বাঙালির বিয়ের প্রধান আকর্ষণ বেনারসি শাড়ি। সমাজে উচ্চশ্রেণি থেকে শুরু করে নিম্নবিত্তরাও বিয়েতে বেনারসি শাড়ি দিতে চান। মূলত সে কারণেই শাড়ির জগতে একটি বিশেষ নাম বেনারসি। আর সেটি যদি হয় মিরপুরের বেনারসিপল্লির তৈরি, তাহলে তো কথাই নেই। ঈদের সময় বিয়ের মৌসুম। সে কারণে ঈদ এলেই বেনারসিপল্লিতে ভিড় বাড়তে থাকে। কিন্তু এবারের চিত্র ভিন্ন। ঈদের মৌসুমে বেনারসিপাড়ায় সেই চিরচেনা রূপ নেই। উল্টো কেমন সুনসান নীরবতা।
জানা যায়, বেনারসিপল্লিতে ভিড় না হওয়ার আরো নানা কারণ রয়েছে। ক্রেতা না পাওয়ায় অভিযোগেরও শেষ নেই দোকানিদের। মেট্রোরেলের জন্য রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কারণে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো ক্রেতা আসছেন না এ পল্লিতে। তবে খুচরা ক্রেতা এবং পাইকারদের আনাগোনায় মুখর এ পল্লির কিছু কিছু দোকান। গত দুই বছর করোনা মহামারিতে ব্যবসা তেমন একটা ভালো যায়নি। তাই এবার আগে থেকেই নতুন উদ্যমে প্রস্তুতি শুরু করেছিলেন রাজধানীর মিরপুর বেনারসিপল্লির ব্যবসায়ীরা। ভেবেছিলেন গতবারের লোকসানটা এবার পুষিয়ে নিব। সে লক্ষ্যে এবারের ঈদে দেশি শাড়ির কালেকশন বাড়ানোর প্রতি সব ব্যবসায়ীরা মনোযোগ দিয়েছিলেন। তবে যে আশা নিয়ে তারা প্রহর গুনছিলেন, তা যেন হতাশায় নিমগ্ন।
সরেজমিন গতকাল শনিবার মিরপুর বেনারসিপল্লিতে ঢুকে দেখা গেল দোকানগুলোয় ক্রেতার আনাগোনা একেবারেই কম। ফলে বিক্রেতারা অলস সময় পার করছেন। একেবারেই যেন অন্য চেহারা। অথচ প্রতি বছর শবেবরাতের পর থেকেই এখানে বিক্রির ধুম পড়ে যায়। রোজা শুরু হলে তো কথাই নেই, সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত চলে কেনাবেচা। এবার তের রোজা পেরিয়ে গেলেও বেনারসিপল্লি একরকম ক্রেতাশূন্য।
কথা হয় বেনারসি অলংকারের ম্যানেজার মো. নিজামের সঙ্গে। তিনি বলেন, রমজানের আগে বেচাকেনা অনেক ভালো ছিল। এখন বেচাকেনা নেই বললেই চলে। লাভ তো দূরের কথা, দোকান চালানো কঠিন হয়ে পড়ছে। মেট্রোরেলের কাজের জন্য অনেকগুলো পথ বন্ধ। এর অংশ হিসেবে বেনারসিপল্লির ১ নম্বর গেটটি দিয়েও গাড়ি ঢুকতে পারে না। এখানে আসতে হলে অনেকটা পথ ঘুরতে হয়। সে কারণে এত ঝামেলা পার করে ঐতিহ্যবাহী এ শাড়ির বাজারে ক্রেতা আসতে অনিচ্ছা প্রকাশ করে। তিনি জানান, রমজানের আগে দিনে দেড়-দুই লাখ টাকা বিক্রি হতো। এখন দিনে হাজার দশেক টাকার শাড়ি বিক্রি করাও কঠিন। যেখানে আগে দিনে ২৫-৩০টি শাড়ি বিক্রি হতো, এখন সেখানে দিনে মাত্র ৭-৮টি শাড়ি বিক্রি হয়।
