-->
শিরোনাম

পাঁচ পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণই চ্যালেঞ্জ

জুনায়েদ হোসাইন
পাঁচ পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণই চ্যালেঞ্জ

এক বছরে মসুর ডালের দাম বেড়েছে ৪৪ ভাগ। মুগ ডালের দাম বেড়েছে ছয় ভাগ পর্যন্ত। সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে ২৭ ভাগ, চিনির দাম বেড়েছে সাড়ে ১৩ ভাগ পর্যন্ত।

সেইসঙ্গে সবজি ও খেজুরের বাজারও কিছুটা বাড়তির দিকে রয়েছে বলে জানিয়েছেন খুচরা ব্যবসায়ীরা।

আসন্ন রমজানকে কেন্দ্র করে প্রয়োজনীয় এসব পণ্যের দাম বাড়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বাজার বিশ্লেষক ও সাধারণ ক্রেতারা।

তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, রমজান মাসে নিত্যপণ্যের দাম স্বাভাবিক রাখতে আগামী রোববার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক আহ্বান করা হয়েছে।

দাম স্বাভাবিক রাখতে এ বছর ১০ থেকে ১৫ ভাগ বেশি পণ্য বাজারে সরবরাহ করা হবে। তবে আমদানিনির্ভর পণ্যের ক্ষেত্রে দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা খুবই চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন সরকারের নীতিনির্ধারকরাও।

তারা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লে দেশের বাজারে দাম বাড়বে এটাই স্বাভবিক।

চাঁদ দেখা সাপেক্ষে আগামী এপ্রিল মাসে শুরু হবে পবিত্র ‘রমজান’ মাস। রমজানকে সামনে রেখে উন্নত ও আরব দেশগুলোতে নিত্যপণ্যের দাম কমলেও বাংলাদেশের বাজার অস্থির হয়ে ওঠে।

সরকারের পক্ষ থেকে নিত্যপণ্যের বাজারে সংকট হবে না বললেও ইতোমধ্যে কয়েকটি পণ্যের মূল্য বেড়ে গেছে। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সভা করেও তেমন একটা ফল মিলছে না।

ভোরের আকাশের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ইতোমধ্যে ভোজ্যতেলের দাম ব্যবসায়ীরা বাড়িয়ে দিয়েছে। চিনি, ছোলা এবং ডালের মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। ব্যবসায়ী ও বিশ্লেষকরা বলছেন, নিত্যপণ্যের বাজার অনেকটা আমদানিনির্ভর

হওয়ায় দাম ওঠানামা করে। তবে বাংলাদেশে একবার কোনো পণ্যের দাম বাড়লে তা কমার ইতিহাস নেই বলে দাবি করেন ভোক্তারা।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, রমজান মাস উপলক্ষে তেল, চিনি, ছোলা, ডাল ও খেজুরের চাহিদা ঠিক করা হয়েছে। এ বছর গত বছরের তুলনায় প্রতিটি পণ্যে ১৫ থেকে ১০ শতাংশ হারে চাহিদা বৃদ্ধি করা হয়েছে।

এ হিসেবে সয়াবিন তেলের চাহিদা ২৭ হাজার মেট্রিক টন থেকে ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি করে ৩১ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন, চিনির চাহিদা ২৫ হাজার মেট্রিক টন থেকে ১০ শতাংশ বাড়িয়ে ২৭ হাজার মেট্রিক টন, ডালের চাহিদা ১০

শতাংশ বাড়িয়ে ১১ হাজার মেট্রিক টন, ছোলার চাহিদা ২ হাজার টন বাড়িয়ে ১০ হাজার মেট্রিক টন এবং খেজুরের চাহিদা ২৫০ টন বৃদ্ধি করে ৭৫০ মেট্রিক টন নির্ধারণ করা হয়েছে। এই প্রস্তুতির অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে দরপত্র আহ্বানের কাজ শেষ হয়েছে।

অল্প সময়ের মধ্যে ব্যবসায়ীদের দরপত্রে অংশগ্রহণের জন্য আহ্বান করা হবে। ইতোমধ্যে কয়েকটি কোম্পানি তাদের তথ্য জমা দিয়েছে বলে জানিয়েছে টিসিবি।

এদিকে বাজারে পাঁচ, দুই ও এক লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেল, খোলা পাম অয়েল, আদানি পেঁয়াজ, মসুর ডাল, শুকনা মরিচের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে।

পাঁচ লিটার সয়াবিন তেল ৭৮০ থেকে ৮০০ টাকা, এক লিটারের বোতল ১৬৮ টাকা, খোলা পাম অয়েল প্রতি লিটার ১৩৬ টাকা বা তারও বেশি, আমদানি করা পেঁয়াজ প্রতি কেজি ৪০ থেকে ৫০ টাকা, প্রতি কেজি মসুর ডাল ১১৫

থেকে ১২০ টাকা, মুগ ডালের কেজি ১২০ থেকে ১৩৫ টাকা, ছোলা ডাল ৪৮ থেকে ৫০ টাকা, প্রতি কেজি ছোলা মানভেদে ৭০ থেকে ৭৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া শুকনা মরিচের কেজি ২৬০ থেকে ৩৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, শুধু রমজান মাসে নয়, সারা বছর ভোগ্য পণ্যের বাজার শক্ত সিন্ডিকেট জিম্মি করে রাখে। তাদের ইচ্ছার ওপরই নির্ভর করে দ্রব্যমূল্য। আর বাজার পরিস্থিতির বিষয়ে পাইকারি ব্যবসায়ীরা নিজেদের চুনোপুঁটি দাবি করছেন।

