-->
রড-সিমেন্টের দাম বৃদ্ধি

হুমকির মুখে আবাসনশিল্প

রুবেল খান, চট্টগ্রাম
হুমকির মুখে আবাসনশিল্প
নির্মাণাধীন ভবন। ফাইল ছবি

রডের দাম গত ডিসেম্বর মাসেও ছিল টনপ্রতি ৫৫ হাজার টাকা। মাত্র চার মাসের ব্যবধানে অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে প্রতি টন রডের দাম এখন ৯৩ হাজার টাকা! একইভাবে ৩৮০ টাকার এক বস্তা সিমেন্টের দাম এখন ৪৭০ টাকা। বেড়েছে পাথর, বৈদ্যুতিক ক্যাবল, জিআই পাইপ, পিভিসি পাইপসহ নির্মাণসংশ্লিষ্ট প্রতিটি জিনিসের দাম। এভাবে রড-সিমেন্টসহ নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ায় হুমকির মুখে পড়েছে আবাসনশিল্প।

নির্মাণসামগ্রীর দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় চরম বিপাকে পড়েছেন আবাসন ব্যবসায়ীরা। কারণ ডেভেলপার কোম্পানিগুলো রড-সিমেন্টসহ সব নির্মাণসামগ্রীর যে দাম নির্ধারণ করে বহুতল ভবন নির্মাণকাজ শুরু করেছিল, সেই নির্মাণসামগ্রীর দাম অনেক বেড়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন তারা। কারণ নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়ে গেলেও নতুন করে ফ্ল্যাটের মূল্যবৃদ্ধি করার সুযোগ নেই তাদের। ফ্ল্যাটগুলো আগেই গ্রাহকের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন তারা। তাই এখন চড়া দামে নির্মাণসামগ্রী ক্রয় করে বহুতল ভবন নির্মাণ করতে গেলে কোটি কোটি টাকার লোকসান হবে আবাসন ব্যবসায়ীদের। আবার নির্মাণকাজ বন্ধ রাখতে নির্ধারিত সময়ে গ্রাহককে ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দিতে পারবেন না তারা। সেক্ষেত্রে ডেভেলপার কোম্পানির বদনাম হবে, যা পুরো আবাসনশিল্পের জন্যই নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

এ অবস্থায় আবাসনশিল্প রক্ষায় সরকারের সহায়তা চান আবাসন ব্যবসায়ীরা। আবাসনসংশ্লিষ্টদের মতে, ভ্যাট-ট্যাক্স কমিয়ে হলেও নির্মাণসামগ্রীর দাম নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। করোনাকালীন দুর্দিনে সরকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে প্রণোদনা দিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছিল। এখন আবাসন সেক্টরের জন্য বিশেষ প্রণোদনা দিয়ে এ খাতকে রক্ষা না করলে বিপর্যয়ের সৃষ্টি হবে।

এ প্রসঙ্গে আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন রিহ্যাব চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কমিটির চেয়ারম্যান ও কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট আব্দুল কৈয়ুম চৌধুরী বলেছেন, ‘যে হারে নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়ছে, তা যদি চলতে থাকে আবাসন ব্যবসায়ীদের পথে বসতে হবে। এ বিষয়ে সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। এ খাত টিকিয়ে রাখতে হলে প্রয়োজনে ট্যাক্স-ভ্যাট কমিয়ে সরকারকে আমাদের পাশে দাঁড়াতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘আমরা হিসাব করে দেখেছি, প্রতি বর্গফুট ফ্ল্যাটে নির্মাণ ব্যয় গড়ে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা বেড়ে গেছে। বাড়তি এ টাকার জোগান কোত্থেকে আসবে, তা নিয়ে আমাদের চিন্তাভাবনা করতে হবে। এখন বাড়তি দামে ফ্ল্যাট বিক্রি করতে হবে। কিন্তু যেগুলো ইতোমধ্যে বিক্রির চুক্তি হয়েছে, সেগুলোয় দাম বাড়ানো কঠিন। তবে এক্ষেত্রে আমাদের সবাইকে এগিয়ে এসে সমন্বয় করতে হবে। দাম বৃদ্ধি না করে কোনোভাবেই নির্মাণ কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সম্ভব হবে না। ৫৫ হাজার টাকার রড ৯৩ হাজার টাকা হওয়ার বিষয়টি যদি সংশ্লিষ্টরা না ভাবেন, তাহলে আবাসন ব্যবসায়ীদের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে যাবে।’

