-->

রিজার্ভ থেকে ছেড়ে ডলার বাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা আত্মঘাতী

জাফর আহমদ
রিজার্ভ থেকে ছেড়ে ডলার বাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা আত্মঘাতী
ড. জাহিদ হোসেন।

ডলারের মূল্যকেন্দ্রিক জোর আলোচনা চলছে। বাংলাদেশ ব্যাংকে রিজার্ভ ছেড়ে ডলার বিক্রি করে বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছে; পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রাখা যাচ্ছে না। ডলার বাজারে অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক মার্কেটে প্রতিযোগী দেশগুলো ডলারের বিপরীতে নিজ দেশের মুদ্রার বড় ধরনের অবমূল্যায়ন করেছে। বাংলাদেশ সে তুলনায় টাকার মান ধরে রেখেছে। টাকার তেজি ভাব কতটা ধরে রাখা সম্ভব। এ বিষয়ে কথা হয় বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক জাফর আহমদ।

প্রশ্ন : ডলার বাজারে অস্থিরতা বিরাজ করছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ডলার বাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। রিজার্ভও বিপৎসীমার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। এ মূহূর্তে ডলার মূল্য পরিস্থিতি সামাল কোন পথে ?

ড. জাহিদ হোসেন: একটি বিষয় হলো, আমাদের বহিঃবাণিজ্যের ভারসাম্যহীনতা চলছে মাসের পর মাস। ফলে ডলার বাজারে চাহিদা ও জোগানের মধ্যে একটি ভারসাম্যহীনতা বিরাজ করছে। এটা সামাল দেওয়ার জন্য রিজার্ভ ব্যবহার করা কোন সমাধান নয়, কারণ রিজার্ভ ফুরিয়ে গেলে কি করবেন। এই সমস্যার অতি শিগগিরই সমাধান করা সম্ভব নয়। সে জন্য ডলারের এক্সচেঞ্জ রেট মানে ডলারের দাম বৃদ্ধি অ্যালাউ করা দরকার। এতদিন ডলার বিক্রি করে ডলারের দাম কমিয়ে রাখা হয়েছে, ডলারের দাম যতটা বৃদ্ধির দরকার ছিল সেটা হতে দেওয়া হয়নি। এখন প্রশ্ন হলো ডলারের দাম বাড়লে কারেকশনটা কীভাবে হচ্ছে। কারেকশন দুই দিক থেকে হয়।

প্রথমত: চাহিদার দিক থেকে। ডলারের দাম বাড়লে কিছু কিছু আমদানি ব্যয় কমবে। সেক্ষেত্রে আমরা বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবহার করে ফেলি। যেমন, বিদেশ ভ্রমণ করা, বিদেশে চিকিৎসা করতে যাওয়া, বিলাসি পণ্য আমদানি করা এগুলো কমবে। সেই সঙ্গে এক্সপোর্ট আয় বৃদ্ধিরও একটি সুযোগ তৈরি হয়। যদিও এটা দীর্ঘমেয়াদে নয়। কতটা হবে এটা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। কিন্তু রেমিট্যান্সের দিক থেকে এটা হতে বেশি সময় লাগে না। সেই দিক থেকে একদিকে চাহিদা কমল, অন্যদিকে জোগান বাড়ল-এর মাধ্যমে ভারসাম্যহীনতা কমে যায়।

