ড. আহসান এইচ মনসুর গবেষক, বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান। গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক। তার সঙ্গে কথা হয়েছে বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ নিয়ে কথা হয়েছে। করোনা মহামারির পূর্ব অবস্থা, করোনা মহামারিকালীন অবস্থা এবং করোনা-পরবর্তী নিয়ে তিনি ভোরের আকাশের সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক জাফর আহমদ
ভোরের আকাশ: করোনা মহামারির মধ্যে বিশেষ ব্যবস্থার কারণে খেলাপি ঋণ কমেছিল। বিশেষ ব্যবস্থা তুলে নেওয়া হয়েছে, আবার খেলাপি ঋণ বাড়ছে। একই সময়ে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব পড়েছে। ঋণ পরিস্থিতি খারাপ হবে-
আহসান এইচ মনসুর: খেলাপি ঋণ তো বাড়বেই, এটা জানা কথা।
ভোরের আকাশ: বৈশ্বিক যুদ্ধ পরিস্থিতির প্রভাব যুক্ত হলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা তো আরো খারাপ হতে পারে?
আহসান এইচ মনসুর: করোনা মহামারি মোকাবিলায় পৃথিবীর সব দেশে প্রনোদনা প্যাকেজ দেওয়া হয়েছে বাজেট থেকে। আর বাংলাদেশে দেওয়া হয়েছে প্রাইভেট সেক্টর ব্যাংক থেকে। বাজেট থেকে দেওয়া হলে ওই টাকা অনাদায়ী হলে তা বাজেটের ঘাড়ে চলে যায়। আর বেসরকারির ব্যাংকগুলোর তহবিল থেকে স্টিমুলাস প্যাকেজ দেওয়া হয়েছে, এর ফলে এই টাকা অনাদায়ী হলে সব পড়বে বেসরকারি ব্যাংকের ওপর। এখানে শতভাগ ঝুঁকি হচ্ছে বেসরকারি ব্যাংকের।
ভোরের আকাশ: টাকা ফেরত না এলে সবগুলোই তো বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে বহন করতে হচ্ছে?
আহসান এইচ মনসুর: কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্টিমুলাস প্যাকেজের টাকার অর্ধেক বাংলাদেশ ব্যাংক দিয়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক এখন সেই টাকা নিয়ে নিচ্ছে। এখন ঋণের সম্প্রসারণ করলেও বাণিজ্যিক ব্যাংককে করতে হচ্ছে, রিফাইনান্স করলেও বাণিজ্যিক ব্যাংককে করতে হচ্ছে, খেলাপি হলেও তা বহন করতে হবে বাণিজ্যিক ব্যাংককে। সরকার ঘোষণা করলো পলিসি, দায়ভার পড়ল বাণিজ্যিক ব্যাংকের ওপর। পৃথিবীর সব দেশে স্টিমুলাস প্যাকেজের টাকা দেওয়া হয়েছে বাজেট থেকে আর বাংলাদেশে দেওয়া হলো ব্যাংক থেকে। ভারতসহ পৃথিবীর অনেক দেশে এসএমই খাতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে দিতে হয়েছে। কিন্তু ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক শতভাগ গ্যারান্টি দিয়েছে। আর বাংলাদেশে তার কিছুই দেওয়া হয়নি।
ভোরের আকাশ: এই যে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ওপর ছেড়ে দেওয়া হলো, এটা কি সরকারের সক্ষমতা নেই এ জন্য, নাকি তথ্য ঘাটতির কারণে এটা করেছে, আপনি বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?
আহসান এইচ মনসুর: তথ্যের ঘাটতির কারণে নয়। সরকার দায়ভার এড়াতে এটা করেছে। করোনা রোধে স্টিমুলাসের দায় সরকারের, এটা তো ব্যাংকের নয়। কিন্তু সরকার এই দায়ভার নিল না। সরকার বলে দিল এত হাজার কোটি টাকা তোমাকে দিতে হবে, সরকার বলে দিল। দিতে হবে, না দিতে পারলেও দিতে হবে। দায়ভার ব্যাংকের ওপর চাপিয়ে দিল। কিন্তু প্রটেকশন দিল না। এসএমইএ-এর ক্ষেত্রে বলে দিল তোমাদের এত হাজার কোটি টাকা দিতে হবে। অনেকই দিতে পারেনি, অনেকে না বুঝে দিয়ে ফেলেছে। এই টাকা যদি ফেরত না আসে, এর দায় ভার কে নেবে। এ ক্ষেত্রে তো খেলাপি হবেই।
ভোরের আকাশ: করোনা মহামারির অভিঘাত রোধে ঘোষিত প্রণোদনার বড় ঋণ আগে বিতরণ হয়ে গেছে। বলা হয়, বড় ঋণের বড় সমস্যা থাকে। এ ঋণ আদায় নিয়ে তো সমস্যায় হতে পারে?