আগামী দু-চার দিনের মধ্যে রিহ্যাব নেতারা বসে করণীয় নির্ধারণ করবেন বলে তিনি উল্লেখ করেন।

আবাসন প্রতিষ্ঠান ফিনলে প্রপার্টিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মোফাখ্খারুল ইসলাম খসরু বলেন, ‘দেশের অর্থনীতিতে আবাসন খাতের গুরুত্ব অপরিসীম। দ্রুত উন্নয়ন, আবাসনের ক্রমবর্ধমান চাহিদা, মধ্যবিত্তের সম্প্রসারণ এবং মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিও পেছনে বাংলাদেশের রিয়েল এস্টেট খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। কিন্তু সেই গুরুত্বপূর্ণ খাতটি আজ ভয়াবহ সংকটে পড়েছে। করোনার ধাক্কা কাটিয়ে সবে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছিল রিয়েল এস্টেট ব্যবসা। বিক্রিও কিছুটা বেড়েছিল। আমরা সামনে সুন্দর সময়ের অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু নির্মাণসামগ্রীর ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধির কারণে সাম্প্রতিক মাসগুলোয় ফ্ল্যাটের দাম বাড়ছে। উচ্চমূল্য হওয়ার কারণে অনেক পরিবারের ফ্ল্যাট কেনার স্বপ্ন অধরা থেকে যাচ্ছে। এতে আবাসন খাতের অগ্রযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে এবং সরকারও নিশ্চিত রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘সাম্প্রতিক নির্মাণসামগ্রীর এ অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে প্রতি বর্গফুটে শুধু স্টিলের খরচ বেড়েছে ১০০ টাকা, সিমেন্টের খরচ ৩০, ইটের খরচ ২০ এবং পাথর বেড়েছে ৬৭ টাকা। এ হিসাব অনুযায়ী, প্রতি বর্গফুট নির্মাণ খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে ৩৮১ টাকা। এভাবে নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়ার প্রভাব সরাসরি আবাসন খাতে পড়েছে। এর ফলে আবাসন খাত বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে। ফ্ল্যাট ক্রেতাদেরও এ চাপ সামাল দিতে হিমশিম খেতে হবে। এ অবস্থায় অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে সরকারের জরুরি হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। সেইসঙ্গে আবাসন সেক্টরকে বাঁচাতে ভ্যাট-ট্যাক্সের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট খাতগুলোর অগ্রিম আয়কর কমানো বা প্রত্যাহার করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে সরকারকে।’

আবাসন খাত ভয়াবহ রকমের দুর্দিন পার করছে মন্তব্য করে চট্টগ্রামের প্রথম সারির আবাসনশিল্প প্রতিষ্ঠান সিপিডিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও ইঞ্জিনিয়ার ইফতেখার হোসেন উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ‘পরিস্থিতি এত বেশি নাজুক যে, এর থেকে উত্তরণের পথ একমাত্র সরকারই বাতলে দিতে পারে।’ নির্মাণসংশ্লিষ্ট জিনিসপত্রের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘শুধু নির্মাণসামগ্রীই নয়, দ্রব্যমূল্যও বাড়ছে। এগুলো একটির সঙ্গে অন্যটির সম্পর্ক নিবিড়। প্রতিটি পণ্যের দাম কীভাবে সহনশীল রাখা যায়, সরকারকে সেটা নিয়ে ভাবতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘ভোজ্যতেলের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় সরকার ভ্যাট কমিয়ে দিয়েছে। এতে তেলের দাম অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে এসেছে। একইভাবে যদি নির্মাণসংশ্লিষ্ট পণ্যের ভ্যাট-ট্যাক্স কমিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে এসব পণ্যের দামও নিয়ন্ত্রণে আসবে।’