তাদের মতে, দেশের মাত্র ৫ থেকে ১০টি কোম্পানি নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। যাদের নিকট সারা দেশের সাধারণ জনগণ জিম্মি হয়ে থাকেন। তাদের ইচ্ছায় বাজার দর ওঠানামা করে।

এদিকে রমজান উপলক্ষে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ব্যবসায়ীসহ নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এ ছাড়া বাজার পরিস্থিতির বিষয়ে গোয়েন্দা সংস্থা প্রতিবেদন তৈরি করছে বলে জানা গেছে।

সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) জনসংযোগ কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির ভোরের আকাশকে জানান, রমজানের এখনো অনেক দেরি। এরপরও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় টিসিবি প্রস্তুতি শুরু করেছে।

রমজান ও রমজানপূর্ব সময়ে টিসিবি খোলা বাজারে (ভ্রাম্যমাণ ট্রাকে) পণ্য বিক্রি করবে। গতবারের মতো এবারও ব্যাপকভাবে সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করবে টিসিবি।

উল্লেখ্য, গত বছর (২০২১) নিত্যপণ্যের বাজার পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখতে সারা দেশে ৪০০টি ভ্রাম্যমাণ ট্রাকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত নিত্যপণ্য বিক্রি অব্যাহত রাখে টিসিবি।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ৬ ফেব্রুয়ারি অত্যাবশ্যকীয় পণ্য বিপণন ও পরিবেশকবিষয়ক জাতীয় কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হবে। সভায় রমজান মাসের প্রস্তুতি বিষয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে পণ্যভিত্তিক আলোচনা করে মূল্য ঠিক করা হবে।

এর আগে গত ১৯ জানুয়ারি ডিসি সম্মেলনে আসন্ন রমজানে পণ্যের দাম সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে রাখতে বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা বাড়াতে জেলা প্রশাসকদের নির্দেশনা দেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি।

সে সময় তিনি বলেছেন, নিত্যপণ্যের দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হলে বাড়াব আর কমানোর প্রয়োজন হলে কমাব। সবকিছু বিবেচনা করে যেটি সুবিধাজনক হয়, সেটি করা হবে। এটি করলে রমজানে দাম স্বাভাবিক থাকবে।

রমজানের প্রস্তুতির বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান ভোরের আকাশকে বলেন, বাজার পরিস্থিতির বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কয়েকবার

বৈঠক করা হয়েছে। ৬ ফেব্রুয়ারি গুরুত্বপূর্ণ সভা অনুষ্ঠিত হবে। এ ছাড়া গোয়েন্দা সংস্থা বাজার পর্যবেক্ষণ করছে। আশা করছি, রমজানে নিত্যপণ্যের বাজার পরিস্থিতি ভালো থাকবে।

সিটি গ্রুপের করপোরেট ও রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স বিভাগের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা ভোরের আকাশকে বলেন, রমজানে কী হবে, তা এখন বলা যাচ্ছে না। আন্তর্জাতিক বাজারে গম, তেল ও চিনির দাম বাড়ার ইতিহাস হয়েছে। তাই এখন বলা মুশকিল। বাজার পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর নির্ভর করবে।

একই প্রসঙ্গে ঢাকার মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. গোলাম মাওলা ভোরের আকাশকে বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় রজমানের এক মাস আগে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে অর্থাৎ আমদানিকারকদের সঙ্গে বৈঠক করে।

সেখানে ঠিক হয় বাজার কেমন হবে। এক্ষেত্রে আমরা পাইকারি ব্যবসায়ীরা তেমন কিছু বলতে পারি না, বা করতে পারি না। তিনি বলেন, এ বছর প্রতিদিনই নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে। ব্যবসায়ীরা বাড়তি দামে কিনে তো কম দামে বিক্রি করতে পারবে না।

তবে সরকারের সিদ্ধান্তের আগে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির বিষয় তিনি আমদানিকারকদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছেন এবং নিজেদের চুনোপুঁটি হিসেবে তুলনা করেছেন।

জানা গেছে, বিশ্বব্যাংক গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশনের (আইএফসি) এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের শীর্ষ ২৩টি বৃহৎ গ্রুপ বা কোম্পানির তালিকার নাম এসেছে। এর মধ্যে এ কে খান গ্রুপ, বসুন্ধরা,

মেঘনা, যমুনা, স্কয়ার, টিকে, আকিজ, বেক্সিমকো, ইউনাইটেড, সিটি, এসিআই লিমিটেড, ট্রান্সকম, ভিয়েলাটেক্স, প্যাসিফিক জিনস, কনফিডেন্স গ্রুপ অন্যতম। এসব কোম্পানি মূলত বিদেশ থেকে পণ্য আমদানির সিংগভাগই করে থাকে।বাজার পরিস্থিতির বিষয়ে কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান ভোরের আকাশকে বলেন, রমজানে নিত্যপণ্যের দাম কমার কথা, সেখানে আমাদের দেশে বেড়ে যায়। এজন্য বলব,

রমজানে যাতে সরবরাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকে। এজন্য সরকার ও ব্যবসায়ীদের সমন্বয় করে ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে কোনো সিন্ডিকেট বাজার পরিস্থিতি খারাপ করতে না পারে।

বাজারে প্রতিযোগিতা তৈরির জন্য সরকারের প্রতিযোগিতা কমিশনকে কার্যক্রম বাড়ানোর পরামর্শ দেন এই বিশ্লেষক। যাতে বাজার পরিস্থিতি সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকে এবং জনসাধারণ স্বস্তিতে থাকেন।

 

মন্তব্য

Beta version