করোনা মহামারিতে যখন অর্থনীতি একটু একটুু ঘুরে দাঁড়াচ্ছে, তখন নতুন বিপদ এসে জেঁকে বসল ইউক্রেনে রুশ হামলার ফলে উদ্ভুত রপ্তানি বাণিজ্যের অনিশ্চয়তা। অর্র্থনীতিবিদরা বলছেন, এর ফল হতে পারে সুদূর প্রসারি। বাধাগ্রস্ত হতে পারে করোনা পরবর্তী পুনর্গঠন কার্যক্রম।
দেশের রপ্তানির ৬০ ভাগ হয়ে থাকে ইউরোপিয় (ইইউ) ইউনিয়নের দেশগুলোতে। এসব দেশে রপ্তানির বড় সুবিধা হলো বাংলাদেশ ওইসব দেশে কোটা সুবিধা পেয়ে থাকে। ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার ফলে রপ্তানির ঝুঁকি তৈরি হতে পারে বলে বলছেন দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সিনিয়র সহ-সভাপতি শহিদুল্লাহ আজিম।
তিনি ভোরের আকাশকে বলেন, ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার ফলে আমরা যেসব পণ্য রপ্তানি করে থাকি তা পরিবহণের সমস্যা হবে, পরিবহণ খরচ বেড়ে যাবে। করোনার ফলে এমনিতেই পণ্য পরিবহণের ক্ষেত্রে জাহাজিকরণে কিছুটা সমস্যা হচ্ছিল, এই যুদ্ধ আরো প্রলম্বিত হলে সমস্যা আরো প্রকট হবে। একইভাবে প্রভাব পড়বে কাঁচামাল আমদানির ফলে।
করোনাকালে বিশ্বজুড়ে মূল্যস্ফীতির ঝুঁকিতে আছে। এ ঝুঁকিতে বাংলাদেশও। রাশিয়ার ইউক্রেনে হামলার পর বাংলাদেশের ‘বোঝার ওপর শাকের অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে’। এই যুদ্ধ আরো প্রলম্বিত হলে সমস্যা বহন করার মতো সক্ষমতা থাকবে না। আমদানি রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে তা নিরূপণে শিঘ্রই বিজিএমইএ বসবে বলে জানান এই উদ্যোক্তা নেতা।
ইউক্রেনে বাংলাদেশের সরাসরি রপ্তানি বেশি নয়। চলতি অর্থবছরে জুলাই-জানুয়ারি সাতমাসে মাত্র ৭,৫০০ ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। দেশটি থেকে কৃষিপণ্য ও সরঞ্জাম আমদানি হয়ে থাকে।
রাশিয়াতেও বাণিজ্য বড় না হলেও সম্প্রতি দেশের অবকাঠামো খাতে বড় অংশিদারে পরিনত হয়েছে। সেইসাথে দেশটিতে তৈরি পোশাকের নতুন বাজার নির্ভরযোগ্য দেশ হতে যাচ্ছিল। দেশ দুটির মধ্যে যুদ্ধের ফলে প্রত্যক্ষ প্রভাব বেশি না পড়লেও দেশ দুটি পরোক্ষ প্রবল ঝুকির সৃষ্টি করবে।
রাশিয়া বড় জ্বালানি, গ্যাস, গম ও ভৈাজ্যতেল রপ্তানিকারক দেশ। বাংলাদেশ এসব পণ্য আমদানিকারক দেশ। ইউক্রেনও গম ও ভোজ্যতেল রপ্তানিকারক দেশ। রাশিয়ায় গম উৎপাদন কমে গেলে দরিদ্র দেশগুলাতে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যায়। এসব পণ্যের দাম বেড়ে গেলে মিশর ও মধ্যপ্রাচ্যের রুটির দাম বেড়ে যায়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বাংলাদেশে খাদ্যপণ্য, জ্বালানি ও ভোজ্যতেল বাড়তি দামে কিনতে হবে।
বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন ভোরের আকাশকে বলেন, রাশিয়ার ইউক্রেনে হামলার ফলে ইউরোপিয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্ররা রাশিয়ার ওপর বড় যে অবরোধ জারি করেছে বাংলাদেশে তার প্রভাবও হবে সুদূর প্রসারী। তিন মূদ্রা-ইউরো, ডলার ও ইয়েনে রাশিয়ার মূদ্রা রুবল ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারবে না। এই তিন মূদ্রার অধীনে দেশগুলোর জিডিপির পরিমাণ বৈশ্বিক জিডিপির ৬০ ভাগের ওপরে। রাশিয়ার যে সংকট তা গড়াবে এসব মূদ্রাতেও। এর পরোক্ষ প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে।
দ্বিতীয়ত ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা থেমে গেলেও এর ফল অব্যাহত থাকবে। তৃতীয়ত মূল্যস্ফীতি। রাশিয়া থেকে বিদ্যুৎ, গ্যাস, ভোজ্যতেল ও খাদ্যের মতো পণ্য রপ্তানি ব্যাহত হলে বৈশ্বিক খাদ্য ও জ্বালানির দাম বেড়ে যাবে। করোনা পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার কার্যক্রম বেড়ে যাওয়ার কারণে জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে। ধারণা করা হচ্ছিল, দ্রুত এই তেলের দাম কমে যাবে। রাশিয়ার ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরু হওয়ার পর এই দাম কমে যাওয়ার বিষয়টি আর হাতের নাগালের মধ্যে থাকবে না। ফলে মূল্যস্ফীতি তাড়াতাড়ি কমার সম্ভাবনা আর থাকল না।
ডলার, ইয়েন ও ইউরোর সঙ্গে রুবলের যোগাযোগ বন্ধ হওয়ার কারণে রাশিয়ার রুবলের সাথে এলসি (ঋণপত্র) খুলতে পারবে না বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। এর ফলে রাশিয়ায় রপ্তানি যেমন ব্যাহত হবে, সমস্যা হবে আমদানিতেও। সমস্যায় পড়তে হবে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজেও। রাশিয়া থেকে যে ঋণ পাচ্ছিল তার পুরোপুরি পায়নি বাংলাদেশ। পণ্য ও সেবার বাইরে অর্থ হিসাবে যে ঋণ পাচ্ছিল এবং এখনো যে ঋণ বাকি আছে তা ব্যাহত হবে। এ ঋণ পেতে হলে বাংলাদেশের সরকারকে নতুন করে যোগাযোগ করতে হবে, খুঁজতে হবে নতুন বিকল্প।
মন্তব্য