলে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। এ বছর মূল্যস্ফীতির হার প্রাক্কলন আছে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। আগের বছর একই সময়ে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৫ দশমিক ৭০ শতাংশ।

মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশের কাছাকাছি। এ অবস্থায় মূল্যস্ফীতি নাগালের মধ্যে রাখা সম্ভব হবে না বলে মনে করছেন বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনোমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন।

তিনি ভোরের আকাশকে বলেন, দুটি কারণে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। তা হলো- প্রথমত, চাহিদা বৃদ্ধির কারণে। চলতি অর্থবছরে প্রথম ছয় মাসে চাহিদা বেড়েছে। এ সময়ে করোনার অভিঘাতটা কমে গেছে। করোনার মধ্যে মানুষ খরচ করতে পারেনি। করোনার লকডাউন উঠে যাওয়ার ফলে মানুষ খরচ করা শুরু করে।

করোনার মধ্যে কঞ্জুমার যেসব আইটেম ছিল, এগুলোর ভোগ কমে গিয়েছিল। করোনা উঠে যাওয়ার পর এর ভোগ শুরু হয়েছে। এ কারণে নতুন করে চাহিদা বেড়ে গেছে। আর অপরটি হলো সরবারহে ঘাটতি। যেটা আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর নির্ভরশীল।

মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির অন্য কারণ হলো জ্বালানি ও সারের দাম বেড়ে যাওয়া। যদিও আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লেও সরকার ভর্তুকি বাড়িয়ে দিয়ে এটা নিয়ন্ত্রণে রাখে। এটা সরাসরি বাজারে ইফেক্ট করে না। কিন্তু তারপরও সরকার নভেম্বরে তেলের দামের সমন্বয় করেছে।

এর প্রভাব পড়েছে বাজারে। জ্বালানি তেলে মূল্যবৃদ্ধির কারণে প্র্রভাব পড়ে উৎপাদন, বিপণনসহ সব ক্ষেত্রে। হয়েছেও তাই। এটা ইফেক্ট, কিন্তু এখনো আমাদের তথ্যে উঠে আসেনি। আরো দু-একদিন পর এ তথ্য পাওয়া যাবে। এর বাইরে আরো যেসব খাত রয়েছে সরাসরি জ্বালানির প্রভাব পড়ে না, সেসব খাতে প্রভাব পড়তে আরো খানিক সময় লাগবে, এপ্রিল পর্যন্ত লেগে যেতে পারে।

যুুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অর্থনীতিবিষয়ক গণমাধ্যম ব্লুম্বারের মতে, বিশ্বজুড়ে করোনা মূল্যস্ফীতির কবলে পড়তে যাচ্ছে। এর প্রভাব ইতোমধ্যে কিছুটা ফুটে উঠেছে। আমদানি-রপ্তানিতে এর প্রভাব স্পষ্ট হচ্ছে। বিশ্বজুড়েই চাহিদায় বড় ধরনের টান পড়েছে। করোনার মধ্যে উৎপাদন বিনিয়োগ বন্ধ থাকার কারণে বিশ্বজুড়ে অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়েছিল।

করোনার অভিঘাত কমে আসার পর এবং একই সঙ্গে টিকা দেওয়া শুরু হলে মানুষ স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফেরা শুরু করে। এর প্রভাব গিয়ে পড়ে মানুষের চাহিদায়। এর ফলে আমদানি রপ্তানিতে চাপ তৈরি হয়েছে। এর চাপ তৈরি হয়েছে বন্দরগুলোতে।

অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার কার্যক্রম শুরু হওয়ার ফলে জ্বালানির দাম বেড়ে গেছে। বিশেষ করে অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধারের জন্য দেশে দেশে প্রণোদনা স্কিমের নামে অর্থ পুশ করার ফলে উৎপাদন বিনিয়োগ যে হারে বেড়েছে, মানুষের চাহিদ ও খরচ বেড়েছে কয়েক গুণ বেশি হারে। ফলে প্রভাব পড়েছে দামে। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই মূল্যস্ফীতি বেড়েছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আগামী মাসগুলোতে এর মাত্রা আরো তীব্র হতে পারে। এর প্রভাব থেকে বাংলাদেশও বাদ যাচ্ছে না। জ¦ালানির দাম বেড়ে যাওয়া ও অভ্যন্তরীণ বাজারে অ্যাডজাস্টি করা। খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে ইতোমধ্যে এর নেতিবাচক প্রভাবক পড়েছে। করোনার তৃতীয় ধাপের তাণ্ডব-ওমিক্রনের মধ্যেই অর্থনীতির উদ্ধারের কার্যক্রম চলছে।

