-->

প্রগতি ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীরা

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রগতি ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীরা
প্রতীকী ছবি

নিয়মানুযায়ী কোনো কোম্পানির শেয়ারদর হ্রাস-বৃদ্ধির জন্য সংশ্লিষ্ট কোম্পানির সংবেদনশীল তথ্য দরকার হয়। কিন্তু পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি প্রগতি ইন্স্যুরেন্সের বেলায় দেখা যায় এর উল্টো।

কোনো ধরনের কারণ ছাড়া এ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার অস্বাভাবিকহারে বাড়তে শুরু করে। ৩২ টাকা থেকে দর বেড়ে ১৩২ টাকায় চলে যায়। বাজারে গুঞ্জন রটে- প্রতিষ্ঠানটি ভালোমানে লভ্যাংশ দেবে।

মূলত সেই গুঞ্জনেই তখন দর বাড়ে। পরে প্রতিষ্ঠানটি ৩০ শতাংশ লভ্যাংশ দেওয়ার পর ধীরে ধীরে দর কমতে থাকে। এতে বেকায়দায় পড়েছেন এ প্রতিষ্ঠানের শেয়ারধারীরা।

বাজার চিত্রে দেখা যায়, বর্তমানে এ কোম্পানির শেয়ারদর তলানিতে নেমে গেছে। এক বছর আগে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারদর ছিল ১৩২ টাকা। বর্তমানে সেই শেয়ার কেনাবেচা হচ্ছে ৬০ টাকা ৪০ পয়সায়।

গত বছর বাজারের সব ধরনের কোম্পানির শেয়ারদর হ্রাস পেলেও ভালো অবস্থানে ছিল বিমা খাতের কোম্পানিগুলো। এ সময় অস্বাভাবিক দর বৃদ্ধির তালিকায় ছিল প্রগতি ইন্স্যুরেন্স।

তখন বাজারে গুজব ছিল কোম্পানিটি এবার ৫০ শতাংশের বেশি লভ্যাংশ দেবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা ৩০ শতাংশ লভ্যাংশ প্রদান করে। এতে ধীরে ধীরে শেয়ারটির দর কমতে থাকে। বর্তমানে কোম্পানির শেয়ারদরের অবস্থা নাজুক।

সূত্র মতে, শেয়ারদর বাড়ানোর জন্য একটি চক্র মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে এ শেয়ারের দর বৃদ্ধি করে। এর সঙ্গে কোম্পানির লোক ছিল বলে জানা যায়। পরে দর বাড়িতে শেয়ার বিক্রি করে তারা বাজার থেকে বের হয়ে গেছে।

ফলে যারা বেশি দরে শেয়ার কিনেছিলেন, তারা বিপাকে পড়েছেন। লভ্যাংশ নিয়েও কোনো লাভ হয়নি তাদের। তবে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ মনে করছেন এ খবরের কোনো ভিত্তি নেই। এদিকে কোম্পানির নামে ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগও রয়েছে।

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বিমা খাতের কোম্পানি প্রগতি ইন্স্যুরেন্সের বিরুদ্ধে বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের আদেশ অমান্য করে অনুমোদনহীন ব্যাংকে প্রিমিয়াম জমা রাখা এবং ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগ উঠেছে।

এতে করে প্রতিষ্ঠানের শেয়ার চাহিদাও কমে গেছে। বর্তমানে তলানিতে রয়েছে এর শেয়ারদর।

জানা যায়, বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের সার্কুলার নং ৬৪/২০১৯ তারিখ ৩ জুন ২০১৯-এর মাধ্যমে জারিকৃত সার্কুলার নং নন-লাইফ ৬২/২০১৯ ৬৪/২০১৯-এর মাধ্যমে বিধিবিধান প্রণয়নের আইন জারি ও সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয় এবং প্রতিটি বিমা কোম্পানিকে ৩টি তফসিলি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে প্রিমিয়াম জমাকরণের আদেশ দেওয়া হয়।

