রসালো শাঁসালো হরেকরকম ফলের ডালি নিয়ে প্রকৃতির পালাবদলে ঘুরে এসেছে মধুমাস জ্যৈষ্ঠ।
জ্যৈষ্ঠের সঙ্গে ‘মধুমাস’ বিশেষণটি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে। জ্যৈষ্ঠের সঙ্গে ‘মধুমাস’ শব্দটি বসালে প্রশ্ন উঠতে পারে!
কারণ অভিধান বলছে, চৈত্র মাস হচ্ছে মধুমাস। তবে লোকমুখে এখন জ্যৈষ্ঠই যেন আসল মধুমাস।
গ্রীষ্মের শেষ মাস জ্যৈষ্ঠ, এ মাসে ফল পেকে রসের ভারে টইটম্বুর হয়। গাছ থেকে সদ্য পেড়ে আনা তাজা ফলের পরশ অসাধারণ এক অনুভূতির জন্ম দেয়।
এ মধুমাসে তাজা ফলের স্বাদ নিতে কে না চায়! মধুময় ফলের ডালি যেন পূর্ণতা পায় এ সময়ে। কারণ এ মাসে লিচু, কাঁঠাল, আম, তালের শ্বাস, আনারস, বেল, বাঙ্গি, তরমুজের মতো ফলের গন্ধে একাকার প্রতিটি বাজার।
প্রতি বছরের মতো এবারো গ্রীষ্মকালীন ফলের সমারোহ দেখা যাচ্ছে নগরের বিভিন্ন বাজারে।
ফলের এই মৌ মৌ ঘ্রাণে জ্যৈষ্ঠ হয়ে উঠেছে মধুময়। অবশ্য, প্রত্যাশা অনুযায়ী দাম না পেয়ে বিক্রেতারা কিছুটা হতাশ। এদিকে ফলের চড়া মূল্য হওয়াতে ক্রেতারাও কিছুটা হতাশ। আজ রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখাগেছে, দিনাজপুর এবং পাবনার ঈশ্বরদী থেকে আসা বোম্বে লিছু এবং বেলোয়াড়ি বাজারে বিক্রি হচ্ছে।
মানভেদে প্রতি শত বোম্বে লিচু বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকায়। প্রতিশত বেলোয়াড়ি লিচু বিক্রি হচ্ছে ৩০০ থেকে ৩৫০০ টাকায়।
পাইকাররা এসকল লিছু প্রতি হাজার কিনছে দুই থেকে তিনহাজার টাকায়। রাজধানীর বায়তুল মোকারমের সামনে বেদেনা লিছু বিক্রি হচ্ছে ৭০০ থেকে ১০০০ টাকায়।
চায়না থ্রি লিচু বিক্রি হচ্ছে ১২০০ টাকা শত। আর প্রতিশত কদমি লিচু বিক্রি হচ্ছে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকায়।
রজশাহী, চাপাইনবাবগঞ্জ, কুষ্টিয়া এবং সাতক্ষীরা থেকে আসা আমে বাজার সয়লাব।
বাজারে এখন পাওয়া যাচ্ছে গোপালভোগ, গোবিন্দ ভোগ, হিমসাগর, লেংড়া এবং গুটি আম।
ল্যাংড়া, গোপালভোগ এবং গোবিন্দ ভোগ আম রজধানীর বাজারে ৯০ থেকে ১১০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে।
কোনো কোনো জায়গাতে কড়া মিষ্টি গুটি আম ২০০টাকা কেজিতে বিক্রি হতে দেখা গেছে।
মৌসুমি ফল কিনতে বাজারে এসেছেন হাবিব এবং রুমা দম্পতি। খিলগাঁও রেলগেট বাজার থেকে ৪০০ টাকায় একশত বোম্বে লিচু এবং ২০০ টাকায় গুটি আম কিনেছেন।
তাদের সঙ্গে কথা হয় ভোরের আকাশের। মৌসুমি ফলের মান কেমন এ বিষয়ে জানতে চাইলে ভোরের আকাশকে জানান, ‘বাজারে এখন মৌসুমি ফল আসা শুরু করেছে।
বৈশাখ এবং জৈষ্ঠ এই দুই মাসই মূলত বাঙালিদের ফলের ওপর আগ্রহ বেশি থাকে।
তবে বাজারে মানের থেকে ফলের দাম অনেক বেশি। তারপরও চিন্তা থাকে এই ফলগুলো কী বাচ্চাদের খাওয়ানো যাবে কিনা।
কারণ এখন বেশির ভাগ ফলই কৃত্রিম উপায়ে পাকানো হয়।’
ক্রেতাদের মানসম্মত ফল খাওয়াতে জেলা প্রশাসক বাগানি এবং বিক্রেতাদের নির্দেশ দিয়েছে কেউ যেন সময়ের আগে আম এবং লিচু না পাড়ে।
একই সঙ্গে অপরিপক্ক ফল যেন কেউ না বিক্রি করে।
এ ছাড়া মৌসুমি ফলের মধ্যে তালের শাস বিক্রি হচ্ছে প্রতিপিস ৩০ টাকায়। প্রতি কেজি জাম বিক্রি হচ্ছে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকায়।
আকার ভেদে তরমুজ বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ২৫০ টাকায়। ডেওয়া ফল বিক্রি হচ্ছে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা কেজিতে।
বিক্রেতারা এই ডেওয়া ফল বিভিন্ন জেলা থেকে সংগ্রহ করে বলে জানাগেছে। বেল বিক্রি হচ্ছে আকার ভেদে ১০০ থেকে ৩০০ টাকায়।