দ্বিতীয় হলো, জোগানের দিক থেকে। ফর্মাল আর ইনফর্মালের ব্যবধানটা কমে গেলে ফর্মাল চ্যানেলে যে রেমিট্যান্সটা আসত, ব্যবধান থাকার কারণে ইনফর্মাল চ্যানেলে পাঠালে পাঁচ টাকা বেশি পাচ্ছে। অর ব্যাংকিং চ্যানেলে পাঠালে পাঁচ টাকা কম পাচ্ছে। ব্যাবধানটা যদি কমে যায় তাহলে ইনফর্মাল চ্যানেলে ইনসেনটিভটা কমে যায়। সেই দিকে থেকে মুদ্রা বাজারেও জোগানটাও বাড়বে। সেই সঙ্গে আমদানি ব্যয় কমানোর জন্য যে সব উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে এলসি মার্জিন বাড়িয়ে দেওয়া, বৈদেশিক মুদ্রার লাগেজ রুলসটা শিথিল করা, কম প্রয়োজনীয় আমদানিগুলো কমিয়ে আনা, এসব সংশোধনীগুলো সহায়তা করবে। আমদানি ব্যয় যদি কমে যায় তাহলে ভারসাম্য হীনতা কমাতে কিছুটা সহায়তা করবে।

প্রশ্ন: তাহলে বাংলাদেশ ছোটখাটো যে উদ্যোগুলো নিচ্ছে, এ সপ্তাহেও ২৫ পয়সা টাকাকে অবমূলায়ন করলÑ

ড. জাহিদ হোসেন : ছোটখোট উদ্যোগে কোনো ফল পাওয়া যায় না। বাজারে ডলার ছেড়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা চেষ্টা, এটা করা এখন ঝুঁকিকর হয়ে গেছে। রিজার্ভ যে পর্যায়ে আছে এটা একটি ঝুঁকি পর্যায়। কিন্তু ডলার ছেড়ে ডলার বাজার নিয়ন্ত্রণ চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। সম্প্রতি ডলারের মূল্য ২৫ পয়সা বাড়িয়েছে, এই ২৫ পয়সা ৩০ পয়সা বাড়িয়ে তো সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হচ্ছে না। বাংলাদেশ এখন যেটা করতে হবে সেটা হলো রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি বন্ধ করা। বাংলাদেশ ব্যাংক দেখতে পারে বাজারের অবস্থা কী হয়। বাজার যদি অস্থির হয়ে যায় বা সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করে, তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার ছেড়ে সেটা বন্ধ করতে পারে। রিজার্ভকে সুরক্ষা দিয়ে বাজার কোন দিকে যাচ্ছে সেটা দেখা উচিত।

বাংলাদেশে ডলারের যে হারে দাম বেড়েছে অঞ্চলিক বাজার, উন্নয়নশীল দেশগুলো ও দ্রুত উন্নতি হচ্ছে, এসব দেশ তুলনামূলক কম হারে বেড়েছে। বাংলাদেশে গত এক বছরে ডলারের মূল্য ৫ শতাংশও বাড়েনি। ৮৪ শতাংশের মতো ছিল সর্বশেষ ৮৬ দশমিক ৭০ শতাংশ হয়েছে। মানে হলো গত এক বছরে দুই/আড়াই শতাংশ বেড়েছে। আমাদের প্রতিযোগী দেশ থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া ও ভারতে তার চেয়ে বেশি হারে বেড়েছে; ভারতে তো গত ছয় মাসেই ৫ শতাংশের বেশি অবমূল্যায়ন হয়েছে। সে জন্য বলছি, আমাদের রিজার্ভটাকে হাতে রাখতে হবে। রিজার্ভ হাতে না থাকলে, বৈদেশিক বাণিজ্যের ভারসাম্যহীনতা থেকে যাবে। তখন তো কম সময়ে বড় ধরনের অ্যাডজাস্টমেন্ট করতে দিতেই হবে। ওই সিচুয়েশনে যাওয়া ঠিক হবে না।

প্রশ্ন: ডলার ছেড়ে টাকার মান ধরে রাখার চেষ্টা করে তো লাভ হচ্ছে না?

ড. জাহিদ হোসেন : সেটা করে তো ক্ষতি হচ্ছে।

প্রশ্ন: নিতপণ্যের দামও নিয়ন্ত্রণে রাখা যাচ্ছে না?