বিশেষ করে কোভিড-১৯-এর টিকার প্রয়োগের ফলে মানুষ অনেকটা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গেছে। ফলে চাহিদাতে বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি হয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে সরবারহে। চাপ পড়েছে জ্বালানি ও জনবলে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আগামী দিনগুলোতে মূল্যস্ফীতি আরো তীব্র হতে পারে। বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনোমিস্ট জাহিদ হোসেনের মতে, মূল্যস্ফীতি যে কারণে বাড়ছে, এটা একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা। করোনা অভিঘাত থেকে পুনরুদ্ধারে যেসব প্যাকেজ কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছিল করোনা-পরবর্তী সেগুলোর কার্যক্রম চলমান আছে।

সেই সঙ্গে সাপ্লাই চেন সমস্যা ও শ্রমবাজারে সংকটের কারণে মজুরি বেড়েছে। এছাড়া করোনা-পূর্ববর্তী চাহিদাতে ফিরে আসার কারণে বাজারে প্রভাব ফেলেছে, এনার্জি দামে ইনফ্লুয়েন্স তৈরি করেছে।

আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে নতুন মাত্রা যোগ করেছে রাশিয়া-ইউক্রেন উত্তেজনা। মধ্যপ্রাচ্যের দেশ দুটি খাদ্য রপ্তানি করে থাকে। রাশিয়া ইউরোপের বিভিন্ন দেশে তেল ও গ্যাস রপ্তানি করে থাকে। দেশ দুটির মধ্যে যে উত্তেজনা বিরাজমান, এটা যদি আরো প্রলম্বিত হয় এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন দেশ দুটির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে তাহলে খাদ্য ও জ্বালানিতে বড় ধরনের প্রভাব পড়বে।

বিশ্বজুড়ে মূল্যস্ফীতি তীব্র আকার ধারণ করবে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্য থাকায় বাংলাদেশে এর প্রভাব পড়বে। প্রভাব পড়বে মধ্যপ্রাচ্যের বাজারনির্ভর রেমিট্যান্সেও।

বিশ্বজুড়ে চলমান মূল্যস্ফীতি আরো তীব্র হলে রপ্তানিকারকরা স্বস্তিতে থাকতে পারবে না। একদিকে রপ্তানি আদেশ কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, অন্যদিকে রপ্তানিবাণিজ্যে আমদানিকৃত কাঁচামালনির্ভর দেশগুলো সমস্যায় পড়বে। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো কাঁচামাল আমদানিনির্ভর দেশগুলোকে বেশি সমস্যায় পড়তে হবে। যদিও দেশে আপাতত বিপুল পরিমাণ রপ্তানির আদেশ আছে।

দেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক খাত বিজিএমইএর নেতা শোভন ইসলাম বলেন, করোনা মহামারির মধ্যে আমেরিকার মতো দেশগুলো সুদ হার শূন্য রেখে প্রণোদনা প্যাকেজের মাধ্যমে সেসব দেশের অর্থনীতিকে চাঙা রেখেছিল। বিশ্বজুড়ে এ সমস্যার মুুখোমুখি।

বাংলাদেশ বিশ্ববাণিজ্যে অবিচ্ছেদ্য অংশ হওয়ায় আমদানি-রপ্তানি বা প্রবাসী আয়ের টান পড়বে। তাই আপাতত খাদ্যপণ্য বা তেলের মূল্য বৃদ্ধিজনিত মূল্যস্ফীতি কিছুটা দেখা দিলেও আগামী মাসগুলোতে আরো স্পষ্ট হবে।

মন্তব্য

Beta version