চীনা বাঙ্গী প্রতি পিছ বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৭০ টাকায়। কিছুটা বেলের মতো দেখতে সাম্মান ফল আকার ভেদে প্রতি পিছ বিক্রি হচ্ছে ২০০ থেকে ২৫০ টাকায়।
হাইব্রিড জাতের আমলকি ফল বিক্রি হচ্ছে ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকায়। বরিশালের মিষ্টি কচি ডাব আকারভেদে বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ১০০ টাকায়।
গ্রীষ্মে আম, জাম, কাঁঠাল, লিচুসহ লোভনীয় সব ফলের ভিড়ে অনেকটা অবহেলিত হয় রসালো ফল জামরুল।
এই জামরুল ফল হয় দুই ধরনের লাল এবং সাদা। সাদা টা বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৭০ টাকা কেজিতে।
আর লাল জামরুল বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ১৫০ টাকা কেজিতে। বিক্রেতারা জানিয়েছেন এই ফল বিভিন্ন জেলা থেকে সংগ্রহ করে তারা।
তবে বেশিরভাগ আসে গাজিপুর থেকে।
বাড়ীর আঙিনায় বা পাহাড়ী এলাকায় একসময় দেখা যেত দৃষ্টি নন্দন ও খেতে সুস্বাদু গোলাপজাম ফল। এখন আর এই ফল খুব একটা চোখে পড়ে না।
এই সিজনে রাজধানীর কিছু বাজারে এই গোলাপজাম ফল বিক্রি হচ্ছে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা কেজিতে।
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন এই সকল ফল বিভিন্ন জেলা থেকে সংগ্রহ করা হয়। এই ফলের তেমন একটা চাষ হয় না।
শুধুমাত্র যাদের বাড়িতে এই গাছ আছে পাইকাররা তাদের থেকে এই ফল কিনে বাজারে নিয়ে আসে বলে জানান।
সিলেটের জল ঢোকি জাতের আনারস বাজারে প্রতি পিছ বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৬০ টাকায়।
অনেকে টাঙ্গাইলের মধুপুরের কড়া মিষ্টি জাতের আনারস জোড়া ১০০ টাকায় বিক্রি করছে।
এসব আনারস বেশির ভাগ সিলেট, মৌলভীবাজার, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, নরসিংদী এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকা থেকে রাজধানীতে আসে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ফলের আমদানীকারকের সঙ্গে কথা হয় ভোরের আকাশের।
তিনি বলেন, ‘ফলের চাহিদার দিক থেকে মৌসুমি ফল তেমন একটা চাহিদা পূরণ করতে পারে না। আমাদের দেশে যত ফল আসে তার বেশির ভাগই বিদেশ থেকে আসে।
পোর্টে এই ফলের প্রতি কন্টেইনার খালাস করতেই পঞ্চাশ হাজার টাকার মতো ডানে বামে (ঘুষ) দিতে হয়। না হলে সিরিয়াল দেরিতে হয়।
যদি প্রতি কার্টুন ফল বিদেশ থেকে আনাসহ খরচ হওয়ার কথা ১২শ থেকে ১৫শত টাকার মতো। সেখানে প্রতি কার্টুন খরচ পড়ছে দুই হাজার টাকার মতো।
এ ছাড়া তো সিন্ডিকেট আছেই। পোর্ট থেকে যদি মাল খালাস করার সময় মূল্য নির্ধারণ করা হতো যে, কে কতো রেটে বেচবে তাহলে হয়তো ফলের দাম কিছুটা কম হতো।
ফলের দাম এতো বেশি হওয়াতে কাস্টমারও কম পাচ্ছি আমরা। আমরাও চাই কম দামে বেচতে। যাতে কাস্টমার বেশি বেশি কিনতে পারে।’
কৃষিবিদরা বলছেন, ‘বিভিন্ন রসালো ফলের জোগান শুরু হয়ে গেছে। বাংলাদেশে ফলের উৎপাদন বছরে প্রায় এক কোটি ৩০ লাখ টন।
এর প্রায় ৫০ শতাংশ উৎপাদিত হয় জ্যৈষ্ঠ থেকে শ্রাবণ মাসের মধ্যে। বাকি ৫০ শতাংশ উৎপাদিত হয় অবশিষ্ট ৯ মাসে।
ফল উৎপাদনে পৃথিবীর প্রথম ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান। জ্যৈষ্ঠের প্রথম দিন থেকে শুরু হয়েছে গাছ থেকে আম পাড়া।
তারপরই লিচু পাড়া শুরু হয়। কিছুদিন পরে বাজারে আসবে পাকা কাঁঠাল। এ ছাড়া মধুমাসে আনারস, পেয়ারা, লটকন ও বাঙ্গির সরবরাহ বৃদ্ধি পায় বাজারে।
এ ফলগুলো খুবই পুষ্টিকর ও সুস্বাদু।’
মন্তব্য