পুঁজির নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন লাখ লাখ বিনিয়োগকারী। পুঁজি রক্ষা করতে হিমশিম খাচ্ছেন তারা। প্রতিদিন সূচকের পতনের পাশাপাশি কমছে বাজার মূলধন। এতে প্রতিদিনই তাদের পোর্টফোলিও থেকে পুঁজি কমছে। যে কারণে লাভের বদলে প্রতিনিয়তই লোকসানের হিসাব কষছেন তারা। পুঁজি বাঁচাতে সমন্বয় করেও কূল পাচ্ছেন না। পুঁজিবাজার থেকে বের হয়ে যাবেন এমন উপায়ও নেই।
বাজারচিত্রে দেখা যায়, শেয়ার ও ইউনিটেরদর পতনের ধারা অব্যাহত রয়েছে। সম্প্রতি প্রতিনিয়তই হ্রাস পাচ্ছে লেনদেন হওয়া সিংহভাগ কোম্পানির শেয়ারদর। এর জের ধরে লাগামহীনভাবে কমছে সূচক। বিনিয়োগকারীদের চোখের সামনে প্রতিদিন হাজার হাজার কোটি টাকা কমছে বাজার মূলধন।
প্রাপ্ত তথ্যমতে গত ছয় দিনের পতনে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) তালিকাভুক্ত কোম্পানি ও মিউচুয়াল ফান্ডের শেয়ার এবং ইউনিটের বাজার মূলধন কমেছে ২৭ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে বাজার মূলধন কমেছে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে গত সোমবার এক দিনের পতনে বাজার মূলধন কমেছে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি। সর্বশেষ গতকাল একদিনে বাজার মূলধন হ্রাস পেয়েছে সাত হাজার কোটি টাকার বেশি। ছয় কার্যদিবস আগে বাজার মূলধন ছিল পাঁচ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা। গতকাল তা নেমে দাঁড়িয়েছে পাঁচ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা।
এদিকে গত ছয় কার্যদিবসের ব্যবধানে ডিএসইর প্রধান সূচক কমেছে ৩৮৯ পয়েন্ট। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে সূচক কমেছে ৬৫ পয়েন্ট করে। এর মধ্যে গতকাল একদিনে সূচক হ্রাস পেয়েছে ৯৩ পয়েন্টে বেশি। ছয় কার্যদিবস আগে ডিএসইর প্রধান সূচকের অবস্থান ছিল ছয় হাজার ৬৯৮ পয়েন্টে। সর্বশেষ গতকাল তা কমে দাঁড়িয়েছে ছয় হাজার ৩০৯ পয়েন্টে। একই সময়ে লেনদেন ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা থেকে ৭০০ কোটি টাকায় নেমে এসেছে।
বিষয়টি নিয়ে কথা বললে লুৎফর রহমান নামে এক বিনিয়োগকারী ভোরের আকাশকে বলেন,“২০১০ সালের ধসের রেশ এখনও কাটিনি। এর মধ্যে চলতি বছলে শুরুতে আবারও নতুন বিনিয়োগ করি। কারণ এই সময়ে বিএসইসিসহ বাজার সংশ্লিষ্টরা বলেছিলেন পুঁজিবাজার ভালো হবে। তাছাড়া বাজারে বিদেশি বিনিয়োগ আসবে এ জন্য রোড় শো করা দেখে বাজারের প্রতি আরও আকৃষ্ট হই। এখন দেখছি সব হিসাবেই উল্টে যাচ্ছে। লাভের বদলে প্রতিদিনই লোকসানের হিসাব করছি। পুঁজি বাঁচাতে সমন্বয় করেও কূল পাচ্ছি না। এই অবস্থা চলতে থাকলে আমাদের অবস্থা আরও খারাপ হবে। ইতিমধ্যে আমার মত লাখ লাখ বিনিয়োগকারী তাদের পুঁজি হারিয়েছেন।”
বছরের শুরু থেকে পুঁজিবাজারে পতন থাকলেও বর্তমানে এই পরিস্থিতি আরও প্রকট হয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং শ্রীলঙ্কা ইস্যুতে বাজারে পতন আরও ভারী হয়। দুইটি ইস্যুতেই পুঁজিবাজারে ব্যাপক দর পতন হয়। যদিও এর তেমন কোন ভিত্তি খুঁজে পাননি পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া বাজার পতনের মার্জিন ঋণ সমন্বয় করার বিষয়টিও তুলে আনছেন অনেককে। কিন্তু সব বিষয়ে ছাপিয়ে গেছে বিনিয়োগকারীদের মনোগত কারণ। তারা মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ে শেয়ার বিক্রির কারণেই এমন ঘটনা ঘটছে বলে মনে করেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।