আহসান এইচ মনসুর: খেলাপি হতেই পারে। বাংলাদেশের ব্যাংকের উদ্যোক্তা মানেই বড় ব্যবসায়ী। মালিকের বড় বড় ব্যবসা আছে, তাই না! রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর কথা বাদ দিলাম, বেশির ভাগ ব্যাংকের ক্ষেত্রে কথাটি প্রযোজ্য। ব্র্যাক ব্যাংকসহ আরো দুয়েকটি ব্যাংকের কথা বাদ দিলে সব ব্যাংকের ক্ষেত্রে কথাটি প্রযোজ্য। এসব ব্যাংকের কম্প্রোমাইজ হয়, একজন আরেকজনের ব্যাংকের কাছে থেকে ঋণ নেয় ইত্যাদি। এখানে বড় ব্যবসায়ীর কেউ কেউ ফেইল করতেই পারে, করছে। টাকা দিচ্ছে না ; এটা তো হবেই। একজন শোধ করছে না, তাকে আরেকজনও করছে না। নামে, বেনামে ঋণ নিয়ে এভাবে না দেওয়ার প্রবণতা শোনা যায়।
ভোরের আকাশ: করোনার আগে বলা হচ্ছিল খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেশি হওয়ার কারণে ব্যাংকগুলো সুদ হার কমাতে পারছে না। এরপর সরকারের পক্ষ থেকে নানা ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এতে ফলও দিয়েছিল, সুদ কিছুটা কমেছিল। করোনা-পরবর্তী তারল্য সংকট হচ্ছে। মনে হচ্ছে ঋণের চাহিদা বেড়ে যাওয়ার কারণে এমনটা হচ্ছে। যা মনে হচ্ছে, আগামীতে সুদ হার আবারো বাড়তে পারে। আপনি বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?
আহসান এইচ মনসুর: সুদ হার বৃদ্ধি পাওয়া উচিত নয়। ডিপোজিতে সুদ হার কম। পৃথিবীর কোন দেশে আছে, যেখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক হস্তক্ষেপ করে? আমাদের দেশের ব্যাংকের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। ব্যাংকগুলোর রিটার্ন অব লিকুইডিটি কমতে কমতে কোথায় গেছে! আরো কমবে। ব্যাংকে কে বিনিয়োগ করবে টাকার মারা উদ্দেশ্য ছাড়া! টাকা মারার উদ্দেশ্য থাকলেই কেবল এগিয়ে আসবে, তাছাড়া নয়। গত দুই বছরে বাংলাদেশ ব্যাংক যে কার্যকলাপ করেছে তা বিশ্বের কোথাও নেই।
ভোরের আকাশ: কোন কার্যকলাপের কথা বলছেন, নির্দিষ্ট করবেন?
আহসান এইচ মনসুর: কার্যকলাপ হলো ঋণের সুদ বেঁধে দেওয়া। আমানতের সুদে বেঁধে দেওয়া। বা বেতনের স্কেল বাড়িয়ে দেওয়া। এগুলো তো হস্তক্ষেপ। পৃথিবীর কোনো দেশ এ রকম হস্তক্ষেপ করে না। তাহলে ব্যাংক চলবে কীভাবে? গত বছর ছাড় ছিল। এবার খেলাপি ঋণের কি অবস্থা হয় দেখতে পাবেন। গত বছর কত শতাংশ ছিল, এবার কত শতাংশ হয়েছে এবং এবারো নেমে যাবে। তখন দেখবেন। বলা হয় ব্যাংক লাভ করে। লিকুইডিটি যদি ৪ শতাংশ হয় তাহলে লাভ হলো কোথায়? এত কম লাভের প্রতিষ্ঠানের কাছে থেকে ৪০ শতাংশের ওপরে ট্যাক্স দেওয়া নিচ্ছে। এর যৌক্তিকতা কি?
ভোরের আকাশ: কিন্তু আপনি যে ব্যাংকের চেয়ারম্যান, ব্র্যাক ব্যাংকের তো ভালো করছে, এর বিশেষত্ব কী?
আহসান এইচ মনসুর: সেটা বাদ দিন। গড় ব্যাংক শিল্পের কথা বিবেচনা করতে হবে। একটা দেখলে চলবে না।
ভোরের আকাশ: তারপরও তো সেটা অভিজ্ঞতা হতে পারে।
আহসান এইচ মনসুর: হ্যাঁ, হতে পারে। কিন্তু আমাদেরও তো রিটার্ন কমছে। আমরা পারছি কোনো রকমে। অন্য কোনো ব্যাংক ৯ শতাংশ সুদ হারে এসএমই-তে ঋণ দেবে না। এসএমই ঋণ দেবে না। তাহলে এসএমই ঋণের কি অবস্থা হবে। এটা কি সরকার ভেবে দেখছে! ব্যাংক যদি ১২ শতাংশ হারে ঋণ দিতে পারত তাহলে এসএমই খাতের উদ্যোক্তারা ১২ শতাংশ হারে ঋণ পেত। এখন তো এসএমই-কে মাইক্রো ফাইনান্স থেকে ২৬/২৬ শতাংশ সুদে ঋণ নিতে হবে। সরকার কিংবা বাংলাদেশ ব্যাংক কী এটা চায়?
ভোরের আকাশ: তাহলে তো সামনে বড় বিপদ অপেক্ষা করছে?
আহসান এইচ মনসুর: হ্যাঁ, সেটা তো করছে। ৯ শতাংশ সুদে একটা ব্যাংক কেন ঋণ দেবে, দেবে না। গত বছর ১০০ টাকা ঋণ দিলে যা রিটার্ন আসত তার ১০৮ শতাংশ খরচ হতো। এবার কস্ট কমিয়ে ৮৭ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। এই যে ব্যাংকের কর্মীদের বেতন বাড়বে, আবারো ব্যাংকের খরচ বেড়ে যাবে। ব্যাংক বসে ভেরান্ডা ভাজতে এসেছে?
ভোরের আকাশ: এ অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ কী, কী পরামর্শ দেবনে?
আহসান এইচ মনসুর: এ নিয়ে সরকারকে কথা বলতে হবে। নীতির পরিবর্তন করতে হবে। বেতন বাড়াল কিনা, তা দেখার চেয়ে খেলাপি ঋণ কেন বাড়ল তার কারণ অনুসন্ধান করতে হবে।
মন্তব্য