হলমার্ক, বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারিসহ বিভন্ন অনিয়মের কারণে ব্যাংক ছেড়ে পুঁজিবাজারে ঝুঁকেছেন গ্রাহকেরা। পাশাপাশি আমানতে সুদের হার কমে যাওয়ায় পুঁজিবাজারমুখী হয়েছেন অনেকে।
বর্তমানে ব্যাংকে আমানতে সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে। নিয়ম মেনে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করলে বছর শেষে এখান থেকে ব্যাংকের চেয়ে ভালো মুনাফা করা সম্ভব। বিষয়টি মাথায় রেখে পুঁজিবাজারে এলেও স্বস্তি পাচ্ছেন না গ্রাহকরা। বারবার ব্রোকারেজ হাউস থেকে অর্থ আত্মসাৎ করার ঘটনায় পুঁজির নিরাপত্তা নিয়ে দুচিন্তায় পড়েছেন তারা।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, গত দুই বছরে ব্রোকারেজ হাউস থেকে বিনিয়োগকারীদের প্রায় ৩০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন মালিক কর্তৃপক্ষ। ডুপ্লিকেট সফটওয়্যার করে তারা হাতিয়ে নিয়েছে গ্রাহক বা বিনিয়োগকারীর অর্থ। পাশাপাশি গ্রাহককে না জানিয়ে শেয়ার বিক্রি করে সে অর্থ লুটে নেওয়ার ঘটনাও ঘটিয়েছেন তারা।
এছাড়া হাউস কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে সিকিউরিটিজ আইন লঙ্ঘনসহ রয়েছে নানা অভিযোগ। এসব কারণে ব্রোকারেজ হাউসে অর্থ রেখে স্বস্তি পাচ্ছেন না বিনিয়োগকারীরা। তারা বলছেন, রক্ষক যদি ভক্ষক হয় তাহলে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগাই স্বাভাবিক।
জানতে চাইলে লুৎফর রহমান নামে একজন বিনিয়োগকারী ভোরের আকাশকে বলেন, ব্রোকারেজ হাউসে যদি টাকা বা শেয়ার রেখে নিরাপত্তা না পাই তাহলে আমরা ব্যবসা করব কীভাবে। ব্যাংকের মতো পুঁজিবাজার থেকেও অর্থ চুরির ঘটনা ঘটলে পুঁজিবাজারের প্রতিও মানুষের অনাস্থা তৈরি হবে। তাই পুঁজির নিরাপত্তার ব্যাপারে বিএসইসিসহ সংশ্লিষ্ট যারা রয়েছেন তাদের আরো বেশি সর্তক হতে হবে।
ব্রোকারেজ হাউস থেকে সর্বশেষ অর্থ চুরির ঘটনা ঘটিয়েছে তামহা সিকিউরিটিজ লিমিটেড। হাউস কর্তৃপক্ষ জালিয়াতি করে ডুপ্লিকেট সফটওয়্যারের মাধ্যমে দুই শতাধিক বিনিয়োগকারীর প্রায় শত কোটি টাকা লুটে নিয়েছে ডিএসইর সদস্য প্রতিষ্ঠানটি। ইতোমধ্যে হাউসটির লেনদেন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ফলে এসব কার্যক্রমের জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) গাফিলতিকে দায়ী করছেন ভুক্তভোগীরা।
এ বিষয়ে ভুক্তভোগী ফখরুল ইসলাম বলেন, তামহা সিকিউরিটিজের মালিক ডুপ্লিকেট সফটওয়্যার ব্যবহার করে বিনিয়োগকারীদের সব শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন। বিএসইসি ওই সিকিউরিটিজের শেয়ার লেনদেন স্থগিত করে দেওয়ার পর আমরা সিডিবিএলে যোগাযোগ করে জানতে পারি আমাদের হিসাবে কোনো শেয়ার নেই।
তামহা কর্তৃপক্ষ আমাদের দুই শতাধিক বিনিয়োগকারীর মোবাইল নম্বর পরিবর্তন করে ডুপ্লিকেট সফটওয়্যার ব্যবহার করে শেয়ার ক্রয়-বিক্রয়ের তথ্য আমাদের ফোনে এসএমএস ও মেইল পাঠাত। এ কারণে আমরা তাদের জালিয়াতি বুঝতে পারিনি। সিকিউরিটিজ হাউসটির মালিকসহ তার দুই বোন প্রায় শত কোটি টাকা লুটপাট করে নিয়েছেন।
এর আগে একই ধরনের ঘটনা ঘটান ক্রেস্ট সিকিউরিটিজ নামের একটি ব্রেকারেজ হাউস। বিনিয়োগকারীদের টাকা সরানোর পর ক্রেস্ট সিকিউরিটিজ তাদের হেড অফিসসহ সমস্ত ব্রাঞ্চ অফিস বন্ধ করে দেয়।
ভুক্তভোগীরা জানান, এ হাউস থেকে তাদের প্রায় শত কোটি টাকা সরিয়েছে কর্তৃপক্ষ। একইভাবে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সদস্যভুক্ত ব্রোকারেজ হাউস বানকো সিকিউরিটিজের বিনিয়োগকারীদের সম্মিলিত গ্রাহক অ্যাকাউন্ট থেকে ৬৬ কোটি ৫৯ লাখ ১৯ হাজার ১৩৩ টাকা সরিয়ে নেয়।
এদিকে বিনিযোগকারীদের পুঁজির নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে বিএসইসি কর্তৃপক্ষ। কোনো অনিয়ম পেলেই তারা হাউসগুলোকে সর্তক করছে।
বিষয়টি নিয়ে কথা বললে, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএসইসির একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা সারাক্ষণই বাজার মনিটরিং করে থাকি। তার মধ্যে থেকে কীভাবে এ ধরনের ঘটনা ঘটে তা আমার জানা নেই। বিচ্ছিন্ন সব ঘটনা যেন আর না ঘটে সে বিষয়ে আমরা আরো বেশি সতর্ক।’
অন্যদিকে সিকিরিউটিজ আইন লঙ্ঘন করার দায়ে গত দুই বছরে রূপালী ব্যাংক সিকিউরিটিজ লিমিটেড, এএইচসি সিকিউরিটিজ লিমিটেড, ব্র্যাক ইপিএল স্টক ব্রোকারেজ লিমিটেড, এএনএফ ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড, গেটওয়ে ইক্যুইটি রিসোর্স লিমিটেড, ইউনিক্যাপ সিকিউরিটিজ লিমিটেড, তামহা সিকিউরিটিজ লিমিটেড, মেঘনা লাইফ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড, এমিনেন্ট সিকিউরিটিজ লিমিটেড, এনআরবিসি ব্যাংক সিকিউরিটিজ লিমিটেড, ব্যাংক এশিয়া সিকিউরিটিজ লিমিটেড এবং ডিএলআইসি সিকিউরিটিজ লিমিটেড, বিডি ফাইন্যান্স সিকিউরিটিজ লিমিটেডসহ প্রায় ৫০টি হাউসকে সর্তক করেছে বিএসইসি।
বিষয়টি নিয়ে কথা বললে বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক ভোরের আকাশকে বলেন, ‘অর্থ চুরির বিষয়ে আমি ডিএসইর দায়িত্বহীনতাকে দায়ী করব। তারা যদি সঠিকভাবে বাজারের তদারকি করত। তাহলে এমন ঘটনা ঘটত না। আমরা বিনিয়োগকারীদের পুঁজির নিরাপত্তা চাই। পাশাপাশি কর্তৃপক্ষকে বলব, যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের টাকা ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা করুন।’
মন্তব্য