যেসব বিমা কোম্পানির আইডিআরে অনুমমোদনহীন বাড়তি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ছিল তা ৩১ জুলাই ২০১৯-এর মধ্যে বন্ধের নির্দেশনাও দেওয়া হয়। যা ০২-০৭-২০১৯ আইডিআরের চেয়ারম্যান শফিকুর রহমান পাটোয়ারী স্বাক্ষরিত সার্কুলার।

এদিকে প্রগতি ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি আইডিআরের নির্দেশনা অমান্য করে আডিআর অনুমোদিত (১) ঢাকা ব্যাংক কাওরানবাজার, (২) প্রিময়ার ব্যাংক কাওরানবাজার, (৩) রূপালী ব্যাংক লিঃ এলিফ্যান্ট রোড শাখার বাইরে বেআইনিভাবে রাষ্ট্রের রাজস্ব ফাঁকি দিতে ও গ্রাহকের প্রিমিয়ার এর অর্থ গোপন ও আত্মসাৎ করে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক মতিঝিল শাখায় ১টি কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ১টি এসএনডি অ্যাকাউন্ট খুলে কোটি কোটি টাকা বেআইনিভাবে জমা করা হয়।

এর মধ্যে কারেন্ট অ্যাকাউন্টে অবৈধভাবে জমা হয় ৬ লাখ ৭৪ হাজার ৫২ ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৫ কোটি ৬৬ লাখ এবং এসএনডি অ্যাকাউন্টে ৬৫ লাখ টাকা।

তথ্য মতে, আব্দুল আউয়াল মিন্টু ও প্রগতির এমডির যোগসাজশে অনুমোধনহীন ২টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে মোট ৬ কোটি ৩২ লাখ টাকা অবৈধ জমা করা হয়।

জানা যায়, প্রগতি ইন্স্যুরেন্স ২০২০ সালে সরকারকে ভ্যাট দিয়েছে ২৯ কোটি ৯১ লাখ টাকা। বৈধ ৩টি ও অবৈধ ২টি অ্যাকাউন্টসহ মোট ৫টি অ্যাকাউন্টে গ্রাহকের কাছ থেকে ভ্যাট ও প্রিমিয়াম সংগ্রহ করেছে ২৫৭ কোটি ৮৬ লাখ টাকা।

এ টাকা থেকে সরকারি ভ্যাটের টাকা বাদ দিলে টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় ২২৭ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। আইনানুযায়ী প্রতিবেদনে ২২৭ কোটি ৯৬ লাখ টাকা উল্লেখ করার কথা।

কিন্তু প্রগতি ইন্স্যুরেন্স প্রিমিয়াম বাবদ টাকার হিসাব দিয়েছে ২২২ কোটি ৫১ লাখ টাকা এর মধ্যে প্রিমিয়াম দেখানো হয়েছে ২২১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা এবং ক্লোজিং ডিপোজিড দেখানো হয়েছে ৭৫ লাখ টাকা।

২০১৯ সালে ওপেনিং ব্যালেন্সের ৫৪ লাখ ৭২ হাজার টাকাসহ মোট ৫ কোটি ৩২ লাখ টাকা প্রগতির পরিচালক আব্দুল আওয়াল মিন্টু এবং এমডির যোগসাজশে অবৈধ ২টি অ্যাকাউন্টে জমা রাখে বলে জানা যায়।

বিষয়টি নিয়ে কথা বললে সংশ্লিষ্টরা বলেন, এসব মানুষের কারণে ক্ষতি গছ হচ্ছে সাধারণ মানুষ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিগুলোর ওপর মানুষের আস্থা নষ্ট হচ্ছে।

সরকার যে রাজস্ব দ্বারা দেশ উন্নয়ন করছে, তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে রাতারাতি এসব মানুষ আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যাচ্ছে। এভাবেই দেশের টাকা বিভিন্নভাবে বিদেশে পাচার করছে, যা কোনোভাবেই গ্রহযোগ্য নয়।

