শেয়ারবাজারে বেঁধে দেওয়া সীমার বেশি বিনিয়োগ করাতে বাংলাদেশ ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে। এরপর থেকে সতর্ক হয়ে গেছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। কিন্তু এ নিয়ে চলছে মিশ্র আলোচনা। চলছে রশি টানাটানি। শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংকের বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেলে বাজারে চাঙ্গাভাব বজায় থাকবে। শেয়ারবাজারে আস্থার জায়গা তৈরি হবে। অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, শেয়ারবাজার ব্যাংকের প্রধান বিনিয়োগের স্থান নয়। ব্যাংকের প্রধান কাজ হলো আমানত সংগ্রহ করে তা উৎপাদনসংশ্লিষ্ট কাজে বিনিয়োগ করা।
২০১০ সালের ধসের পর ২০২১ সালে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল দেশের শেয়ারবাজার। শুধু ঘুরে দাঁড়ানো নয়, শেয়ারবাজারে উত্থানের পাশাপাশি একাধিক রেকর্ডও হয়েছিল। বাজারের মূলধন ও মূল্যসূচক নতুন উচ্চতায় পৌঁছে গিয়েছিল। প্রধান মূল্যসূচক ৭ হাজার পয়েন্ট ছাড়িয়েছিল, যা ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এদিকে ব্যক্তি বিনিয়োগকারীর পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগও বেড়েছিল। ২০১০ সালের মতো কোনো ব্যাংক যাতে বিপদে না পড়ে, সে জন্য শেয়ারবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ খতিয়ে দেখা শুরু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
একই সময় শেয়ারবাজারে নির্ধারিত সীমার বেশি বিনিয়োগ করায় বেসরকারি খাতের এনআরবি কমার্শিয়াল (এনআরবিসি) ব্যাংককে ২৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ব্যাংক কোম্পানি আইন লঙ্ঘন করে অতিরিক্ত বিনিয়োগ করায় ব্যাংকটিকে জরিমানা করা হয়েছে। গত বছরের জুলাই মাসে এনআরবিসি ব্যাংকের বিনিয়োগ উঠেছিল ২৭ দশমিক ৩৩ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংক গত বছরের আগস্ট মাসে ব্যাংকটিকে চিঠি দিয়ে জানায়, তারা সীমা লঙ্ঘন করে বিনিয়োগ করেছে। এ জন্য কেন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, সেই ব্যাখ্যা চেয়ে সীমার অতিরিক্ত বিনিয়োগ নির্ধারিত সীমায় নামিয়ে আনতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে শেয়ারবাজারে বিশেষ তহবিলের টাকা নির্দেশনা লঙ্ঘন করে অন্য শেয়ারে বিনিয়োগ করায় আরো ১২ ব্যাংককে সতর্ক করা হয়। এর পর থেকেই শেয়ারবাজারসংশ্লিষ্টদের মাঝে ছড়ানোর চেষ্টা করা হয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপের কারণে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে পিছুপা হচ্ছে, ক্ষেত্রবিশেষে সরে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগে হস্তক্ষেপ না করলে বাজারে চাঙ্গাভাব বজায় অব্যাহত রাখা যেত।
বাংলাদেশ ব্যাংক এ ধরনের আলোচনার জবাব দিয়েছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলামের প্রশ্নÑ ব্যাংকের কাজ কি, ব্যাংক জনগণের সঞ্চয় নিচ্ছে কী শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করার জন্য? তিনি ভোরের আকাশকে বলেন, আইনে বলা আছেÑ একটি ব্যাংক শেয়ারবাজারে কত টাকা বিনিয়োগ করতে পারবে। সীমার বেশি বিনিয়োগ করেছিল একটি ব্যাংক। প্রথমে তাদের কাছ থেকে জবাব চাওয়া হয়েছিল। তাদের জবাব সন্তোষজনক না হওয়ায় জরিমানা করা হয়েছে। সীমার বেশি যাতে বিনিয়োগ না করে, সে জন্য অন্য ব্যাংকগুলোকেও বলা হয়েছে।
ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী- শেয়ারবাজারে কোনো ব্যাংকের বিনিয়োগ ওই ব্যাংকের আদায়কৃত মূলধন, শেয়ার প্রিমিয়াম, সংবিধিবদ্ধ সঞ্চিতি ও রিটেইন আর্নিংসের ২৫ শতাংশের বেশি হতে পারবে না।
