ভারতে গ্রেপ্তার হওয়া দেশের অন্যতম দুর্নীতিবাজ প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পিকে হালদারের সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার জালিয়াতি ও পাচার ঘটনায় বিভিন্ন সময়ে ৪২টি মামলায় ১৩২ জনের মতো আসামি করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এসব মামলার মধ্যে ৩৪টিতে পিকে’সহ ৭২ জন আসামি রয়েছে। মাত্র একটি মামলার তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ১৪ আসামির বিরুদ্ধে চার্জশিট অনুমোদন করেন আদালত। এদের মধ্যে মাত্র ছয়জন আসামি গ্রেপ্তার হয়েছে। বাকি আটজনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি রয়েছে।
গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বাস্তবায়ন প্রতিবেদন ২৫ মে আদালতে জমা দেওয়ার আদেশ রয়েছে। এর একজন পিকে হালদার গত শনিবার ভারতের কলকাতায় পাঁচ সহযোগীসহ (দুদকের বিভিন্ন মামলাভুক্ত আসামি) গ্রেপ্তার করে- দেশটির কেন্দ্রীয় আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)।
তথ্যমতে, এখন পর্যন্ত এসব মামলায় মোট ১৩ জন আসামি দেশে গ্রেপ্তার আছেন। বাকিরা ধরা চোয়ার বাহিরে। তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছে না দুদক। যদিও কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, র্যাব, পুলিশ ও অন্যান্য সংস্থার সহায়তায় নানামুখী উদ্যোগ রয়েছে।
এছাড়া আরো কয়েকটি মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে কমিশন। আর বিষয়টি সঠিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে বালে মনে করছে, বিশ্লেষকরা।
যে মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা :
গত ২০২০ সালের ৮ জানুয়ারি মামলা দুর্নীতি দমন কমিশন, সমন্বিত জেলা কার্যালয়, ঢাকা-১ এর মামলা নং ৩; দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ এর ২৭(১) ধারা এবং মানিলন্ডারিং প্রতিরোধে আইন, ২০১২ এর ৪(২), ৪(৩) ধারায় মামলা করা হয়। মামলার অভিযোগের বিষয়বস্তু দুদক জানিয়েছে- জ্ঞাত আয়বহির্ভূত অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ পাচার। আসামি প্রশান্ত কুমার হালদার অবৈধ পন্থায় নিজ নামে-বেনামে জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ ৪২৫ কোটি ৯৬ লাখ ২৯ হাজার ১৪০ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন করে।
এ ছাড়া অবৈধভাবে অর্জিত সম্পদসহ নিজের অবৈধ সম্পদের প্রকৃত অবস্থান গোপন করার হীন উদ্দেশ্যে নিজ নামে-বেনামে স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কোম্পানি অথবা কাগুজে ব্যক্তিদের নামে-বেনামে বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে পরিচালিত ১৭৮টি ব্যাংক হিসাবে প্রায় ৬ হাজার ৮১ কোটি টাকা জমা ও প্রায় ৬ হাজার ৭৬ কোটি টাকা উত্তোলনের মাধ্যমে অস্বাভাবিক লেনদেন হস্তান্তর, রূপান্তর, স্থানান্তর করে। প্রশান্ত কুমারের সহোদর ভাই আসামি প্রিতিশ কুমার হালদারসহ ১৩ জন আসামির পরস্পর যোগসাজশে বাংলাদেশ হতে সিঙ্গাপুর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ভারত হয়ে কানাডায় অসংখ্য এসটিআর, এলসিটিআর এবং ইএফটিআরের মাধ্যমে ১১ কোটি ১৭ লাখ কানাডিয়ান ডলারের সমপরিমাণ অর্থ পাচার করে।
তদন্তকারী কর্মকর্তা দুদক উপপরিচালক সালাউদ্দিনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ১০ নভেম্বর ২০২১ এজাহারভুক্ত আসামি প্রশান্ত কুমার হালদারসহ ১৪ জন আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) অনুমোদন করে কমিশন।পরে ২০২২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি পিকে হালদারসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে ঢাকা মেট্রোপলিটন সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালতে ৫৬ পৃষ্ঠার চার্জশিট দাখিল করে দুদক।
