বাজার স্বাভাবিক রাখতে ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতি বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে ভোজ্যতেলের প্রতি লিটারে ৩৮ টাকা দাম বাড়ানোর বিষয়টি ঠিক করা হয় ৫ মে। নতুন দামে পরিবেশকরা বাজারে তেল সরবরাহের কথা বললেও চাহিদামত তেল পাচ্ছে না ভোক্তারা।
অভিযোগ রয়েছে, ঈদের আগে বাজার থেকে উধাও হয়ে যাওয়া সয়াবিন তেলের বোতল এখন দোকানে পাওয়া যাচ্ছে, যা নতুন দামে বিক্রি করতে চাচ্ছে দোকানিরা। এতে বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে পণ্যটি উদ্ধার ও জব্দ করছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। ফলে কিছুসংখ্যক ভোক্তার সন্তুষ্ট হলেও ব্যবসায়ীরা মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন।
ভোক্তা স্বার্থসংশ্লিষ্টরা বলছেন, দাম বাড়ার পরও বাজারে তেল না থাকাটা ভোক্তার সঙ্গে তেলের বাজার স্বাভাবিক প্রতারণা। এদিকে উৎপাদন ও সরবরাহের পাশাপাশি সেবা সীমিতকরণ বা নিয়ন্ত্রণের অভিযোগে দেশের ভোজ্যতেল আমদানিকারক ৮ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করেছে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন।
অন্যদিকে সারা বছর বাজার স্বাভাবিক রাখতে ভোজ্যতেলের মোট আমদানির ২০ শতাংশ সরকারকে আমদানি করার আহ্বান জানিয়েছেন ভোজ্যতেল আমদানি প্রতিষ্ঠানের মালিকরা। আর দাম নিয়ন্ত্রণে খোলা ভোজ্যতেল বিক্রি বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে এফবিসিসিআই। সব মিলিয়ে দায় চাপানোর এ সময়ে ভোজ্যতেলের বাজার ঠিক কবে স্বাভাবিক হবে তা এখনো নিশ্চিত করা যাচ্ছে না।
উল্লেখ্য, নতুন দামে প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৯৮ টাকা। আর ৫ লিটারের বোতজাত ৯৮৫ টাকা। খোলা সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ১৮০ এবং খোলা পামতেল প্রতি লিটার ১৭২ টাকায় বিক্রি করার সিদ্ধান্ত রয়েছে।
বাজার পরিস্থিতি বিষয়ে এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেন, ব্যবসায়ীদের মধ্যে ৯৯ শতাংশ সৎ ও নীতিবান ব্যবসায়ী। বাকি মাত্র ১ শতাংশের জন্য খারপ কথা শুনতে হচ্ছে। আমি ব্যবসায়ীদের নেতা, কিন্তু অসাধু ব্যবসায়ীদের নেতানা। এজন্য বাজার কমিটি বা দোকান মালিক সমিতির নেতাদের নিজ নিজ বাজার তদারকি করে অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে প্রশাসনকে সঙ্গে নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
আর পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি গোলাম মাওলা ভোরের আকাশকে বলেন, ঢালওভাবে ব্যবসায়ীদের দায়ি কের যে অভিযান চলছে, তার কোনো ভিত্তিনেই। তারা (ভোক্তা অধিদপ্তর) নিজেরা জানে না, একজন ব্যবসায়ী কতদিন তেল মজুদ রাখতে পরবে। এর সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকলেও অহেতুকভাবে পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের হেনস্তা করছে ভোক্তা অধিদপ্তর। দ্রুত সময়ের মধ্যে অভিযান বন্ধ ও ভোজ্যতেলের মজুদ নীতিমালা না হলে বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে না বলে।
এদিকে ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজকরা সংগঠনগুলো বলছে, ব্যবসায়ীদের দাবির প্রেক্ষিত্রে সরকার দাম বাড়ালেও তা কার্যকর হচ্ছে না। বাজারে চাহিদার ভিত্তিতে তেল পাওয়া যাচ্ছে না, যা ভোক্তার সঙ্গে প্রতারণা বলে মনে করেন তারা।