ড. জাহিদ হোসেন : হ্যাঁ, সে কথাই বলছিলাম। তারপরও মূল্যস্ফীতি বেড়ে চলেছে। এটা করে লাভ কি! সেখানে হয়তো যুক্তি দেখানো হচ্ছে। ডলার না ছাড়লে তো মূল্যস্ফীতি আরো বেশি হতো। কিন্তু সেটা তো আপনাকে মেনে নিতে হবে। কারণ বাজেটের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। এখানে তো উভয় সংকট, দাম বাড়তে দিতে হলে একদিকে বাহির্বাণিজ্যে সুবিধা অন্যদিকে মূল্যস্ফীতি। ভারসাম্যহীনতা বাড়তে দিতে হলে আবার ডলারের দাম বাড়তে দিতে হবে। ডলারের দাম বাড়লে আবার মূল্যস্ফীতির ওপরও চাপ বেড়ে যাবে, এটাই বাস্তবতা। এখন কথা হলো মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়ল, সেটাকে আমি কীভাবে হ্যান্ডেল করি। ওইটাকে হ্যান্ডেল করতে হলে ফিস্কেল পলিসি দিয়ে হ্যান্ডেল করতে হবে।

এখানে দুটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। একটি হলো, মূল্যস্ফীতি ইতোমধ্যে বেড়ে গেছে। ভবিষতে আরো বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ডলারের দাম বাড়লে মূল্যস্ফীতি নিশ্চিতভাবে আরও বাড়বে। সেক্ষেত্রে সম্প্রসারণ নীতি থেকে আমাকে বিরত থাকতে হবে। কারণ একটি সম্প্রসারণমূলক বাজেট থেকে সংযত হতে হবে। দ্বিতীয়ত: হলো সরকারি ব্যয়ের কারণে চাহিদার ওপর অতিরিক্ত কোনো চাপ যেন না পড়ে। তৃতীয়ত: হলো মূল্যস্ফীতির চাপের সমস্যা। এ জন্য সহায়তার ব্যবস্থা করতে হবে। সেক্ষেত্রে অর্থায়নের প্রশ্নটি আসে, একদিকে আপনি বলছেন সম্প্রসারণমূলক বাজেট করা যাবে না। অন্যদিকে যদি সহায়তা কর্মসূচি একটি সমাধান হলো, এর একটি উদহারণ নেই। ধরুন এখন ডলারে দাম আছে ৮৬.৭০ টাকা। এটা যদি আরো বেড়ে যায় তাহলে তো রেমিট্যান্সে যে প্রণোদনা ২.৫ শতাংশ দেওয়া হয় সেটা দেওয়ার প্রয়োজন হয় না। কারণ এমনিতেই সেটা পেয়ে যাচ্ছে বাজারে ডলারের অ্যাডজাস্টমেন্টের কারণে। ওখানেই তো আপনার ৪/৫ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি সাশ্রয় হয়ে যাচ্ছে। এখানে অন্য জায়গুলোতে অগ্রাধিকার ঠিক করে কোথায় খরচ কমানো বা বাড়নো যায়। সে ধরনের সুযোগ কিন্তু অনেক আছে। ওইভাবে মোকাবিলা করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প দেখি না।

প্রশ্ন: ফিস্কেল পলিসির কথা বলছিলেন, কেউ কেউ মনে করছে বিলাসী পণ্য আমদানিতে মার্জিন ২৫ শতাংশ বাড়িয়ে যতটা কাজ হচ্ছে বা হবে। তার চেয়ে বেশি কাজ হবে যদি এ সব পণ্যে শুল্ক বাড়িয়ে নিরুৎসায়িত করা?

ড. জাহিদ হোসেন : এটা আরো একটি বিকল্প। এলসিতে ডিউটি বাড়িয়ে দেওয়ার চেয়ে সরাসরি পণ্যের দামটা বাড়িয়ে দেওয়া আরো ভালো হয়। এলসি মার্জিন বাড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রেও কাজ হবে। ওইসব পণ্যের দাম বাড়বে। আমদানিতে শুল্ক বসানোর সুবিধা হলো, এর মাধ্যমে সরকারের কিছুটা সুবিধা আসতে পারে।

প্রশ্ন: যদি অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনা করা যায়?