বিষয়টি নিয়ে কথা বললে ডিএসইর পরিচালক শাকিল রিজভী বলেন, বাজারের এখন যে পরিস্থিতি তা অস্বাভাবিক। তবে এর জন্য বিনিয়োগকারীদের বেহিসাবি চিন্তাভাবনা দায়ী। কোন একটি ইস্যু এলেই তারা এই ইস্যু নিয়ে নেগেটিভ চিন্তা করতে থাকেন। এর প্রভাব কতটুকু তা তারা চিন্তা করেন না। উল্টো হাতে থাকা শেয়ার বিক্রি করে দেন। এতে বাজারের পতন আরও ভারী হয়। তাদের উচিত বুঝেশুনে বিনিয়োগ করা।
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যুদ্ধ ইস্যুকে কাজে লাগাতে যাচ্ছে একটি চক্র। যুদ্ধের প্রভাবে দেশের পুঁজিবাজারে তেমন না থাকলেও তারা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ভয় ঢুকিয়ে দিচ্ছে। এটা করছে তারা কমদরে শেয়ার কেনার জন্য। আর এই ফাঁদে পা দিচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। তারা ভয়ে শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন। এতে করে ওই চক্রটিও বেশি সুবিধা পাচ্ছে।
পতন ঠেকাতে সম্প্রতি দুই পদক্ষেপ নিয়েছে বিএসইসি।এর মধ্যে রয়েছে সার্কিট ব্রেকার বা একদিনে শেয়ার দাম বৃদ্ধি বা কমার সর্বোচ্চ সীমা বেঁধে দেয়া এবং বাজার স্থিতিশীলতায় গঠিত নতুন তহবিল থেকে ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ। নতুন নিয়মে শেয়ার দর সর্বোচ্চ বাড়তে পারবে ১০ শতাংশ। আর কমতে পারবে ২ শতাংশ। পাশাপাশি স্ট্যাবলাইজড ফান্ড (স্থিতিকরণ তহবিল) থেকে ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের জন্য সরকারি বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান আইসিবিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একইভাবে প্রতিটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের ২০০ কোটি টাকা করে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের কথা রয়েছে। এছাড়া যাতে কোনো ধরনের কারসাজি না হয় সেজন্য বিএসইসিসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো বাজারের প্রতি কঠোর নজরদারি রেখেছে। কিন্তু তারপরও স্বাভাবিক হচ্ছে না বাজার।
প্রসঙ্গত, সম্প্রতি আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি সার্কুলারের কারণে বাজারে পতন নেমে আসে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তখন পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কোন কোন উপাদান পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য হবে সে বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
সার্কুলারে বলা হয়, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ধারণকৃত পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত সব প্রকার শেয়ার, ডিভেঞ্চার, করপোরেট বন্ড, মিউচুয়াল ফান্ড ইউনিট এবং পুঁজিবাজারের অন্যান্য নিদর্শনপত্রের বাজার মূল্য হয়। তবে নিজস্ব সাবসিডিয়ারি কোম্পানি বা কোম্পানিসমূহকে প্রদত্ত ইক্যুয়িটি দীর্ঘমেয়াদি ইক্যুয়িটি বিনিয়োগ, ভেঞ্চার ক্যাপিটাল, সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি (বিডি) লি. স্টক এক্সচেঞ্জগুলোর শেয়ার ওই আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য হবে না। এতে আরো বলা হয়, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ সংক্রান্ত বিবরণী প্রতি ত্রৈমাস শেষ হবার পর পরবর্তী মাসের সাত কর্মদিবসের মধ্যে সংযুক্ত ছক মোতাবেক আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগে দাখিল করতে হবে। বিষয়টিকে বাজার পতনের জন্য দায়ী করছেন অনেকে।
মন্তব্য