ভোরের আকাশের সঙ্গে মোবইল ফোন আলাপে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, গণমাধ্যমের খবরে জানতে পারলাম, ক্রেতারা এখন পুরোনো বোতলের তেল বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। কিন্তু ঈদের আগে যে পরিস্থিতি ছিল, তখন এসব তেল কোথাই ছিল! বাজারে আগের দামের তেল নতুন দামে বিক্রি করতে চাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। এটা অন্যায়। তবে মনে হচ্ছে, আগের মজুদের কারণে ভোক্তা অধিদপ্তর যে অভিযান দিচ্ছে, তাতে অসাধু ব্যবসায়ীরা আতঙ্কিত। আর দাম বাড়ার বিষয়ে বলব, আন্তর্জাতিক বাজার যেহেতু বাড়তি, তাতে সরকারের কিছু করার নেই। এখন দাম বাড়লেও যখন কমবে, তখন যেন কমানো হয়। আর অভ্যন্তরীণ বাজারে তদারকি অব্যাহত থাকলে ভোজ্যতেলের দাম ও প্রাপ্ত পর্যক্রমে স্বাভাবিক হয়ে আসবে।
এদিকে উৎপাদন ও সরবরাহের পাশাপাশি সেবা সীমিতকরণ বা নিয়ন্ত্রণের অভিযোগে দেশের ভোজ্যতেল আমদানিকারক ৮ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করেছে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন। গত বুধবার পৃথকভাবে এসব মামলা হয়েছে বলে ভোরের আকাশকে নিশ্চিত করেন কমিশনের চেয়ারপারসন মফিজুল ইসলাম।
তিনি জানান, কমিশনের কাজ হচ্ছে, বাজারে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠা একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করছে কিনা, তা পর্যবেক্ষণ করা। আবার কেউ যদি প্রতিযোগিতা বিরোধী আচরণ করে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এ লক্ষ্যে প্রতিযোগিতামূলক বাজার নিশ্চিতে স্বাধীন অনুসন্ধান ও প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণে কমিশন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এসব মামলা করেছে। ইতোমধ্যে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের মামলার শুনানিতে অংশ হিসেবে নোটিশও পাঠানো হয়েছে।
কমিশনের মামলায় অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠান হলো- সিটি এডিবল অয়েল লিমিটেড (তীর), বাংলাদেশ এডিবল অয়েল লিমিটেড (রূপচাঁদা), মেঘনা ও ইউনাইটেড এডিবল অয়েল রিফাইনারি লিমিটেড (ফ্রেশ), বসুন্ধরা অয়েল রিফাইনারি মিল (বসুন্ধরা), শবনম ভেজিটেবল অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড (পুষ্টি), এস আলম সুপার এডিবল অয়েল কোম্পানি লিমিটেড (এস আলম), প্রাইম এডিবল অয়েল লিমিটেড (প্রাইম) ও গ্লোব এডিবল অয়েল লিমিটেড (রয়েল শেফ)। এসব প্রতিষ্ঠানকে আগামী ১৮ ও ১৯ মে শুনানির জন্য ডেকেছে প্রতিযোগিতা কমিশন।
মফিজুল ইসলাম ভোরের আকাশকে বলেন, ভোজ্যতেলের বাজার অস্থিতিশীল হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বাজার স্টাডি করে যাচ্ছে। আমাদের অনুসন্ধান ছিল কারা কারসাজির মাধ্যমে বাজারে অসম প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করছে। তদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনা। এখন সে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। শুনানিতে অভিযোগ প্রমাণিত হলে দায়ী ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কমিশন ব্যবস্থা নেবে।
এছাড়া ভোজ্যতেলের সঙ্গে অন্য কোনো পণ্য ক্রয় করতে হবে- এমন শর্ত আরোপ করে ক্রেতাকে অন্যান্য পণ্য ক্রয়ে বাধ্য করা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে, যা ভোক্তার অধিকার মারত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হচ্ছে। এ-সংক্রান্ত অবিযোগ, তথ্য-উপাত্ত যাছাই করতে গতকাল বৃহস্পতিবার সভা করেছে ভোক্তা অধিদপ্তর । এতে সভাপতিত্ব করেন সংস্থার মাহপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান ।
এ প্রসঙ্গে গত বুধবার ভোজ্যতেলের বাজার পরিস্থিতি বিষয়ে এফবিসিসিআইর সভায় খুচরা ব্যবসায়ীরা দাবি করেন, বাজারে যখন তেলের সংকট দেখা দিল, তখন পরিবেশকরা খুচরা ব্যবসায়ীদের শর্ত দিতে থাকে তেল নিতে হলে সঙ্গে অন্য পণ্য (চা পাতা বা বিস্কুট) নিতে হবে এবং তা নির্দিষ্ট করে দিয়েছে কোম্পানি। এতে খুচরা ব্যবসায়ীরা বাধ্য হয়ে ক্রেতাদের নিকট শর্তারোপ করতে হচ্ছে। এ পরিস্থিতির জন্য পরিবেশক ও মূল কোম্পানিকে দায়ী করেন খুচরা ব্যবসায়ীরা।
মন্তব্য