ড. জাহিদ হোসেন : ডলারের দাম বৃদ্ধির যেসব কারণ তা হলো সরবরাহ ঘাটতি বা আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি শুধুই তাই না। আন্তর্জাতিকভাবে ডলার এমনিতেই শক্তিশালী। এর দুটি কারণ, এক হলো সুদের হার বাড়ছে।

দ্বিতীয়ত হলো, বৈশ্বিক অনিশ্চয়তা আরো বেশি। যার কারণে বিনিয়োগকারীরা নিরাপদ মুদ্রার দিকে যাওয়ার চেষ্টা করছে। নিরাপদ মুদ্রা হিসাবে ডলার এক নম্বর স্থানে। যেখানেই যা হোক না কেন ডলারের শক্তিশালী স্থানটার পরিবর্তন হয়নি। সেটিই খুঁজে বিনিয়োগকারীরা ডলারের দিকে যায়। ওইটার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি হিউজ। তা সত্ত্বেও ডলার শক্তিশালী হচ্ছে, কেন ? কি কারণে শক্তিশালী হচ্ছে!

প্রশ্ন: এখন আলোচনায় শ্রীলঙ্কা। অনেকেই বলার চেষ্টা করছে বাংলাদেশের অবস্থা শ্রীলঙ্কার মত হবে, নাকি হবে না। বাংলাদেশের অনেকগুলো ইতিবাচক দিক আছে। শ্রীলঙ্কার মতো হওয়ার সম্ভাবনা নেই। আপনি বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?

ড. জাহিদ হোসেন: এটা নির্ভর করছে ম্যানেজমেন্টর ওপর। শ্রীলঙ্কা যে ধরনের নীতি গ্রহণ করেছিল, এখন আমার কাছে সব চেয়ে বড় উদ্বেগের জায়গা হলো এতগুলো রিজার্ভ যদি খরচ করে ফেলি তাহলে তো ওই ধরনের অবস্থা সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। আপনার হাতে যখন ডলার আছে, রিজার্ভ আছে সেই অবস্থা থেকে আপনি ডলারের এক্সচেঞ্জ রেটটা অ্যাডজাস্টমেন্টটা হতে দেন। রিজার্ভ বিক্রি বন্ধ করার কারণে যদি বাজারে কোনো অস্থিরতা সৃষ্টি হয় তাহলে অস্থিতিশীলতা তৈরি হয় বা কোনো স্পেকুলেটাররা এটার সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করে তাহলে আপনি বাজারে নামতে পারবেন; ডলার ছেড়ে রোধ করতে পারবেন। তখন ওরাই মার খাবে। সে জন্য তারা ওই চেষ্টা করবে না। রিজার্ভ যদি না থাকে তাহলে ওই ধরনের খেলোয়াররাও মাঠে নেমে পড়ে। আপনার কাছে ধারালো অস্ত্রটা হাতে নেই। তখন আপনি হুকুম দিয়ে বলবেন এত টাকার ওপরে ডলার বিক্রি করতে পারবে না। হাতে ডলার না থাকলে তখন ওই হুকুম তো কেউ মানবে না। যদি আপনার হাতে ডলার শর্টেজ থাকে বা হাতে ডলার না থাকে। সে জন্য আপনার হাতে যতদিন অস্ত্রটা আছে ততদিন সুযোগ সন্ধানীরা জেনে অপচেষ্টা করবে না। আপনি যদি রিজার্ভটা খরচ করে ফেলেন তারপর কি করবেন? শ্রীলঙ্কায় এক সপ্তাহে ডলারের বিপরীতে রুপির ১৫ শতাংশ দাম কমেছিল। এর ফলে অনেক জটিলতা তৈরি হয়। আপনাকে ধন্যবাদ।

ড. জাহিদ হোসেন : আপনাকেও ধন্যবাদ।

মন্তব্য

Beta version