ব্যাংক নয় এমন আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সুদ নির্ধারণে হযবরল অবস্থা তৈরি হয়েছে। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান ইচ্ছামতো সুদ হার নির্ধারণ করছে। কোনো প্রতিষ্ঠান বেশি সুদ নিচ্ছে। কোনো প্রতিষ্ঠান আমানতের চেয়ে কম সুদ নিচ্ছে। সুদ নির্ধারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা থাকলেও তা মানছে না। ফলে একদিকে প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা হারাচ্ছে, গ্রাহক স্বার্থ বিঘ্নিত হচ্ছে। অন্যদিকে নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানে অনিশ্চয়তা তৈরি হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চারটি নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান আমানত সংগ্রহে দেওয়া সুদ হারের চেয়ে কম সুদ হারে ঋণ বিতরণ করছে। অন্যদিকে ৬ প্রতিষ্ঠান ঋণ বিতরণে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ সুদে বিতরণ করছে, যা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ঝুঁকি তৈরি করছে। আমানতের সুদ হারের চেয়ে বিতরণে সুদ হার বেশি, এটা সম্ভব নয় বলে মনে করেন পিআরইউর নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ এস মনসুর।
তিনি বলেন, ‘আমানতের চেয়ে বিতরণের সুদ হার কম, উদ্যোক্তারা নিজেরাই ঋণ নেওয়ার কৌশল হিসেবে এটা করতে পারে। নিজেদের সুবিধার জন্য এটা করতে পারে। আমানতের সুদ হারের চেয়ে বিতরণে সুদ কম, এটা বাস্তবে কোনোভাবেই সম্ভব নয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা চাইতে পারে।
অবসায়নের প্রক্রিয়ায় থাকা পিপলস লিজিংসহ বেশ কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান এখন আলোচনায়। প্রতিষ্ঠান আছে, ব্যবস্থাপনা আছে। আছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু তারপরও দুর্বৃত্তরা বিপুল পরিমাণ লুটপাট করেছে। এসব লুটপাটের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের নামও এসেছে। আমানতকারীরা সর্বস্ব হারিয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরছে, আদালতকে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে। তারপরও পুরোপুরি টাকা ফেরত পাচ্ছে না। এরই মধ্যে খোদ বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে আমানতের চেয়ে বিতরণে সুদ হার কম। গ্রাহকরা প্রশ্ন তুলেছে তাহলে এ টাকা আসছে কোথায় থেকে? তাহলে কি আবার গ্রাহকের টাকা লুটপাট হচ্ছে?
টিকে থাকার জন্য নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এটা করতে পারে বলে মনে করেন রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত। তবে টিকে থাকার জন্য এটা যথেষ্ট নয় বলে মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, কোন ঋণ কম সুদে বিতরণ করছে, কোনটি বেশি সুদে বিতরণ করছে। এ কারণে এটা হতে পারে। গড়ে হয়তো ঋণাত্মক সুদ হার হচ্ছে। এভাবে কোনো প্রতিষ্ঠান বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব নয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে ২৯টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আমানত সংগ্রহের গড় হার ৭ দশমিক ৫৫ শতাংশ তুলে ধরা হয়। বিতরণ ১০ দশমিক ৫৯ শতাংশ। গড় সুদ হার তুলে ধরা হয়েছে ৩ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। এর মধ্যে চারটি প্রতিষ্ঠান আমানত সংগ্রহে আমানতের চেয়ে বিতরণের সুদ হার বেশি। এসব প্রতিষ্ঠানগুলো হলো উত্তরা ফাইনান্স অ্যান্ড ইনভেস্ট লিমিটেড, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইনান্স কোম্পানি লিমিটেড, ফার্স্ট ফাইনান্স অ্যান্ড ইনভেস্ট লিমিটেড এবং এফএএস ফাইনান্স লিমিটেড।
তথ্য অনুযায়ী, উত্তরা ফাইনান্সের আমানত সংগ্রহ করে ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ আর বিতরণ করে ৯ দশমিক ৩১ শতাংশ হারে। ঋণাত্মক সুদ হার দশমিক ৩৮ শতাংশ। বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইনান্স কোম্পানি লিমিটেড আমানত সংগ্রহ করে ৮ দশমিক ২৮ শতাংশ। বিতরণ করে দশমিক ৭১ শতাংশ। প্রতিষ্ঠানটির লোকসান দেয় ৭ দশমিক ৫৭ শতাংশ। ফার্স্ট ফাইনান্স আমানত সংগ্রহ করে ৯ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ হারে বিতরণ করে ৫ দশমিক ২৮ শতাংশ হারে। প্রতিষ্ঠানটি লোকসান গুণে ৩ দশমিক ৭৬ শতাংশ। এফএএস ফাইনান্স ব্যাংক সংগ্রহ করে ইনভেস্টমেন্ট আমানত সংগ্রহ করে ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ হারে আমানত সংগ্রহ করে বিতরণ করে ১ দশমিক ১২ শতাংশ হারে। ব্যাংকটি লোকশান করে ৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ হারে।
অন্যদিকে, মাইডাস ফাইনান্স লিমিটেড প্রাইম ফাইনান্স আমানত সংগ্রহ ও বিতরণ হার প্রায় একই। প্রতিষ্ঠান দুটির স্প্রেড হার (আমানত সংগ্রহ ও বিতরণ হারের মধ্যে পার্থক্য) ১ শতাংশের নিচে। আর্থিক প্রতিষ্ঠান দুটির আমানত সংগ্রহ করে ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ হারে আর বিতরণ করে ৯ দশমিক ৯৮ শতাংশ হারে।
উল্টো তথ্যও আছে। বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান সর্বোচ্চ সুদ হার নিচ্ছে। গ্রাহকদের ওপরও চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে সর্বোচ্চ সুদ হার। নিয়ন্ত্রক সংস্থা কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সুদ হার বেঁধে দেওয়া হলেও নির্দেশনা মানছে না এসব প্রতিষ্ঠান। পাঁচ ও তদূর্ধ্ব সুদ হার নিচ্ছে।
তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ফিনিক্স গ্রাহকের কাছে থেকে ১৫ দশমিক ২৪ শতাংশ সুদ নিচ্ছে আর ৯ দশমিক ৮২ ভাগ হারে আমানত সংগ্রহ করে। স্প্রেইড হার ৫ দশমিক ৪২ শতাংশ। বে-লিজিং অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট স্প্রেইড হার ৪ দশমিক ৭৮ ভাগ। আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি ৭ দশমিক ৩২ শতাংশ সুদে আমানত সংগ্রহ করে বিতরণ করছে ১২ দশমিক ১০ শতাংশ দামে। ইউনিয়ন ক্যাপিটাল আমানত সংগ্রহ করছে ৮ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ সুদে, আর বিতরণ করছে ১৩ দশমিক ২৫ শতাংশ সুদে।
এছাড়াও ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইনান্স সার্ভিস আমানত সংগ্রহ করছে ৯ দশমিক ৪৫ শতাংশ রেটে, বিতরণ করছে ১৩ দশমিক ৫২ শতাংশে; স্প্রেইড ৫ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশে। ইসলামিক ফাইনান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট স্প্রেইড হার ৫ দশমিক ৭৮ ভাগ। বাংলাদেশ ফাইনান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট আমানত সংগ্রহ করছে ৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ দামে, বিতরণ করছে ১২ দশমিক ৭১ শতাংশ সুদে। এবং স্প্রেইড হার ৪ দশমিক ৯৯ শতাংশ ভাগ।
মন্তব্য