-->
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ

হুমকির মুখে দেশের আমদানি রপ্তানি বাণিজ্য

রুবেল খান, চট্টগ্রাম
হুমকির মুখে দেশের আমদানি রপ্তানি বাণিজ্য
যুদ্ধে বিধ্বস্ত একটি বহুতল ভবন। ছবি-সংগৃহীত

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে বড় ধরনের হুমকির মুখে পড়তে যাচ্ছে দেশের আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্য। দেশের গমের চাহিদার এক তৃতীয়াংশের জোগান আসে রাশিয়া এবং ইউক্রেন থেকে। সেইসঙ্গে ভুট্টার চাহিদার ২০ শতাংশের জোগান দেয় ওই দুটি দেশ। গত অর্থবছরে শুধু রাশিয়া থেকেই আমদানি হয়েছে ৪৬ কোটি ৬৭ লাখ ডলারের পণ্য। এর বেশির ভাগই হচ্ছে গম ও ভুট্টা।

এদিকে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের নতুন একটি বাজার তৈরি হয়েছে রাশিয়ায়। গত অর্থবছরে রাশিয়ায় ৬৬ কোটি ৫৩ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এর বেশির ভাগই তৈরি পোশাক। এছাড়াও প্লাস্টিক, চামড়া, জুতা, সিরামিক, খেলনা, ম্যাট্রেস, হিমায়িত খাদ্য ও পাট রপ্তানি হয় রাশিয়ায়। আর ইউক্রেনে পোশাকের বাইরে ওষুধ, প্লাস্টিক, জুতা, ম্যাট্রেস, খেলনাসহ বিভিন্ন পণ্য যায়।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, গত ২০২০-২১ অর্থবছরে ৩ হাজার ১৪৫ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। তারমধ্যে রাশিয়ায় রপ্তানি হয়েছে ৫৯ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক, দেশীয় মুদ্রায় যা ৫ হাজার ৭৪ কোটি টাকার সমান। অন্যদিকে ইউক্রেনে রপ্তানি হয়েছে ১ কোটি ১৭ লাখ ডলারের তৈরি পোশাক, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ১০০ কোটি টাকা।

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে ইতোমধ্যেই নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে। এর মধ্যে রাশিয়ার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা সুইফট থেকে রাশিয়ার ব্যাংকগুলোকে বিচ্ছিন্ন করার উদ্যোগ নেওয়ায় বাংলাদেশ বড় সংকটে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। কারণ রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক লেনদেনের পুরোটাই পশ্চিমা দেশ নিয়ন্ত্রিত সুইফট (সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টারব্যাংক ফাইন্যান্সিয়াল টেলিকম্যুনিকেশন) দ্বারা পরিচালিত হয়।

প্রসঙ্গত, সুইফটের কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৭৩ সালে। এটির প্রধান কার্যালয় বেলজিয়ামে। বিশ্বের ১১ হাজার ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে লেনদেনের বিষয়ে ম্যাসেজ আদান প্রদানের মাধ্যমে সুইফট কাজ করে। বিশ্বের অধিকাংশ ব্যাংকই নিজেদের মধ্যকার ম্যাসেজ আদান প্রদানে সুইফট নেটওয়ার্কের মাধ্যমে কাজ করে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের সঙ্গে রাশিয়া ও ইউক্রেনের ব্যবসা বাণিজ্য বহুদিনের। হাজার হাজার কোটি ডলারের পণ্যসামগ্রী রাশিয়া থেকে আমদানি করা হয়। আবার তৈরি পোশাকসহ বিপুল পরিমাণ অর্থের পণ্য রপ্তানিও করা হয়। রাশিয়া-বাংলাদেশ আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের লেনদেন সরাসরি রাশিয়ার কোনো ব্যাংকের মাধ্যমে হয় না। ইউরোপের বিভিন্ন ব্যাংকের মাধ্যমে এসব লেনদেন হয়ে থাকে। বিশেষ করে সুইফটের মাধ্যমে এই অর্থ আদান প্রদান হয়ে থাকে।