এদিকে প্রিমিয়াম হার লঙ্ঘন করে বছরের পর বছর ইন্টারন্যাশনাল বেভারেজ প্রাইভেট লিমিটেডের নামে মেরিন কাভারনোট ইস্যু করার অভিযোগ রয়েছে প্রগতি ইন্স্যুরেন্স লিমিটেডের বিরুদ্ধে।

এতে কোটি টাকার বেশি রাজস্ব থেকে বঞ্চিত সরকার। প্রিমিয়াম হার লঙ্ঘন করে প্রগতি ইন্স্যুরেন্স ইন্টারন্যাশনাল বেভারেজ প্রাইভেট লিমিটেডের অনুকূলে মেরিন কাভারনোট ইস্যু করছে বলে তথ্য পায় নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর।

এরই পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৩ এপ্রিল নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর থেকে বিষয়টি তদন্ত করতে আইডিআরকে চিঠি দেওয়া হয়।

নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মইনুল খান সই করা ওই চিঠিতে বলা হয়, ইন্টারন্যাশনাল বেভারেজ প্রাইভেট লিমিটেডের অনুকূলে মেরিন কার্গো ইন্স্যুরেন্স পলিসিতে মেরিনের ট্যারিফ মূল্য ধরা হয়েছে দশমিক ২৫ শতাংশ এবং এ টাকার ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট কাটা হয়েছে।

কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মেরিনের ট্যারিফ মূল্য ধার্য করা হয়েছে ১.৩১ শতাংশ এবং এ টাকার ওপর ভ্যাট প্রযোজ্য।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ইন্টারন্যাশনাল বেভারেজ প্রাইভেট লিমিটেডের অনুকূলে প্রগতি ইন্স্যুরেন্স থেকে ২০১৮ সালে ১৩২টি, ২০১৯ সালে ১২০টি এবং ২০২০ সালে ৭৫টি মেরিন কাভারনোট ইস্যু করা হয়।

প্রিমিয়াম হার লঙ্ঘন করে এ কাভারনোটগুলোর বিপরীতে ৭ কোটি ৩৫ লাখ ৯ হাজার ৩৩২ টাকা কম নেওয়া হয়। এতে সরকার ১ কোটি ১০ লাখ ২৫ হাজার ৫৮৭ টাকা রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছে।

আইডিআরের তদন্ত দল বলছে, নির্ধারিত হারের চেয়ে কম হারে প্রিমিয়াম আরোপ করে প্রগতি ইন্স্যুরেন্স বিমা আইন-২০১০-এর ১৭ এবং ৬০ ধারা লঙ্ঘন করেছে।

সেইসঙ্গে প্রিমিয়াম রেট লঙ্ঘন না করার জন্য ২০১১ সালে আইডিআরের জারি করা নির্দেশনাও লঙ্ঘন করেছে বিমা কোম্পানিটি। এর আগেও প্রগতি ইন্স্যুরেন্স ট্যারিফ রেট লঙ্ঘন করেছে।

এজন্য কোম্পানিটিকে একাধিকবার জরিমানাও করেছে বিমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরে। এর মধ্যে ২০১১ সালের ২৩ জুন ও ১৪ সেপ্টেম্বর-২০১২ সালের ১ মার্চ, ৪ এপ্রিল ও ৩ সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠানটিকে শুনানিতে ডাকে আইডিআরে।

সেখানে ট্যারিফ রেট ভায়োলেশনের (লঙ্ঘন) জন্য তাদের জরিমানা করা হয়। বিষয়টি নিয়ে কথা বললে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রেজাউল করিম ভোরের আকাশকে বলেন, যে অ্যাকাউন্টকে অবৈধ্য বলা হচ্ছে এটা কোনোভাবেই অবৈধ্য নয়।

এটা আইডিআরের অনুমোদন নিয়েই করা। আর ভ্যাট ফাঁকির বিষয়টি পুরোই ভিত্তিহীন। আমাদের কোম্পানির ভ্যাট ফাঁকি দেওয়ার নজির নেই।

মন্তব্য

Beta version