-->

সাশ্রয় হবে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা

জাফর আহমদ
সাশ্রয় হবে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা

দেশে আর দশটি অর্থকরী ফসলের মতো তুলা চাষও লাভজনক। বাংলাদেশের মাটি ও আবহাওয়া উপযোগী হওয়ার কারণে তুলা চাষের এই সম্ভাবনা আরো বেড়ে গেছে। তবে খাদ্যশস্য উৎপাদনের জমি কমে যাওয়ার আশঙ্কায় তুলা চাষের প্রসার করা যাচ্ছে না। প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ তুলা বিদেশ থেকে আমদানি করা হচ্ছে। দেশে সম্ভাবনাময় এই তুলার চাষ বৃদ্ধি করা গেলে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হতো।

দেশে প্রতি বছর প্রায় ৮০ লাখ বেল তুলা আমদানি করতে হয়। এজন্য ৩০ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হয়। তুলার এই বিপুল পরিমাণ চাহিদার বিপরীতে দেশে উৎপাদন হচ্ছে দুই লাখ বেল তুলা। যা মোট চাহিদার দুই থেকে দুই দশমিক ৫০ শতাংশ। আগামী ২০৩০ সাল নাগাদ দেশে ১০ লাখ বেল তুলা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ করছে তুলা উন্নয়ন বোর্ড। এই লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হলে দেশে উৎপাদিত তুলা দিয়ে মোট চাহিদার ১২ শতাংশ মেটানো সম্ভব হবে। তখন দেশের তুলা থেকেই তিন হাজার ৬০০ কোটি টাকার সমপরিমাণের বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে। বর্তমানে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত তুলার পরিমাণ ২ লাখ বেলের নিচে। যার মাধ্যমে সাশ্রয় হচ্ছে ৬০০ কোটি টাকা। তৈরি পোশাক থেকে প্রতি বছর ৩০ বিলিয়ন ডলার আয় হচ্ছে। এই রপ্তানি আয়ের বড় অংশ আসে আমদানি করা তুলার মাধ্যমে উৎপাদিত পোশাক থেকে। যা ভারত, চীন, ব্রাজিল ও আমেরিকা থেকে আমদানি করা হয়। তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিকদের শ্রমের দাম ও প্রবাসীদের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রা থেকে তুলা আমদানির ব্যয় নির্বাহ করা হয়।

স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত তুলা ব্যবহারের মধ্য দিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় বাড়ানোর ব্যাপারে স্পিনিং মিল মালিকদের উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সিনিয়র সহ-সভাপতি শহিদুল্লাহ আজিম। তিনি ভোরের আকাশকে বলেন, দেশে যে তুলা উৎপাদন হচ্ছে তা মানের দিক থেকে প্রায় যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদিত তুলার সমপর্যায়ের। এসব তুলা স্পিনিং মিলগুলো ব্যবহার করলে তুলা চাষিরা বেশি দাম পাবে। পাশাপাশি কৃষকরাও তুলা চাষে আগ্রহ পাবে। দেশে খাদ্য উৎপাদনকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়। তুলা উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে খাদ্যশস্য উৎপাদন কমে যেতে পারে। এর ফলে খাদ্য নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হতে পারে বলে মনে করেন খাদ্য-নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে দেশে শিল্পায়ন, নদীভাঙন ও জনবসতির কারণে প্রায় ১ শতাংশ হারে জমি কমছে। অন্যদিকে জনসংখ্যা বাড়ছে। এই ক্রমবর্ধমান মানুষের খাদ্যের চাহিদা মেটাতে প্রতি বছরই খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির প্রয়োজন হচ্ছে। এর ওপর তুলা চাষ বৃদ্ধি করতে জমির ব্যবহার হলে খাদ্য নিরাপত্তা ব্যাহত হতে পারে বলে মনে করেন তারা।