মিরপুর ১০ নম্বরের বেনারসিপল্লিতে শাড়ির দোকান ১৬৪টি। দোকানিরা জানান, প্রায় বছর দুই ধরে বেনারসিপল্লির রাস্তাগুলোয় উন্নয়ন ও পাইপ বসানোর কাজ চলছে। রাস্তা এমন করে কেটে রাখা হয়েছে যে অধিকাংশ সড়কে গাড়ি চলে না। রোজার আগেই কাজ শেষ করা উচিত ছিল। কিন্তু তা হয়নি। বিক্রমপুর বেনারসি কুঠিতে গিয়ে দেখা যায় বাহারি সব নাম, রং ও ডিজাইনের শাড়ির বিপুল সমাহার। দোকানের ম্যানেজার মো. তাজুল ইসলাম ভোরের আকাশকে বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় মানুষের হাতে টাকা নেই। তাই ক্রেতারা তেমন বেশি আসতে চায় না। এছাড়া শাড়ি তৈরি করার উপাদানগুলোর দামও বেড়েছে, তাই শাড়ির দামও বেড়েছে। আমাদের এখানে কাতান হচ্ছে ১০ থেকে ৪০ হাজার টাকায়। এছাড়া অপেরা কাতান ৬-৭ হাজার টাকা, কাঞ্জিভরন (পিয়র) ১৫ থেকে ৭০ হাজার টাকা, মিরপুরের খাদি ৫ থেকে ২৫ হাজার টাকা, বিল্লু রানী ৯ থেকে ৩০ হাজার টাকা, বিয়ের বেনারসি ৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা, ভারতীয় পাটি লেহেঙ্গা ৫ থেকে ৫২ হাজার টাকা, ঢাকাই জামদানি ৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা, টাঙ্গাইলের সুতি শাড়ি ৭শ থেকে ৪ হাজার টাকা, টাঙ্গাইলের সফট সিল্ক আড়াই হাজার থেকে ১২ হাজার টাকা, ইন্ডিয়ান গাদোয়াল ৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা।
বেনারসি রূপসী নগরের মালিক মো. সাইফুল ইসলাম জসিম জানান, বেচাকেনা স্বাভাবিক সময়ের থেকে অনেক খারাপ। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ায় সবকিছুর দাম বেড়েছে। তাই মানুষ মার্কেট বিমুখ ক্রেতারা। তিনি বলেন, তাদের দোকানে নিজস্ব তৈরি কাতান শাড়ি পাওয়া যাচ্ছে ৩ থেকে ২০ হাজার টাকার মধ্যে। এছাড়া ঢাকাই জামদানি ৪ থেকে ১০ হাজার টাকা, টাঙ্গাইলের তাঁত শাড়ি ১১শ থেকে ৬ হাজার টাকা, টাঙ্গাইলের সিল্ক ১৩শ থেকে ৬ হাজার টাকা, মিরপুর বেনারসি ব্রাইডাল শাড়ি ৪ থেকে ২৫ হাজার টাকা, শিপন দেড় হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা, জর্জেট প্রিন্ট ১-৩ হাজার টাকা এবং কাঞ্জিভরন (কাতান) পাওয়া যাচ্ছে ১৮ থেকে ২২ হাজার টাকা।
একই প্রসঙ্গে হাজী হারুন বেনারসি হাউসের মো. মিলন সরকার বলেন, ভারতের ভিসা খুলে দেওয়ায় ক্রেতারাও ছুটে যাচ্ছেন কলকাতাসহ ভারতের অন্যান্য শহরে। ফলে আমরা দুদিক থেকেই মার খাচ্ছি। ১৯৯০ সালে যাত্রা শুরু হওয়া বেনারসি কুঠির মিরপুরের সবচেয়ে আদি ও পুরোনো প্রতিষ্ঠান। প্রথম দিকে এখানে মাত্র ২-৩টা দোকান থাকলেও এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২৬টিতে। সরকারের উচিত ব্যবসায়ী ও দেশের স্বার্থে এ বিষয়টির দিকে নজর দেওয়া।
এদিকে বেনারসিপল্লিতে শাড়ির দাম অনেক বেশি রাখা হয় বলেও অভিযোগ রয়েছে। এখান থেকে শাড়ি কিনে প্রতারণার ঘটনাও রয়েছে অনেক। যে কারণে বেনারসিপল্লি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন ক্রেতারা। জানতে চাইলে মো. মুস্তাফিজুর রহমান নামে এক ক্রেতা জানান, ‘আমি অনেকবারই বেনারসিপল্লিতে গিয়েছি। ওখানে অনেক মানহীন শাড়িরও বেশি দাম রাখা হয়। একই শাড়ি অন্য মার্কেট থেকে অনেক কম মূল্যে সংগ্রহ করা যায়। ক্রেতাকে এক শাড়ি দেখিয়ে অন্য শাড়ি প্যাকেট করে দিয়েছেন বেনারসিপল্লিতে এমন ঘটনাও ঘটে।’
মন্তব্য