আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির কারণে ডলারের চাহিদা বাড়ছে। আর চাহিদা বৃদ্ধির কারণে টাকার বিপরীতে ডলারের মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাজারে ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক সীমিত পরিমাণে ডলার বিক্রি করছে। তারপরও বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখা যাচ্ছে না।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, বাজারের চাহিদার কারণে ডলারের দাম বাড়ছে। ডলারের চাহিদা যাতে কমে এ জন্য কিছু নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এরপরও যদি ডলারের চাহিদা বেড়েই চলে সেক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে আপাতত পর্যবেক্ষণে থাকবে। ব্যাংকপাড়ায় ডলারের হাহাকার চলছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত মূল্য ৮৬ টাকা ৭০ পয়সা, যাকে আন্তঃব্যাংক রেট বলা হয়। এ সপ্তাহে এক লাফে ২৫ পয়সা বেড়েছে। তবে খোলা বাজারে ৯০ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এ অবস্থায় ডলারের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের জন্য বিপর্যয় দেখছেন ব্যবসায়ীরা।
করোনা-পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার কার্যক্রম শুরু হওয়ার কারণে দেশে দেশে ডলারের চাহিদা বেড়েছে। কিন্তু সে পরিমাণে উৎপাদন হচ্ছে না। সেই সঙ্গে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে আন্তর্জাতিক সরবরাহ ও যোগাযোগ। মূল্যস্ফীতির অবস্থা তৈরি হয়েছে। এতে আমদানি ব্যয় বেড়ে গেছে। এর প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের বাণিজ্য পরিস্থিতিতে। অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে বাণিজ্য ঘাটতি। যেসব কারণে ডলারে চাপ তৈরি হয়েছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রে সুদ বেড়ে যাওয়া ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ডলারের চাহিদাকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। ২০২১ সালের আগস্টের শুরুতে আন্তঃব্যাংকে প্রতি ডলারের মূল্য ৮৪ টাকা ৮০ পয়সা ছিল। চলতি বছরের ৯ জানুয়ারি বেড়ে ৮৬ টাকায় পৌঁছায়। এরপর ২২ মার্চ পর্যন্ত এ রেটেই স্থির ছিল। পরে গত ২৩ মার্চ আন্তঃব্যাংকে আরো ২০ পয়সা বেড়ে ৮৬ টাকা ২০ পয়সায় দাঁড়ায়। ২৭ এপ্রিল আরো ২৫ পয়সা বেড়ে দাঁড়ায় ৬ টাকা ৪৫ পয়সা। সর্বশেষ ১০ মে আরো ২৫ পয়সা বাড়ে। ফলে এখন আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে ডলারের মূল্য গিয়ে দাঁড়ায় ৮৬ টাকা ৭০ পয়সা। যা এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ রেকর্ড মূল্য।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, মূলধনীয় যন্ত্রপাতি ও পণ্য আমদানি বেশি হওয়ায় ডলারের চাহিদা বেশি। তাই ডলারের রেট বেড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজার বিশ্লেষণ করে ডলারের দাম ঠিক করে। কোনো সময় টাকার অবমূল্যায়ন করে। এখন বাজার পরিস্থিতি বিবেচনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করেছে এখন ডলারের দাম বাড়ানো উচিত। তাই বাড়িয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, গত বছরের চেয়ে আমদানি ব্যয় বেড়েছে। গত বছর আমদানি ব্যয় বেড়েছিল ১৯.৭৩ শতাংশ, এবার বেড়েছে ৪৬ দশমিক ৬৮ শতাংশ। গত বছর বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ১ হাজার ২৩৬ কোটি ডলার; এবার ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ২৩০ কোটি ডলার। গত বছর প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৩৬ শতাংশ, এবার ১৬ শতাংশ সংকোচন হয়েছে। স্বস্তি শুধু রপ্তানি আয়ে, গত বছর রপ্তানি আয় হয়েছিল ১৫ দশমিক ১০ শতাংশ, এবার আয় হয়েছে ৩৫ দশমিক ১২৪ শতাংশ। এসব কারণে ডলারের ওপরে চাপ তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সূত্র জানায়, আগে থেকেই সরকার ডলার বিক্রি করে বাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছে। এর ফলও পাওয়া গেছে। পরে ডলারের দাম আরো বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে বিলাসী পণ্যে মার্জিন আরো ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়েছে এবং বিদেশ থেকে দেশে আসার সময় কোন ব্যক্তি ৫ হাজার ডলার পর্যন্ত সঙ্গে করে নিয়ে আসতে পারত, নতুন ঘোষণায় তা বৃদ্ধি করে ১০ হাজার ডলার করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, টাকার বিপরীতে ডলারের মূল্য ধরে রাখতে এরপর আপাতত আর কোনো ব্যবস্থা নেই।
ডলারের এই দাম বৃদ্ধির কারণে অর্থনীতিতে যতটা বিপদ হবে তার চেয়ে বেশি বিপদ হবে ডলার বিক্রি করে ডলার বাজার নিয়ন্ত্রণ রাখার চেষ্টা। এজন্য ডলার বিক্রি না করে ডলার মূল্য পরিস্থিতি আরো খানিক বৃদ্ধি হতে দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন।
তিনি ভোরের আকাশকে বলেন, রিজার্ভ যে পর্যায়ে আছে এর চেয়ে কমতে দেওয়া ঠিক হবে না। রিজার্ভের চেয়ে কমলে আমদানি ব্যয়ে ঝুঁকি তৈরি হবে। বরং ডলারের মূল্য কিছুটা বৃদ্ধি পেলে আপনা-আপনি ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণ কিছুটা স্মথ হয়ে আসবে। বিলাসী ব্যয় কমে আসবে। ডলারের মূল্য বাংলাদেশে অস্বাভাবিকভাবে টিকিয়ে রাখা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে সুদ হার বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে ইউএস ডলার সারা দুনিয়াতেই চাহিদা বেড়েছে।
বিশ্বজুড়ে মূল্যস্ফীতি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ডলারের চাহিদা বেড়েছে। ফলে বাংলাদেশেও ডলারের মূল্য বৃদ্ধি স্বাভাবিক। কিন্তু বাংলাদেশ রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করে কৃত্রিমভাবে ডলারের মূল্য ধরে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তানে মূল্য বেড়েছে; ডলারের এই মূল্য বৃদ্ধি স্বাভাবিক। তিনি বলেন, টাকার বিপরীতে ডলারে মূল্যবৃদ্ধি হলে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্সও বৃদ্ধি পাবে। ফলে ডলারের মূল্য আরো খানিক বাড়তে দেওয়া উচিত।
মন্তব্য