জানা গেছে, ২৫ শতাংশ পর্যন্ত লেনদেন করার সুযোগ থাকলেও গত বছরের দ্বিতীয়ার্ধে ব্যাংক খাতের গড় বিনিয়োগ তা ছাড়িয়ে যায়। শেয়ারবাজার গতিশীল রাখতে ব্যাংকগুলোকে এই সীমার বাইরে ২০০ কোটি টাকা পর্যন্ত তহবিল গঠন করে বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। সেখানে ২৯ ব্যাংক মিলে ৪ হাজার ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছিল। এ ছাড়া ১২টি ব্যাংক নির্ধারিত শেয়ারের বাইরে বিনিয়োগ করেছে। এ জন্য সেই ব্যাংকগুলোকে সতর্ক করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি এসব ব্যাংকের সার্বিক বিনিয়োগচিত্র খতিয়ে দেখেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
অভিযোগ আছে, সরকারি প্রণোদনার ঋণের একটি অংশও পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ হয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৫ জুলাই থেকে নড়েচড়ে বসে বাংলাদেশ ব্যাংক। করোনার প্রভাব মোকাবিলায় সরকারি প্রণোদনার কম সুদের ঋণের একটি অংশ পুঁজিবাজারসহ বিভিন্ন অনুৎপাদনশীল খাতে চলে যাওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করে ওইদিন সব ব্যাংককে চিঠি দিয়ে সতর্ক করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ ছাড়া প্রণোদনার আওতায় ঋণের ব্যবহারসহ বিভিন্ন তথ্য চেয়ে পরে আরো একটি চিঠি দেয়। একই সঙ্গে ঋণের সঠিক ব্যবহার যাচাইয়ের জন্য মাঠপর্যায়ে পরিদর্শনের সিদ্ধান্তও নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। পরে তারল্য সরবরাহ কমাতে ব্যাংকে থাকা অলস অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংক বিলের মাধ্যমে তুলে নিতে শুরু করে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, আমানত সংগ্রহ করবে আবার ঋণ দেবে, এটা ব্যাংকের কাজ। একই সময়ে ব্যাংকগুলোর কিছু নিজস্ব বিনিয়োগ আছে। এই বিনিয়োগের ব্যাপারেও বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি নির্দেশনা আছে। বিনিয়োগের যে অংশটি শেয়ারবাজারে করার নির্দেশনা আছে, সেটাই তারা বিনিয়োগ করতে পারবে। তারা ইচ্ছামতো বিনিয়োগ করতে পারবে না। একইভাবে তারা ইচ্ছামতো ঋণও বিতরণ করতে পারে না। এ ব্যাপারেও স্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া আছে। আমানতের কত অংশ বিনিয়োগ করতে পারবে, সে ব্যাপারে নির্দেশনা দেওয়া আছে। নির্দেশনা দেওয়া আছে ঋণ ও এগ্রিমে, কত শতাংশ বাংলাদেশ ব্যাংকের সিকিউরটিতে বিনিয়োগ করতে পারবে, এ ব্যাপারে স্পষ্ট বিধান আছে। এ বিধান অনুযায়ীই চলতে হবে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে। বিধানের বাইরে গেলেই বাংলাদেশ ব্যাংক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।
বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনামতো চলছে। ধরুন, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো যদি শেয়ারবাজারে বেশি বিনিয়োগ করে তা হলে তো জনগণ যাদের ঋণের প্রয়োজন তারা তো ঋণ পাবে না। এসব বিষয় মাথায় রেখে, জনগণের আমানতের কথা বিবেচনা করে এবং মানুষের ঋণের প্রয়োজনের কথা বিবেচনা করে ঋণ বিতরণে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা দেওয়া আছে এবং সেভাবেই চলছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেমন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর নিয়ন্ত্রক সংস্থা; আবার একই সঙ্গে শেয়ারবাজারেরও নিয়ন্ত্রক সংস্থা। এক্ষেত্রে জনগণের স্বার্থ নিশ্চিত করে আর্থিক ব্যবস্থাকে স্থিতিশীল রাখাই প্রধান কাজ। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, সে কাজটিই করছে তারা। অন্যদিকে শেয়ারবাজারও একই কথা বলছে। তবে পার্থক্য শুধু হিসাবের। শেয়ারবাজারের বক্তব্য হলো, ব্যাংকগুলো তাদের ২৫ শতাংশ বিনিয়োগ করুক, তবে তা হতে হবে শেয়ারের কস্ট প্রাইজের। কোনো শেয়ার কেনার পর যদি তার মূল্য বেড়ে ১২০ টাকা হয়Ñ হিসাবের ক্ষেত্রে তা ১০০ টাকাই ধরতে হবে। বৃদ্ধি পেয়ে সেটা ১২০ টাকা নয় বা কমলে তা ৯০ টাকাও নয়। কারণ ১০০ টাকা বিনিয়োগ করলে ব্যাংককে ১০০ টাকাই ঝুঁকি নিতে হয়। কিন্তু কেন্দ্রীয় শেয়ারের মূল্যবৃদ্ধি পেয়ে ১২০ টাকা হলে সেটা ১২০ টাকাই হিসাব করছে এবং শেয়ারমূল্য কমে ৯০ টাকায় নামলে সেটা ৯০ টাকাই হিসাব করছে। আর এখানে ব্যাংক ও শেয়ারবাজারসংশ্লিষ্টদের মধ্যে বিরোধ বিদ্যমান।
মন্তব্য