পতনের বৃত্ত থেকে বের হতে পারছে না পুঁজিবাজার। বাজারের সিংহভাগ শেয়ার ক্রয়যোগ্য অবস্থায় থাকার পরও প্রতিনিয়ত সূচক এবং শেয়ারদর নিম্নমুখী হচ্ছে। এতে দিশাহারা হয়ে পড়েছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। বিশেষ করে যারা সম্প্রতি বাজারে এসেছিলেন তাদের অবস্থা আরো করুণ। ইতোমধ্যে তারা বড় ধরনের লোকসানে পড়েছেন। লোকসানের কবল থেকে বাঁচতে পোর্টফলিতে পরিবর্তন আনছেন তারা। দুর্বল কোম্পানি শেয়ার ছেড়ে বিনিয়োগ করছেন অপেক্ষাকৃত ভালোমানের কোম্পানিতে। কিন্তু এতে শেষ রক্ষা হচ্ছে না। ভারি হচ্ছে লোকসান।
বিনিয়োগকারী লুৎফর রহমান। পুঁজিবাজারের পুরোনো বিনিয়োগকারী। ২০১০ সালের লোকসানের বোঝা এখনো টেনে নিয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। বাংলাদেশ সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে (বিএসইসি) নতুন কমিশনে পরিবর্তন আসার তিনি আবারো বাজারে নতুন বিনিয়োগ করেছিলেন। কারণ এই সময়ে বাজার কিছুদিন ভালো ছিল। তিনি ভেবেছিলেন নতুন বিনিয়োগে যে মুনাফা হবে এতে আগের ক্ষতি পুষয়ে নেবেন। কিন্তু হচ্ছে এর উল্টো। প্রতিনিয়তই উধাও হচ্ছে তার মূল পুঁজি। ঝুঁকি এড়াতে সম্প্রতি বস্ত্র খাতের কিছু কোম্পানির শেয়ার লোকসানে বিক্রি করে তিনি ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর শেয়ার কেনন। ভাবনা ছিল ভালোমানের কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে নিরাপদে থাকবেন। কিন্তু এখানেও তার লোকসান গুনতে হচ্ছে। তার মতো অবস্থা হাজারো বিনিয়োগকারীর। পোর্টফলিওতে ভালোমানের শেয়ার যুক্ত করেও প্রতিনিয়ত লোকসান গুনছেন তারা।
বিষয়টি নিয়ে আলাপ করলে একটি ব্রোকারেজ হাউসের কর্মকর্তা বলেন, গত দুই মাস আগে বিনিয়োগ করেছেন এমন অনেক বিনিয়োগকারীর পুঁজি ১৫ থেকে ২০ শতাংশ কমে গেছে। তবে যাদের পুঁজি বেশি তাদের তেমন লোকসানে পড়তে হয়নি। এসব বিনিয়োগকারী অনেকগুলো শেয়ারে বিনিয়োগ করেন। ফলে কিছু শেয়ারের দর কমলেও কিছুর বাড়ার সুযোগ থাকে। যে কারণে কিছুটা নিরাপতে থাকেন তারা।
বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে আলাপে জানা যায়, পতনমুখী বাজারে পোর্টফোলিওতে পরিবর্তন আনছেন তারা। দুর্বল কোম্পানি ছেড়ে তারা বের হয়ে আসার চেষ্টা করছেন। এছাড়া মৌলভিত্তির শেয়ারের ক্ষেত্রেও একই নীতি অবলম্বন করছেন তারা। লোকসানের ভয়ে এক কোম্পানির শেয়ার বিক্রি করে কিনছেন অন্য কোম্পানির শেয়ার।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, দুর্বল কোম্পানি থেকে বের হয়ে আসার কারণে এসব কোম্পানির দৌরাত্ম্য আগের চেয়ে অনেক কমেছে। একইসঙ্গে কমছে ভালো মানের কোম্পানির শেয়ারদর। ফলে পোর্টফোলিতে পরিবর্তন এনে কোনো লাভ হচ্ছে না।
এদিকে বিষয়টি নিয়ে আলাপে বাজার সংশ্লিষ্টরা বলেন, পুঁজিবাজারে কিছু বিনিয়োগকারী দ্রুত মুনাফা করে তা ঘরে তুলতে চান। আবার লোকসানের ভয়ে এক কোম্পানি ছেড়ে অন্য কোম্পানির শেয়ার বিনিয়োগ করেন। এ সময় কেউ কেউ অপেক্ষাকৃত দুর্বল কোম্পানিতে ঝুঁকে পড়েন। কিন্তু যারা ঝুঁকি নিতে চান না, তারা ভালো কোম্পানির সঙ্গে থাকেন। এখানে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করলে তাদের ভালো মুনাফা তৈরির সম্ভাবনা তৈরি হয়।
এ প্রসঙ্গে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, ‘বিনিয়োগকারীরা ভালো কোম্পানির সঙ্গে থাকলে তা বাজার ও বিনিয়োগকারী- উভয়ের জন্যই ভালো। অধিক লাভের আশায় নামসর্বস্ব কোম্পানিতে বিনিয়োগ না করে তাদের উচিত ভালো কোম্পানিতে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ করা। কারণ এখানে খুব বেশি লাভ না হলেও লোকসান হওয়ার শঙ্কা থাকে কম।’ বিশেষ কোনো কারণ ছাড়া ঘনঘন সিদ্ধান্ত পরিবর্তন ভালো নয়। যারা ভালোমানের কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেছেন আমি মনে করি, দেরিতে হলেও তারা ভালো ফল পাবেন।
একই বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রকটি ব্রোকারেজ হাউসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, বিনিয়োগকারীদের উচিত সব সময়ই ভালো মানের কোম্পানির সঙ্গে থাকা। এতে তারা সব সময়ই অপেক্ষাকৃত নিরাপদে থাকতে পারেন। কিন্তু বিনিয়োগকারীরা গুজবে কান দিয়ে কিংবা অন্যের দেওয়া সংবাদে দ্রুত লাভবান হওয়ার জন্য যে কোনো কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেন। তারা লোকসানে এক কোম্পানির শেয়ার বিক্রি করে অন্য কোম্পানির শেয়ার কেনেন। কিন্তু বেশির ভাগ সময়ই এর ফল উল্টো হয়। একসময় এসব শেয়ার নিয়ে তাদের পস্তাতে হয়। তিনি বলেন, অনেক সময় হাউস থেকেই বিনিয়োগকারীদের এক শেয়ার ছেড়ে অন্য শেয়ারে বিনিয়োগ করার পরামর্শ দেওয়া হয়। এটা ঠিক নয়। এতে হাউস কর্তৃপক্ষই লাভাবান হয়, বিনিয়োগকারী নন।
অন্যদিকে গতিশীল বাজারে বিনিয়োগকারীদের সতর্ক থাকার বিকল্প নেই বলে মনে করছেন বাজার-সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, বাজারের এসব পরিস্থিতিতে এখান থেকে কারসাজি চক্র সুবিধা নিতে চায়। সেজন্য বিনিয়োগকারীদের সজাগ থাকা দরকার। তাই এ বাজার থেকে কেউ যাতে সুবিধা নিতে না পারেন, সেদিকে সংশ্লিষ্টদের নজর রাখা দরকার।
মন্তব্য