দেশের নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষ করোনা পরবর্তী পরিবেশে ভীষণ সংকটময় সময় পার করলেও ধনীদের আরো ধনী হওয়ার সুযোগ তৈরি হচ্ছে দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থায়। ঋণ গ্রহণের পর তা পরিশোধে কঠোর আইন না থাকা ও বিদ্যমান আইন প্রয়োগে কঠোর নজরদারি না থাকাসহ নানা ধরনের সম্পর্ক ও যোগসাজশে ঋণ নিয়ে ঋণ ফেরত দিচ্ছে না ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলো। বরং দীর্ঘদিনের অপরিশোধিত কোটি কোটি টাকার ঋণ বিশেষ ব্যবস্থায় অবলোপন বা মুছে দেওয়া হচ্ছে ব্যাংকগুলোর খাতা থেকে। এমনকি ঋণের সুদ মওকুফ হচ্ছে হরহামেশাই। গত চার বছরে এভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যালেন্স শিট থেকে মুছে দেওয়া হয়েছে ৯ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ। এই চার বছরে বিভিন্ন ব্যবসায়ী ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণের সুদ মওকুফ করা হয়েছে ৭০০০ কোটি টাকার। এমনকি গত ২০২১ সালে যে পরিমাণ খেলাপি ঋণ অবলোপন করা হয়েছে তা এর আগের বছরের তুলনায় আড়াই গুণ বেশি। যদিও পুরো প্রক্রিয়াটিকে ‘ স্বাভাবিক প্রক্রিয়া’ বলছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
ঋণ অবলোপন হলো মন্দমানের খেলাপি ঋণের একটি অংশ, যা দৃশ্যমান খেলাপি ঋণ থেকে ভিন্ন করে রাখা হয় এবং মন্দমানের খেলাপি ঋণের মতো শতভাগ প্রভিশন বা সঞ্চিতি রাখতে হয়। এ সঞ্চিতি মুনাফা থেকে বিতরণ না করে সংরক্ষণ করতে হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ২০২১ সালে অবলোপনের মাধ্যমে ব্যাংকের ব্যালেন্স শিট থেকে ২ হাজার ৪৪১ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ বাদ দেওয়া হয়েছে। এর আগের বছরের তুলনায় যা আড়াই গুণ বেশি। ২০২০ সালে অবলোপন করা হয় ৯৭১ কোটি টাকা।
* চার বছরে অবলোপন ৯৩৭৬ কোটি টাকা
* সুদ মওকুফ ৭০০০ কোটি টাকার
২০১৯ সালে কাগজে-কলমে খেলাপি ঋণ বাদ দিতে অবলোপন করা হয়েছিল ২ হাজার ৫৯৭ কোটি টাকা। ২০১৮ সালে এর পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে গত চার বছরে ব্যাংকগুলো অবলোপনের মাধ্যমে ৯ হাজার ৩৭৭ কোটি টাকার মন্দ ঋণ ব্যালেন্স শিট থেকে বাদ দিয়েছে। ২০২১ সালে অবলোপনের মাধ্যমে ব্যাংকের ব্যালেন্স শিট থেকে ২ হাজার ৪৪১ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ বাদ দেওয়া হয়েছে। ২০২০ সালে অবলোপন করা হয় ৯৭১ কোটি টাকা। ২০১৯ সালে ২ হাজার ৫৯৭ কোটি টাকা। আর ২০১৮ সালে ৩ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে গত চার বছরে ব্যাংকগুলো অবলোপনের মাধ্যমে ৯ হাজার ৩৭৭ কোটি টাকার মন্দ ঋণ ব্যালেন্স শিট থেকে বাদ দিয়েছে।
বিভিন্ন মহলে সমালোচনা করা হচ্ছে, খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে ঢালাও সুবিধা দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মহামারি করোনার কারণে গত দুই বছরে ঋণ পরিশোধে ছিল বিশেষ ছাড়। ঋণের কিস্তি না দেওয়া হলেও খেলাপি হবে না। দেওয়া হয়েছে প্রণোদনা। তারপরও খেলাপি ঋণ কমছে না। এ কারণে কাগজে-কলমে খেলাপি আড়াল করতে ব্যাংকগুলো ‘ঋণ অবলোপন’ বা ‘রাইট অব’ কৌশল বেছে নিয়েছে। একইসঙ্গে গণহারে খেলাপি ঋণের সুদও মওকুফ করছে ব্যাংকগুলো।
“ ২০২১ সালে অবলোপনের মাধ্যমে ব্যাংকের ব্যালেন্স শিট
থেকে ২ হাজার ৪৪১ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ বাদ
দেওয়া হয়েছে। এর আগের বছরের তুলনায়
যা আড়াই গুণ বেশি।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, একই সময়ে অবলোপনের সঙ্গে খেলাপি ঋণের সুদ মওকুফও কম করা হয়নি। গত চার বছরে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকার সুদ মওকুফ করা হয়েছে। এর মধ্যে গত বছর (২০২১ সাল) ঋণের সুদ মওকুফ হয়েছে ১ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকার। ২০২০ সালে ১ হাজার ৫৭৮ কোটি টাকার। ২০১৯ সালে সুদ মওকুফ হয়েছে ২ হাজার ২৯৩ কোটি টাকার এবং ২০১৮ সালে ১ হাজার ১৯৮ কোটি টাকার। সব মিলিয়ে গত চার বছরে ৬ হাজার ৯২৪ কোটি টাকার সুদ মওকুফ করেছে ব্যাংকগুলো।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশই একমাত্র দেশ, যেখানে গণহারে অবলোপন করা হয়। একইসঙ্গে করা হয় সুদ মওকুফ, যা অর্থনীতির জন্য সুসংবাদ নয়। এটি আর্থিক খাতের সুশাসনের ঘাটতির একটি লক্ষণ। অবলোপন খেলাপিরই একটি নতুন রূপ বলে মনে করেন বিশ্ব ব্যাংকের অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, ‘ঋণ অবলোপন হলো খেলাপিরই একটি পরিণতি। যতক্ষণ খেলাপি বন্ধ না হবে, ততক্ষণ ঋণ অবলোপন চলতে থাকবে। ব্যাংক কখনো ব্যালেন্স শিট অপরিষ্কার রাখবে না-এটাই স্বাভাবিক। আগে গোড়ায় হাত দিতে হবে। ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি কীভাবে বন্ধ করা যায়, সেদিকে নজর দিতে হবে। ঋণ আদায় বাড়াতে হবে। তা না হলে এসব বন্ধ হবে না।
মন্তব্য