-->
শিরোনাম

ভোজ্যতেলের দামের কূলকিনারা পাচ্ছে না মন্ত্রণালয়

যৌক্তিক মূল্য নিশ্চিত করতে মনিটরিং জোরদার করা হয়েছে: মন্ত্রণালয়

মো. রেজাউর রহিম
ভোজ্যতেলের দামের কূলকিনারা পাচ্ছে না মন্ত্রণালয়

এক বছর ধরে দেশে ভোজ্যতেলের বাজারে অস্থিরতা চলছে। প্রতিবারই সরকারি হস্তক্ষেপে দাম নির্ধারণ করা হলেও কোনোবারই বাজারে তার প্রতিফলন ঘটেনি। ভোজ্যতেলের আমদানি পরিস্থিতি আগের বছরের চেয়ে ভালো হলেও আন্তর্জাতিক বাজারে বেড়েছে দাবি করে ব্যবসায়ীরা অযৌক্তিকভাবে পণ্যটির দাম বারবার বাড়াচ্ছেন।

দেশে ভোজ্যতেলের লাগাতার ও দফায় দফায় দাম বৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করলেও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় অযৌক্তিক দাম বৃদ্ধির বিষয়টির এখনো সুরাহা হয়নি। এখন পর্যন্ত ভোজ্যতেলের দামের কূলকিনারা করতে পারছে না মন্ত্রণালয়।

বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, দেশে ভোজ্যতেলের দাম না বাড়ানো এবং সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে বারবার অনুরোধের পরও ব্যবসায়ীরা কথা রাখেননি। এক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের বিশ্বাস করা ভুল ছিল। তিনি বলেন, আমরা ব্যবসায়ীদের বিশ্বাস করেছিলাম। এটাই আমাদের ব্যর্থতা। ব্যবসায়ীদের বিশ্বাস করা আমাদের ভুল হয়েছে।

গতকাল সোমবার দুপুরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সম্মেলনকক্ষে ভোজ্যতেলের বাজার ব্যবস্থাপনা নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী এসব কথা বলেন।

এ সময় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ, বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান মো. আফজাল হোসেন, টিসিবির চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল. মো. আরিফুল হাসান, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান, এফবিসিসিআইর সিনিয়র সহ-সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু, সিটি গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. ফজলুর রহমানসহ ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী-আমদানিকারকরা উপস্থিত ছিলেন।

এদিকে ভোজ্যতেলের চলমান সংকটের জন্য মিলার (পরিশোধনাগার কোম্পানি), ডিলার ও খুচরা বিক্রেতারা পরস্পরকে দায়ী করে আসছেন। ডিলার ও খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, মিল মালিকরা পর্যাপ্ত তেল সরবরাহ করছেন না। অন্যদিকে মিলাররা এ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, সরবরাহ কমানো হয়নি। কিছু ডিলার এবং খুচরা দোকানদার দাম বেশি পাওয়ার আশায় মজুত করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করেছেন। আর সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এটি সাময়িক সংকট। ঈদ উপলক্ষে সবকিছু বন্ধ ছিল। এখন ব্যাংকসহ সবকিছু খুলেছে। মিল মালিকরা এলসি খুলবেন, অচিরেই তেলের বাজার স্থিতিশীল হবে।

বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন (বিটিটিসি) সূত্রে জানা গেছে, সয়াবিন, পাম ও সরিষা মিলিয়ে দেশে ভোজ্যতেলের বার্ষিক চাহিদা মোট ২০ লাখ টন। এর মধ্যে স্থানীয়ভাবে উৎপাদন হয় ২ লাখ টন, বাকিটা আমদানি করতে হয়। আমদানির মধ্যে রয়েছে ৫ লাখ টন অপরিশোধিত সয়াবিন, ২৪ লাখ টন সয়াবিনবীজ, যা থেকে তেল পাওয়া যায় ৪ লাখ টন এবং ১১ লাখ টন পামঅয়েল। আর ২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বরে পরিশোধিত, অপরিশোধিত ও তেলবীজ মিলিয়ে ভোজ্যতেল আমদানিতে যে পরিমাণ ঋণপত্র (এলসি) খোলা হয়েছিল, ২০২১-২২ অর্থবছরের একই সময়ে এলসি খোলা হয়েছে তা থেকে ১ লাখ ২৪ হাজার টন বেশি। একই সময়ে এলসি নিষ্পত্তিও হয়েছে ৩৪ হাজার টন বেশি। ফলে আমদানি ও সরবরাহ পরিস্থিতি ভালো।

এদিকে সর্বশেষ দফায় লিটারপ্রতি ৩৮ টাকা দাম বাড়ানোর ঘোষণার আগে পর্যন্ত এক বছরে আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে ৩৮ শতাংশ। ১৮ জানুয়ারিতে ছিল প্রতি টন ১ হাজার ৩৪৬ ডলার, যা এক বছর আগে ছিল ৯৭৮ ডলার। তবে গত ডিসেম্বরে ছিল ১ হাজার ৩১৮ ডলার। একইভাবে অপরিশোধিত পামঅয়েলের দাম ওইসময়ে বেড়েছে প্রায় ৩৫ শতাংশ। অবশ্য আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, জ্বালানি তেলের মুল্যবৃদ্ধিতে পরিবহণ ব্যয় রেড়ে যাওয়ার কারণেও দেশের বাজারে এর প্রভাব পড়েছে।