এর পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার মেট্রোপলিটন সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালতের বিচারক কে এম এমরুল কায়েশ মামলার নথিপত্র যাচাই-বাছাই শেষে চার্জশিট গ্রহণ করে আদেশ দেন। অভিযোগপত্রে ‘পলাতক’ উল্লেখ করায় পিকে হালদারসহ মোট ৮ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত।
গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা বাকি আটজন হলেন-পিকে হালদার, তার মা লীলাবতী হালদার, ভাই প্রীতিশ কুমার হালদার, পূর্ণিমা রানি হালদার, অমিতাভ অধিকারী, রাজীব সোম, সুব্রত দাস এবং অনঙ্গ মোহন রায়।চার্জশিটভুক্ত অন্য আসামিরা হলেন অবন্তিকা বড়াল, শংখ বেপারি, সুকুমার মৃধা, অনিন্দিতা মৃধা, উত্তম কুমার মিস্ত্রি ও স্বপন কুমার মিস্ত্রি।
এছাড়া আদালত আসামিদের বিরুদ্ধে জারি করা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বাস্তবায়ন সংক্রান্ত প্রতিবেদন ২৫ মের মধ্যে জমা দিতে বিভিন্ন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
এদিকে পিকে হালদার সংক্রান্ত ৩৫ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা দুদক উপপরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধান ভোরের আকাশকে জানান, যে মামলাটির চার্জশিট হয়েছে তার তদন্তকারী কর্মকর্তা আমি না। আমাদের যেসব মামলা ও আসামি রয়েছে। তাদের ধরতে র্যাব, পুলিশ এবং অন্যান্য সংস্থাসহ নিজস্ব প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। যে মামলা চার্জশিট হয়েছে, সে মামলায় আমাদের (দুদকের) আর কিছু করার নেই তা এখন আদালতের এখতিয়ার।
চার্জশিট হওয়া মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সালাউদ্দিন ভোরের আকাশকে জানান, চার্জশিটভুক্ত আসামিদের মধ্যে এ যাবত ছয়জন গ্রেপ্তার হয়েছেন। চার্জশিটে নাম থাকা সুকুমার মৃধা, তার মেয়ে অনিন্দিতা মৃধা, অবন্তিকা বড়াল, শঙ্খ বেপারি, উত্তম কুমার মিস্ত্রি ও স্বপন কুমার মিস্ত্রিকে আগে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এবং তারা এখন এ মামলায় কারাগারে আছেন।
অপরদিকে ভারতে আটক থাকা পিকে এবং তার অপর পাঁচ সহযোগী দুদকের মামলাভুক্ত আসামি বলে জানিয়েছেন, দুদক কর্মকর্তা গুলশান আনোয়ার প্রধান।
তিনি জানান, ইতোমধ্যে পিকে সিন্ডিকেটের ৩৩ জনের বিরুদ্ধে সম্পদ বিবরণী দাখিলের নোটিশ জারি করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৩ জন নির্দিষ্ট সময়ে সম্পদ বিবরণী কমিশনে দাখিল করেননি। তাদের বিরুদ্ধে কমিশনের অনুমোদন সাপেক্ষে পর্যায়ক্রমে মামলা হবে। এর একজন রতন কুমার বিশ্বাসেরর বিরুদ্ধে ৫ কোটি ৮২ লাখ ৪৭ হাজার ২৬৪ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের প্রমাণ পাওয়ায় গত মঙ্গলবার একটি মামলা করা হয়েছে।
এছাড়া এ পর্যন্ত পিকে হালদারের ৮৩ জন সহযোগীর ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করা হয়েছে। প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার সমমূল্যের জমি, বাড়ি, ফ্ল্যাটসহ অন্যান্য স্থাবর সম্পদ ক্রোক করা হয়েছে। ৬৪ জন আসামি ও অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা প্রদান করা হয়েছে। ১৩ জন আসামিকে গ্রেপ্তার ও রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। ১১ জন আসামি আদালতে নিজের দোষ স্বীকার করে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন।
পিকে হালদার কাণ্ডের সার্বিক বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান ভোরের আকাশকে জানান, পিকে হালদার সংশ্লিষ্টতায় যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তার দেশে ফেরা জরুরি। আসলে এর আগে তাদের অভিযোগের বিষয়ে জবাবদিহি নিশ্চিত করা কঠিন হবে। আর যাদের বিষয়ে সম্পদ বিবরণী দাখিলের আদেশ রয়েছে, তাদের হিসাবে কোনো প্রকার অসঙ্গতি থাকলে তা দুদক জবাবদিহি ও আইনের আওতায় নিয়ে আসতে পারবে। তাই বলছি, মানিলন্ডারিং বিষয়টি বিশে^র সব দেশে একটি জটিল প্রক্রিয়া। একটি সঠিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।
মন্তব্য