চট্টগ্রামের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় আবাসন প্রতিষ্ঠান ইকুইটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী আইনুল হক বলেন, ‘ভয়াবহ রকমের সংকটে পড়েছে দেশের আবাসন খাত। এ সংকট থেকে উত্তরণের জন্য সরকারের জরুরি হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। সরকারের কাছ থেকে আমরা টাকা চাচ্ছি না। যদি পলিসি সাপোর্ট দেওয়া হয়, তাহলে এ খাত রক্ষা পাবে।’ তিনি বলেন, ‘বিশ^ব্যাপী স্ক্র্যাপের ক্রাইসিস, রডের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কারণে পরিবহণ খরচ বেড়ে যাওয়ায় সর্বক্ষেত্রে একটি অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। এ অস্থিরতার একটি বড় ধাক্কা আবাসন খাতে লেগেছে। রড, সিমেন্ট, ইট, রং, কাচসহ নির্মাণকাজে ব্যবহৃত এমন কোনো জিনিস নেই, যেটির দাম বাড়েনি। বেড়ে যাচ্ছে নির্মাণ শ্রমের দামও। এ পরিস্থিতি সামাল দিতে সবাইকেই এগিয়ে আসতে হবে।’

একই প্রসঙ্গে চট্টগ্রামের শীর্ষস্থানীয় আবাসন প্রতিষ্ঠান এপিক প্রপার্টিজ লিমিটেডের পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘নির্মাণসংশ্লিষ্ট প্রতিটি পণ্যের আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধির কারণে পুরো আবাসন সেক্টর বিপাকে পড়েছে। দেশের এমন কোনো নির্মাতা প্রতিষ্ঠান নেই, যারা সংকটে পড়েনি। এ সেক্টরে বড়-ছোট সব ব্যবসায়ীই আজ সংকটে পড়েছেন।’ তিনি বলেন, ‘আবাসন খাত অনেক বড় একটি শিল্প। এ শিল্পের সঙ্গে শুধু গুটিকয়েক নির্মাতা বা আবাসন ব্যবসায়ী জড়িত নয়, হাজার হাজার মানুষ জড়িত। বিশাল এ জনগোষ্ঠীর জন্য পুরো সেক্টরটিকে রক্ষা করতে হবে। আর এক্ষেত্রে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে উদ্যোগ গ্রহণ করা না হলে এ সেক্টরকে টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে। সরকারের সুদৃষ্টিতেই শুধু এ খাতে দেখা দেওয়া সংকটের উত্তরণ সম্ভব।’

র‌্যাংকস এফসি লিমিটেডের সিইও ইঞ্জিনিয়ার তানভীর শাহরিয়ার রিমন বলেন, ‘এক বছরে নির্মাণসামগ্রীর অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে আমরা রীতিমতো দিশেহারা। রডের দাম বেড়েছে প্রায় ৪৮ শতাংশ, সিমেন্টের দাম বেড়েছে ২০, ইটের ২০, পাথরের ৯, বালির ৮, ইলেকট্রিক ক্যাবলের ৫৫, ইউপিভিসি পাইপের ৩৬, রঙের ২৬ ও অ্যালুমিনিয়ামের ২৯ শতাংশ। অস্বাভাবিক এ মূল্যবৃদ্ধির পরও আমরা ফ্ল্যাটের দাম ১ শতাংশও বাড়াইনি। উল্টো সার্ভিসে ভ্যালু অ্যাড করেছি। কিন্তু এভাবে যদি কাঁচামালের দাম লাগামহীন হয়ে যায়, তাহলে আমাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। নির্মাণসামগ্রীর অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি প্রতিষ্ঠান হিসেবে আমাদের ওপর বিরাট একটা চ্যালেঞ্জ চাপিয়ে দিয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘বিল্ডিংয়ের কাজ শুরুর সময় যখন আমরা সব হিসাব-নিকাশ করি, তখন মাত্র ১০ শতাংশ লভ্যাংশ ধরে হিসাব কষা হয়। এখন ওই ১০ শতাংশ দিয়ে ৫০ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি সামাল দেওয়া অসম্ভব। এ অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির ফলে আমাদের নির্মাণ ব্যয় একেবারে কম করে হিসাব করলেও প্রতি বর্গফুটে ৫০০ টাকা বেড়ে গেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে স্ক্র্যাপের দামের অস্বাভাবিক বৃদ্ধির সঙ্গে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব মারাত্মক সংকট তৈরি করছে। এ অবস্থায় সরকার, ডেভেলপার, ভূমি মালিক, লগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান এবং গ্রাহকের বাস্তবতা বুঝে সমন্বয়ের মাধ্যমে সম্ভাবনাময় এ শিল্পের স্বার্থে এগিয়ে আসতে হবে।’

মন্তব্য

Beta version