খাদ্য নিরাপত্তা কার্যক্রম ব্যাহত না করে তুলা চাষ অব্যাহত রাখতে নানামুখী কার্যক্রম চলছে। এর ফলে তুলার উৎপাদন ও বিপণন দুটোই বেড়েছে বলে জানান, তুলা উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী পরিচালক মো. আক্তারুজ্জামান। তিনি ভোরের আকাশকে বলেন, দেশে এখন প্রতি বিঘা জমিতে ২০ থেকে ২৫ মন তুলা উৎপাদন হচ্ছে। আর কৃষকরা প্রতি মন তুলা বিক্রি করে পাচ্ছেন ২৮শ টাকা। আর ১০ বছর আগেও এক বিঘা জমিতে ৮ থেকে সর্বোচ্চ ১২ মন তুলা উৎপাদন হতো। নানামুখী উদ্যোগের ফলে দেশে তুলার উৎপাদন বেড়েছে। আগে যেখানে স্থানীয় জাতের তুলা চাষ হতো, এখন প্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে একই জমিতে বেশি তুলা উৎপাদন হচ্ছে। পাশাপাশি প্রক্রিয়াকরণ ও প্রযুক্তির সমন্বয়ে উন্নতমানের তুলা উৎপাদন হচ্ছে। তুলা বীজ বপনের সময় বেশি বৃষ্টি হয়। এই বৃষ্টির কারণে তুলার চারা নষ্ট হয়ে যায়। এ কারণে তুলা চাষে বীজের পরিবর্তে চারা বপন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। প্রযুক্তির ব্যবহারেও তুলার উৎপাদন বেড়েছে। সারা দেশে তুলার গড় উৎপাদন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫ মণ। উৎপাদনের দিক থেকে ইতিবাচক রূপান্তর হয়েছে। কিন্তু তারপরও তুলা চাষের ক্ষেত্রে কৃষকের মাঝে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমে গেলে বাংলাদেশের বাজারে এর প্রভাব পড়ে, তুলার দাম কমে যায় সর্বনি¤েœ। কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর প্রভাব পড়ে তুলা চাষে। কৃষকরা নিরুৎসায়িত হয়।

তুলা চাষে কৌশলগত জমি নির্বাচন করলে খাদ্যশস্য উৎপাদন কমার সম্ভাবনা নেই বলে মনে করেন তুলা উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী পরিচালক কৃষিবিদ আক্তারুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘তুলা চাষের জন্য তিনটি বিষয় সামনে রাখা হচ্ছে। প্রথমত, শুষ্ক ও কম পানির ব্যবস্থা আছে এমন জমি। খাদ্যশস্য কম উৎপাদন হয় এমন বরেন্দ্র অঞ্চল, চরাঞ্চল ও পাহাড়ি অঞ্চল। দ্বিতীয়ত, দেশের দক্ষিণাঞ্চলের লবণাক্ত অঞ্চল। এবং তৃতীয়ত, আন্তঃফসল ব্যবস্থা, তুলা চাষের মধ্যে মুলা বা অন্য সহকারী শস্য উৎপাদন করা হচ্ছে। এজন্য বরেন্দ্র ও পার্বত্য চট্টগামে ভিন্ন ভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এর প্রভাব পড়ছে তুলার উৎপাদনে। বাড়ছে কৃষকের সচ্ছলতা। তবে তুলার দাম কমে যাওয়ার সময় প্রয়োজনে ভর্তুকি নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। দেশে তুলা উৎপাদনে কৃষকদের উৎসাহিত করতে নানামুখী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কৃষকরা যাতে তুলা উৎপাদন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিক্রি করতে পারে, পাশাপাশি তুলার মানের উন্নয়নে নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এজন্য তুরস্ক থেকে বিশেষজ্ঞ নিয়ে আসা হচ্ছে। প্রশিক্ষণের জন্য বাংলাদেশ থেকেও পাঠানো হয়েছে। যা দেশে আন্তর্জাতিক মানের তুলা চাষে সহায়তা করছে। দেশের রপ্তানিমুখী প্রধান পণ্য তৈরি পোশাকের ক্রেতা প্রাইমার্ক বাংলাদেশের তুলা চাষ ও প্রক্রিয়াকরণে সহযোগিতা দিচ্ছে। এমনকি প্রাইমার্কের সহযোগিতায় উৎপাদিত তুলা সরাসরি কিনে নিচ্ছে ক্রেতা প্রতিষ্ঠানটির বাংলাদেশে সরবারহকারী পোশাক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে ১৫ হাজার চাষি ও প্রস্তুতকারীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে আরো কৃষককে এ ধরনের কার্যক্রমের অধীনে নিয়ে আসা হবে।

মন্তব্য

Beta version