রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে অনেকটা পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। প্রায় সব দেশে দাপট বাড়াচ্ছে বিশ্ব লেনদেনের প্রধান মুদ্রা মার্কিন ডলার। অন্যদিকে করোনার কারণে চীনে চলছে লকডাউন। ফলে পণ্যের কাঁচামালের প্রধান রপ্তানিকারক দেশ চীনের পরিস্থিতি, শ্রীলঙ্কার দেওলিয়া এবং পাকিস্তানের রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে তৈরি পোশাকসহ রপ্তানি পণ্যের নিরাপদ বাণিজ্যস্থল এখন বাংলাদেশ। এতে করে বাংলাদেশের অর্থনেতিক সম্ভনার সৃষ্টি হয়েছে। তবে প্রশ্ন হচ্ছে-দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার প্রতিযোগী দেশের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতার সুযোগ নিতে পারবে কি বাংলাদেশ?
এজন্য প্রতিবেশিদের সমস্যার মধ্যে ক্রেতা আকৃষ্ট করতে বা নতুন ক্রেতাদের চাহিদার ভিত্তিতে পণ্য সরবরাহ করাকে প্রধান্য দিচ্ছেন উদ্যোক্তা। তবে ডলারের দাম বৃদ্ধি, কাঁচামাল আমদানি জটিলতা এবং শিল্পখাতে গ্যাস সরবরাহ সমস্যা তৈরি হওয়ায় রপ্তানি পণ্যের উৎপাদনে জটিলতা দেখা দিতে পারে। ফলে এই পরিস্থিতিতে সব পক্ষকে একযোগে সময় উপযোগী সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর পরামর্শ দিয়েছেন ব্যবসায়ী, অর্থনীতি বিশ্লেষকরা।
জানা গেছে, সম্প্রতি সময়ে আমদানি বাড়ায় ডলারের চাহিদা ব্যাপক হারে বাড়ছে। আর এই সুযোগে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে প্রতিদিনই বাড়ছে যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা মার্কিন ডলারের দাম। চলতি সময়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাংকগুলো ডলারের দাম বাড়ানো অব্যাহত রেখেছে। এদিন ঢাকায় প্রতি ডলার ৯১ টাকা থেকে ৯২ টাকায় বিক্রি করে ব্যাংকগুলো। আর খোলা বাজারে (মানি এক্সচেঞ্জ) বিক্রি হয়েছে ৯৩ টাকা পর্যন্ত।
জানা গেছে, ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে (আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজার) ৮৬ টাকা ২০ পয়সায় প্রতি ডলার নিচ্ছে। আর পরবর্তীতে প্রায় ৬ টাকা বেশি দামে বিক্রি করা হচ্ছে। আর এনিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে রপ্তানিকারকরা।
চলমান পরিস্থিতির বিষয়ে তৈরি পোশাক রপ্তানি কারকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান ভোরের আকাশকে বলেন, প্রতিযোগী দেশের সমস্যার কারণে একদিকে যেমন আমাদের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে ডলারের দাম বৃদ্ধির কারণে জটিলতা তৈরি হচ্ছে। অন্যদিকে আমদানি নির্ভর হওয়ায় শুল্ক ব্যবস্থাপনায় আমাদের জটিলতা রয়েছে। ফলে নতুন ক্রেতাদের বিষয় গুরুত্ব দিয়ে আমদানি জটিলতা নিরসন করতে হবে।
ফারুক হাসান বলেন, আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতিতে সব দেশে একটি কমন (গড়) সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। আমাদের দেশেও সমস্যা তৈরি হচ্ছে। রপ্তানি পণ্যের কাঁচামালের মধ্যে প্রায় সবই আমদানিনির্ভর। এর ফলে রিজার্ভের উপর একটি চাপ তৈরি হচ্ছে। ডলারের দাম বাড়ায় আমদানি ব্যয় বাড়ছে। তবে পরিস্থিতি মোকাবেলায় আমাদের রপ্তানি বাড়াতে হবে।
বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, করোনা পরিস্থিতির মধ্যে আমাদের যে রপ্তানি গ্রোথ রয়েছে তা ইতিবাচক। ২০২১ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ৩৫ দশমিক ৮১ বিলিয়ন ডলারের শিল্পে পরিণত হয়েছে। জিডিপিতে এ শিল্পের অবদান প্রায় ১১ শতাংশ। পোশাক শিল্পকে কেন্দ্র করে আজ সমগ্র অর্থনীতি আবর্তিত হচ্ছে ব্যাংক, বিমা, বন্দর, হোটেল, পর্যটন, ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ ও আনুষঙ্গিক শিল্পসহ বিভিন্ন শিল্পের বিকাশ ঘটেছে।
তৈরি পোশাক শিল্পের নিট পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম ভোরের আকাশকে বলেন, ‘চায়না, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া এবং মিয়ানমারসহ আমাদের যারা প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ সবাই কিন্তু একটা অসুবিধার মধ্যে আছে। চায়নাতে এখন লকডাউন চলছে। এর কারণে চায়নার ওপর যারা নির্ভরশীল ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়ারমত দেশগুলো এখন সমস্যার মধ্যে আছে। ফলে ক্রেতারা কিন্তু তাদের কাছ থেকে মাল নিতে পারছে না।
‘শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি সবার জানা, পাকিস্তানের পরিস্থিতি নতুন করে ঘোলাটে অবস্থা। এসব কারণে ক্রেতারা আমাদের কাছে আসছেন। বিশ্ব পরিস্থিতিতে বর্তমানে ক্রেতাদের জন্য নিরাপদ বাণিজ্য কেন্দ্র হচ্ছে এখন বাংলাদেশ। ঠিক এই সময়ে যদি আমরা তাদের চাহিদা পূরণ করতে না পারি, পণ্য রপ্তানির সময় (রপ্তানি চুক্তি) রক্ষা করতে না পারি, তাহলে যেসব নতুন ক্রয় আদেশ নেয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে, তা আমাদের হাতছাড়া হবে।’
প্রাসঙ্গিক বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ভোরের আকাশকে বলেন, ‘রপ্তানি চিত্র আমাদের জন্য ইতিবাচক। রাশিয়া নিয়ে তেমন কোনো চিন্তার কারণ নেই। তবে ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধ দীর্ঘমেয়াদি হলে তা ইউরোপের দেশগুলোতে প্রভাব ফেলবে। সে বিষয়ে আমাদের নজর রাখতে হবে। আর করোনার কারণে দেশে দেশে অস্থিরতার ভাব রয়েছে। অনেকে ক্রয় আদেশ কমিয়ে আনছে।
‘অপর দিকে চীনসহ প্রতিযোগী দেশ সমস্যা মধ্যে থাকায় তা আমাদের জন্য সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের পণ্যের কাঁচামাল আমদানি সহজীকরণ ও কারখানা উৎপাদনে গ্যাস সরবরাহ সার্ভিস রাখা জরুরি। ক্রেতা আকৃষ্ট ও নতুন ক্রেতাদের নির্ধারিত সময়ে পণ্য সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য সব পক্ষকে এক সঙ্গে কাজ করতে হবে। সমস্যা চিহ্নিত করে সমাধান করতে হবে।’
গত সোমবার বাংলাদেশ তৈল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশ (পেট্রোবাংলা) জনসংযোগ দপ্তর থেকে তারিকুল ইসলাম খান স্বাক্ষরিত এক বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, ‘পবিত্র রমজান উপলক্ষে ১২ এপ্রিল মঙ্গলবার থেকে পরবর্তী ১৫ দিন বিকাল ৫টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত (৪ ঘন্টা) সব শিল্প শ্রেণির গ্রাহকের গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রাখার বিশেষভাবে অনুরোধ করা হলো। গ্যাস বিতরণ কোম্পানির ভিজিল্যান্স টিম বিষয়টি নিয়মিত মনিটরিং করবে।’
তবে সাময়িক এ অসুবিধার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছে পেট্রোবাংলা।
মন্তব্য