তবে সর্বশেষ দাম বাড়ার আগে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) এর তথ্য মতে, এক বছরে স্থানীয় বাজারে খোলা সয়াবিন ২৮ শতাংশ, ৫ লিটার বোতলের সয়াবিন ২৫ এবং খোলা পামঅয়েলের দাম ৩৩ শতাংশ বেড়েছে। সূত্র জানায়, ভারতের শুল্ককাঠামো আমাদের ভোজ্যতেল আমদানির শুল্ক ১৮ থেকে ২০ শতাংশ, যা প্রতিবেশী দেশ ভারতে ৫ শতাংশ। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, রপ্তানিকারক দেশগুলোয় উৎপাদন কমে যাওয়া, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ^বাজারে ভোজ্যতেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে মূল্য স্থিতিশীল ও সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে ১০ ভাগ ভ্যাট প্রত্যাহার করা হয়েছে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আমদানিকৃত তেল খালাস, শুল্কায়ন এবং পরিবহণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ডিলারদের নামে ভোজ্যতেলের সাপ্লাই অর্ডারের (এসও) মাধ্যমে তেল উত্তোনের সময় কমিয়ে ১৫ দিন করা হয়েছে।

এছাড়া বাজারে তেলের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে রিফাইনারিগুলো থেকে প্রতিদিনের তেল সরবরাহের তথ্যও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে জমা নেওয়া হচ্ছে। এছাড়া ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তর অনিয়ম ধরতে বিভিন্ন আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। ঈদের আগে অসাধু ব্যবসায়ীরা বাজারে ভোজ্যতেল সরবরাহ না করে মজুতের চেষ্টা করলে অভিযান পরিচালনা এবং তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থাও নিয়েছে অধিদপ্তর। এছাড়া ভোজ্যতেলের সরবরাহ নিশ্চিত করতে মিলগেট থেকে শুরু করে পাইকারি এবং খুচরা পর্যায়ে মনিটরিংও জোরদার করা হয়েছে বলে বলা হচ্ছে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে।

ভোজ্যতেলের লাগাতার মূল্যবৃদ্ধি প্রসঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতি বিবেচনায় দেশে তেলের মূল্যবৃদ্ধির বাস্তবতা মেনে নিন। তবে তিনি যখন যেখানে প্রয়োজন, সেখানে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে উল্লেখ করে বলেন, প্রয়োজনে এ বিষয়ে র‌্যাবের সহযোগিতা নেওয়া হবে। এসময় খুচরা ও পাইকারি পর্যায়ের অনেক ব্যবসায়ী পরিস্থিতির সুযোগ নিচ্ছে বলে দাবি করলেও মিল মালিকদের নিয়ে কোনো মন্তব্য করেননি বাণিজ্যমন্ত্রী। এছাড়া ভোজ্যতেলের দাম নিয়ে কোথায় কোথায় কারসাজি হয়েছে, কোথায় সমস্যা হয়েছে, তা ইতোমধ্যে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং চিহ্নিত ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে দাবি করেন তিনি।

রোজার মধ্যে যাতে মানুষের কষ্ট না হয়, সেজন্য তিনি মিল মালিকদের অনুরোধ করে দাম বৃদ্ধি কিছুটা বিলম্বিত করেছিলেন বলে উল্লেখ করে টিপু মুনশি বলেন, এখন তো দেখছি রোজার ভেতর একবার দাম বৃদ্ধি করাই ভালো ছিল। মিল মালিকরা মেনে নিলেও খুচরা ও পাইকারি বিক্রেতারা ঠিকই দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন।

এদিকে গত মার্চে তেলের দাম বাড়ানোর জন্য ব্যবসায়ীদের প্রস্তাব সরকার ফিরিয়ে দেওয়ার পর থেকে বাজারে সয়াবিন তেলের স্বাভাবিক সরবরাহ নেই এবং সরবরাহও অনেক কমে যায়। গত ঈদের আগে পরিস্থিতির আরো অবনতি হয় এবং বাজার থেকে প্রায় উধাও হয়ে যায় ভোজ্যতেল। ঈদের ছুটি শেষে প্রথম কর্মদিবসে ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে বোতলজাত তেল লিটারে ৩৮ টাকা আর খোলা তেল ৪৪ টাকা বাড়ানোর ঘোষণা দেওয়া হয়। তবে দাম বাড়ানোর পরও সরবরাহ পরিস্থিতি এখনো স্বাভাবিক হয়নি এবং কোনো কোনো জায়গায় ২২০ টাকা লিটার দরেও বিক্রি হতে দেখা গেছে।

এর আগে গত জানুয়ারিতে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দামের বিষয়টি বিচার-বিশ্লেষণ ছাড়া কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে না। তবে সেসময়ও বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, ব্যবসায়ীরা আমাদের না জানিয়ে নিজেরা কিছু দাম বাড়িয়েছিলেন। উল্লেখ্য, দেশে বর্তমানে খুচরা বাজারে বর্তমানে প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৯৮ টাকা, ৫ লিটারের বোতল ৯৬০ টাকা ও প্রতি লিটার খোলা ১৬৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর প্রতি লিটার খোলা পামঅয়েল বিক্রি হচ্ছে ১৪২ টাকায়।

মন্তব্য

Beta version