-->

অনুমোদনহীন বিদেশি বীজ ও চারায় নিঃস্ব কৃষক

নিজস্ব প্রতিবেদক
অনুমোদনহীন বিদেশি বীজ ও চারায় নিঃস্ব কৃষক

গবেষণা ফলাফল যাচাই না করে, জাতীয় বীজনীতি ও কৃষিনীতি উপেক্ষা করে আমদানি করা হচ্ছে বিভিন্ন জাতের বিদেশি চারা। অধিক ফলনের প্রলোভনে এসব চারা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সারা দেশের কৃষকদের মাঝে। ভালো ফলনের লোভে এসব চারা আবাদ করে ব্যাপক লোকসানের মুখে পড়েছেন দেশের কৃষক।

অনুসন্ধানে জানা যায়, গবেষণা বা কোনো ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই দেশে আমদানি করা হচ্ছে এসব চারা ও বীজ। জাতীয় বীজনীতি এবং কৃষিনীতি অনুযায়ী গবেষণা ছাড়া এ ধরনের চারা বা বীজ আমদানি নিষিদ্ধ। বিধি উপেক্ষা করে আমদানি করা এসব চারা দেশের কৃষকদের মাঝে দীর্ঘদিন ধরে বিতরণ করা হচ্ছে। না বুঝে অধিক ফলনের আশায় এসব চারা চাষ করে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে দেশের কৃষক। বিশেষ করে ছোট জাতের নারিকেলের চারার বাগান করে ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন চাষিরা।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, বিদেশি যেসব জাতের চারা এদেশে সম্প্রসারণ করা হচ্ছে, তা বাংলাদেশের আŸহাওয়ার সঙ্গেও মানানসই নয়।

কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একজন সরকারি কৃষি কর্মকর্তার ব্যক্তিগত ইউটিউব চ্যানেলে বিদেশি চারার প্রচার অনুষ্ঠান দেখেই চাষিরা বিদেশি জাতের চারা রোপণে উৎসাহিত হচ্ছেন। কৃষি কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত ইউটিউব চ্যানেলে বিশেষ করে চুয়াডাঙ্গার কৃষি কর্মকর্তা তালহা জোবায়ের মাশরুরের ‘কৃষি বায়োস্কোপ’ নামের চ্যানেলে প্রচারিত বিজ্ঞাপনে কৃষকরা বিভ্রান্ত হচ্ছেন। নিয়ম না থাকলেও সরকারি কৃষি কর্মকর্তারা চালাচ্ছেন এসব ব্যক্তিগত ইউটিউব চ্যানেল।

শুধু ছোট জাতের নারিকেল নয়, ত্বিন ফল, চাইনিজ কমলা, কাটিমনসহ উন্নত জাতের বিভিন্ন ফলের চাষ করে, লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেও তারা ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়েছেন। নাটোর, রাজশাহী, যশোর, ঝিনাইদহ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, কক্সবাজার, চুয়াডাঙ্গাসহ বিভিন্ন জেলায় কৃষকরা এসব চারার চাষ করে আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়েছেন। যে কারণে ক্ষোভে-দুঃখে বাগান কেটে ফেলেছেন অনেকে।

বেশি ফলনের প্রলোভন দেখিয়ে আনা এসব চারায় দেশে ভালো ফলন পাওয়া যাচ্ছে না তার প্রমাণ পাওয়া গেছে সম্প্রতি কৃষি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব বরাবর বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. মো. নজরুল ইসলামের এক চিঠিতে। ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘খাটো জাতের নারিকেল চারার বিষয়ে বিজ্ঞানীদের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, দেশের উত্তরাঞ্চলের বেশির ভাগ স্থানে এই জাতের ভালো ফলন হয়নি। তবে দু-একটা জায়গায় উপযুক্ত পরিচর্যায় ভালো ফল পাওয়া গেছে।’ চিঠিতে গবেষণা মূল্যায়নের জন্য উন্নত জাতের চারা বা স্যাম্পল কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের কাছে পাঠানোর অনুরোধ করা হয়েছে। এ ছাড়া চিঠিতে মনিটরিংয়ের জন্য চারা গ্রহীতাদের মোবাইল নম্বরসহ তালিকা মন্ত্রণালয়ে জমা দিতে বলা হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উন্নত জাতের চারা বা বীজ ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। গবেষণা ছাড়া উন্নত জাত ব্যবহার করা ঠিক হবে না। তাহলেই কৃষক আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হবে না। দেশেও ফসল উৎপাদনে ব্যাপক প্রভাব পড়বে। কৃষিনির্ভর অর্থনীতিও শঙ্কায় পড়বে না।

এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কাক্সিক্ষত ফলন না হওয়ায় ব্যাপক সমালোচনার মুখে এরই মধ্যে ছোট জাতের নারিকেলের চারা আমদানি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খাটো জাতের নারিকেল গাছ, কাটিমন আম, কাজু বাদাম, মিয়াজাকি (সূর্যডিম) আম, সৌদি খেজুর, ত্বিন ফল, চাইনিজ কমলা, আপেল, পারসিমন, ড্রাগন ফল, বেদানাসহ বিভিন্ন বিদেশি জাত বাংলাদেশে আবাদের জন্য কৃষককে উৎসাহিত করা হচ্ছে। এসবের একটি জাতেও কাক্সিক্ষত ফল পাওয়া যাচ্ছে না। বিশেষ করে ছোট জাতের নারিকেলের চারার কোনো ফলন না হওয়ার বিষয়টি নিয়ে কৃষি সংশ্লিষ্টদের মধ্যে তোলপাড় শুরু হয়েছে। এ কারণে এই জাতের নারিকেলের চারা আমদানি বন্ধ করা হয়েছে। তবে অন্য ফসলের জাতের চারা ব্যবহার চলছে এখনো।

এদিকে বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্পের নামে এসব চারা বিতরণে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকেও ব্যাপক প্রচার চালানো হয়েছে। এমনি একটি প্রচারপত্রে বলা হয়েছে, ‘আমাদের দেশে লম্বা জাতের যেসব নারিকেল গাছ রয়েছে তা তুলণামূলক কম ফলনশীল। প্রতিটি গাছে ৩০-৪০টি নারিকেল ধরে। দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে এসব জাতের নারিকেল চাষের প্রচলন অনেক দিন থেকেই। প্রাকৃতিক দুর্যোগে এসব নারিকেল চাষ কম সহনশীল। পক্ষান্তরে ছোট জাতের নারিকেলের আধুনিক জাত অল্প সময়ে ফল দেওয়া আরম্ভ করে। ফলদান ক্ষমতা অনেক বেশি। ঝড়ে ভাঙে না। প্রতি গাছে ফল ধরে ১৫০টা করে। প্রতিটির ওজন এক থেকে দেড় কেজি পর্যন্ত। ডাবে পানির পরিমাণ আড়াইশ থেকে তিনশ মিলি পর্যন্ত। এই চটকদার বিজ্ঞাপনের ফাঁদে ফেলে কৃষকদের আকৃষ্ট করলেও বিদেশি উচ্চ ফলনশীল জাতের চারা নিয়ে তৈরি হয়েছে ব্যাপক সন্দেহ। কৃষকরা বলছেন, এসব চারা এনে একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা কৃষকদের ঠকিয়ে নিজেরা আর্থিকভাবে ব্যাপক লাভবান হয়েছে।

জানা গেছে, প্রথমদিকে কেরালা থেকে ছোট জাতের নারিকেল চারা আমদানি শুরু হয়। মূলত উপকূলীয় এলাকাকে ঘূর্ণিঝড়ের হাত থেকে রক্ষার জন্য এই ছোট জাতের নারিকেল চাষের উদ্যোগ নেওয়া হয়। একইভাবে ভিয়েতনাম থেকেও ছোট (ওপি) ও খাটো জাতের এই নারিকেল চারা এনে চাষের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু উপকূলীয় এলাকা ছাড়াও সারা দেশে কৃষকদের মাঝে এই চারা বিতরণ করা হয়েছে উপজেলা কৃষি অফিসের মাধ্যমে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিপ্তর থেকে ‘বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্প নাম দিয়ে এসব চারা চাষ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়।