কিন্তু ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করার ঘোষণা দিয়েছে। ইতোমধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আমেরিকা এবং পশ্চিমা মিত্র দেশগুলো ঐক্যমতে পৌঁছে রাশিয়ার বেশ কয়েকটি ব্যাংককে সুইফটের কার্যক্রম থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। ১২ মার্চ থেকে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হচ্ছে। বিশ্বের আর্থিক লেনদেনের জন্য সর্বাধিক নিরাপদ নেটওয়ার্ক হিসেবে স্বীকৃত সুইফট থেকে রাশিয়ার ব্যাংকগুলোকে বিচ্ছিন্ন করা হলে বাংলাদেশের আমদানি এবং রপ্তানি বাণিজ্যের লেনদেন পুরোপুরি মুখ থুবড়ে পড়বে।

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম চেম্বার প্রেসিডেন্ট মাহবুবুল আলম বলেন, ‘সুইফট নিয়ে বড় সংকটে পড়েছে দেশের ব্যবসায়ীরা। রাশিয়া থেকে পণ্য আনা-নেওয়া বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। আর্থিক লেনদেনের অনিশ্চয়তার মাঝে কবে নাগাদ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে তাও অনিশ্চিত। শেষ পর্যন্ত সুইফট থেকে রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হলে বাংলাদেশের ব্যবসা বাণিজ্য বড় ধরনের সংকটে পড়বে।’

এদিকে বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারির প্রভাবে এমনিতেই দীর্ঘদিন ধরে জাহাজ ভাড়া উত্তাপ ছড়াচ্ছে। তার ওপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে। ফলে জাহাজ ভাড়া আরো বেশি বাড়ার আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা। যুদ্ধ স্থায়ী হলে ইউরোপজুড়ে একটা অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি হবে। ফলে কার্যাদেশ বাতিল হওয়ার আশঙ্কা করছেন পোশাক ব্যবসায়ীরা।

বিজিএমইএর সহ-সভাপতি রাকিবুল আলম চৌধুরী বলেন, ‘বিদেশে পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে স্বাভাবিক সময়ে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার ডলার খরচ পড়ত। সেখানে বড় মাদার ভেসেলগুলোতে পণ্য পরিবহণে ১৬ থেকে ১৮ হাজার ডলার খরচ পড়ছে। তবুও কার্যাদেশ বাড়ায় আমরা আমাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। করোনার কারণে আমরা মারাত্মকভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি।

বিপুল পরিমাণে কার্যাদেশ হারিয়েছিলাম। গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে আমাদের প্রচুর কার্যাদেশ এসেছে। ব্যবসা-বাণিজ্যের চাকা গতিশীল হয়ে আমরা ভিয়েতনামকে প্রতিযোগিতায় পেছনে ফেলে দ্বিতীয় স্থান দখল করে নিয়েছি। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যে এখনো নেতিবাচক প্রভাব না ফেললেও আমরা শঙ্কিত হয়ে আছি।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমেরিকার পাশাপাশি ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আমাদের পোশাক যায়। কিন্তু যুদ্ধ স্থায়ী হলে আমরা ব্যবসায়ীরা আবারো ক্ষতিগ্রস্ত হব। জাহাজ ভাড়া বাড়বে, রাশিয়াসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে কার্যাদেশ কমে যাবে। তখন আমরা আবারো বিপাকে পড়ে যাব। বায়ারদের সঙ্গে কথা হচ্ছে। তারাও পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন।’

বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশন পরিচালক খায়রুল আলম সুজন বলেন, ‘করোনার কারণে আগের বাড়তি জাহাজ ভাড়াটাই এখন স্বাভাবিক দরে পরিণত হয়েছে। এর মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ স্থায়ী হলে কিন্তু আবারো জাহাজ ভাড়া বাড়বে। ইউরোপের বাজার অস্থিতিশীল হবে। আমাদের তৈরি পোশাক রাশিয়াতেও যায়, আবার আমাদের দেশেও ইউক্রেন থেকে বিভিন্ন পণ্য আমদানি হয়। এখানেও কিন্তু বড় ধরনের প্রভাব পড়তে পারে।’

মন্তব্য

Beta version