এজন্য বিভিন্ন ইউটিউব চ্যালেনের মাধ্যমে গুণাগুণ ও ব্যবসায়িক সাফল্য সম্পর্কে মিথ্যা ও মুখরোচক প্রচার চালানো হয়েছে। এই ফাঁদে পড়ে নিঃস্ব হয়েছেন অনেকে। কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশে ৭০ হাজারেরও ঊর্ধ্বে কাটিমন জাতের বাগান করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তারা। ত্বিন ফলের লাখ লাখ চারা আবাদ করে কাক্সিক্ষত ফলন পাওয়া যায়নি। চাইনিজ কমলার লক্ষাধিক বাগান করেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন চাষিরা। আর খাটো জাতের নারিকেলে ফল না পেয়ে বাগান কেটে ফেলেছেন কৃষকরা।

কৃষিতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারপ্রাপ্ত কৃষক মো. সেলিম রেজা এ বিষয়ে বলেন, কৃষকদের কোটি টাকা আয়ের মিথ্যা স্বপ্ন দেখিয়ে বিদেশি জাতের চারার বিষয়ে বিভিন্ন মিডিয়ায় বিজ্ঞাপন প্রচার করা হচ্ছে। সরকারি কৃষি কর্মকর্তার নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেল ব্যবহার করেও চলছে প্রচার। একটি চক্র দীর্ঘদিন ধরে প্রচার চালাচ্ছে। এসব কারণে বিদেশি জাতের চারা রোপণে উৎসাহিত হচ্ছে কৃষক। তিনি আরো বলেন, আমাদের দেশের প্রায় সব কৃষকই স্বল্পশিক্ষিত। ফলে তারা সহজেই প্রতারিত হচ্ছেন। এ ধরনের প্রচার চালিয়ে একটি চক্র দেশের কৃষিখাতের ব্যাপক ক্ষতি করে আসছে। এর থেকে জরুরি পরিত্রাণ দরকার।

এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মোহাম্মদ হুমায়ন কবির পল্লব বলেন, জাতীয় বীজনীতি অনুযায়ী পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই কেউ এভাবে কৃষকদের মাঝে চারা বিতরণ করতে পারেন না। তিনি বলেন, ‘জাতীয় কৃষিনীতি অনুসারে বিদেশ থেকে গবেষণা ছাড়া কেউ আর বীজ আনতে পারবে না। পর্যাপ্ত গবেষণার পর প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে কৃষকদের কাছে চারা বিক্রি করতে হবে। চারা বা বীজ কেনায় অনুসরণ করতে হবে এ সংক্রান্ত আইন ও বিধিমালা। কিন্তু এটা অনুসরণ না করেই একশ্রেণির কর্মকর্তারা চারা বিতরণ করে কৃষকদের ক্ষতি করছেন। তারা রাষ্ট্রীয় স্বার্থ না দেখে শুধুই নিজেদের আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার উদ্দেশ্যে এ কাজে জড়িয়ে পড়ছেন। যা আমাদের কৃষিনির্ভর অর্থনীতির জন্য অশনিসংকেত।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসব উন্নত জাতের মধ্যে একমাত্র ড্রাগন ফল অধিক ফলনশীল বলে বিবেচিত হয়েছে। বাকিগুলোর একটির ক্ষেত্রেও ভালো ফল পাওয়া যায়নি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই উচ্চ ফলনশীল জাতের চারা দেশে আমদানি করা হচ্ছে। দেশের আবহাওয়া ও মাটির সঙ্গে মানানসই কি না তা গবেষণা করে যাচাই করা হয়নি। অথচ এসব জাতের কোনোটির ক্ষেত্রেই ভালো ফলন পাওয়া যায়নি।

মন্তব্য

Beta version