নতুন অর্থবছরের জন্য ঘোষিত বাজেটে আগামী পহেলা জুলাইয়ের পর থেকে ফ্রিজের দাম বাড়ানোর সুযোগ থাকলেও বাজারে দেখা যাচ্ছে উল্টো চিত্র। এরইমধ্যে ফ্রিজের দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। যদিও আসন্ন ঈদুল আজহা উপলক্ষে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে নানা অফার এবং উপহারের প্রলোভন দেওয়া হচ্ছে। এই দাম বাড়ানোর বিষয়ে ব্যবসায়ীরা বলছেন, ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় বাধ্য হয়েই ফ্রিজের দাম কিছুটা বাড়ানো হলেও বিভিন্ন উপহার ও অফারের মাধ্যমে তা সমন্বয় করা হচ্ছে।
পবিত্র ঈদুল আজহাকে (কোরবানীর ঈদ) কেন্দ্র করে বাংলাদেশে বেড়ে যায় ফ্রিজ (রেফ্রিজারেটর) ও ডিপ ফ্রিজের (ফ্রিজার) বেচাকেনা। কোরবানির পশুর মাংস সংরক্ষণের জন্য মূলত এই সময়ে বাড়তি চাহিদা তৈরি হয়। আর এই সুযোগে প্রতিবছরই এই সময়ে ফ্রিজের দাম বাড়িয়ে দেয় ব্যবসায়ীরা। অতীতের এই ধারাবাহিকতার পাশাপাশি এ বছর বাড়তি যুক্ত হয়েছে নতুন অর্থবছরের জন্য ঘোষিত বাজেটে দাম বাড়ার প্রস্তাব।
তবে এ খাতের সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তারা বলছেন, কোরবানি ঈদের নিকটবর্তী সময়ে বাজেট বাস্তবায়ন হওয়াতে ফ্রিজের দাম বাড়ছে। পাশাপাশি ডলারের মূল্য বৃদ্ধির কারণে ফ্রিজ আমদানিতেও খরচ বাড়ছে। ফলে ফ্রিজের বাড়তি দাম গ্রাহকের ঘাড়ে এসে পড়বে। তবে ব্যবসায়ীদের আশংকা, ডলারের মূল্য বাড়ায় এবং বাজেটে ফ্রিজের দাম বাড়ার কারণে এবারের কোরবানির ঈদে প্রত্যাশা অনুযায়ী ফ্রিজ বিক্রি হবে না। এই বিষয় মাথায় রেখে আগামী পহেলা জুলাইয়ের পর থেকে ফ্রিজের মূল্য সমন্বয় করার কথা ভাবছে ব্যবসায়ীরা।
২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে রেফ্রিজারেটর ও ফ্রিজার উৎপাদনের ক্ষেত্রে স্থানীয় উৎপাদন পর্যায়ে অব্যাহতি প্রত্যাহারপূর্বক ভ্যাটের হার ৫ শতাংশ নির্ধারণ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া উপকরণ ও যন্ত্রাংশ আমদানি এবং স্থানীয় ক্রয়ের ক্ষেত্রে বিদ্যমান সুবিধা ৩০ জুন, ২০২৩ পর্যন্ত বর্ধিত করার প্রস্তাব করা হয়। ফলে ১ তারিখ হতে রেফ্রিজারেটর ও ফ্রিজারের দাম বাড়বে। রাজধানী ঢাকায় ফ্রিজ কেনাবেচার প্রধান বাজার গুলিস্থান স্টেডিয়াম মার্কেট থেকে শুরু করে বিভিন্ন এলাকার শোরুম সরেজমিনে ঘুরে এমনটাই জানা গেছে।
ফ্রিজের আমদানিকারক, দেশীয় প্রস্তুতকারক এবং খুচরা পর্যায়ের বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিগত তিন মাসে কয়েক ধাপে ফ্রিজের দাম দুই থেকে পাঁচ হাজার টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে ব্যবসায়িরা বলছেন এই দাম বাড়ার কারণটা হচ্ছে ডলারের বাজারের অস্থিরতার ফলে। আর এই দাম বাড়ার কারণে ক্রেতারাও কিছুটা শঙ্কিত।
বাজেটের কারণে সামনে ঈদে ফ্রিজের বাজারে কোন প্রভাব পড়বে কিনা এ প্রসঙ্গে ভোরের আকাশের সঙ্গে কথা হয় বনশ্রী ট্রান্সকম এক্সক্লুসিভ ডিলার আউটলেটের লজেস্টিক ডিরেক্টর মোহাম্মদ আল-আমিনের। তিনি বলেন, আগে যেমন ক্রেতারা সহজেই চিন্তা করতে পারত কোন ফ্রিজ নিবেন। তবে দাম বাড়ার কারণে এখন অনেক পরিকল্পনা করে ফ্রিজ কিনতে হচ্ছে সাধারণ ক্রেতাদের। ফ্রিজের দাম কোরবানির কাছাকাছি সময়ে বাড়ার কারণে আগে ঈদে যে পরিমাণ বিক্রি হত, এখন হয়তো সে পরিমাণ বিক্রি নাও হতে পারে।
অনেক কোম্পানি ফ্রিজের আগের মূল্য ধরে রাখার জন্য বিভিন্ন প্রচার অফার দিচ্ছে। এই প্রচার অফার দেবার কারণে বাজেটে ফ্রিজের যে দাম বেড়েছে তার থেকে কম দামে কোম্পানিগুলো বাজারে ফ্রিজ দেবার চেষ্টা করছে। যার ফলে ক্রেতাদের মনে এমন প্রশ্ন যেন না আসে যে তারা বেশি দামে ফ্রিজ ক্রয় করছেন।
বায়তুল মোকারমে কনকার ফ্রিজ কিনতে আসা পুরান ঢাকার লালবাগ এলাকার তোহিদুল করিম বলেন, গরমে পরিবারের নিত্য প্রয়োজনীয় বস্তুর মধ্যে ফ্রিজ অন্যতম। ফ্রিজ থাকলে খাবার দীর্ঘসময়ের জন্য টাটকা রাখা যায়। শুনলাম সামনে কুরবানি ঈদ উপলক্ষে বিভিন্ন ছাড় দিয়েছে কোম্পানিগুলো। আর বাজেটে নাকি ফ্রিজের দাম বাড়তে পারে। তাই বাড়ার আগে এই সুযোগে ফ্রিজ কিনতে আসা।
বায়তুল মোকারমের ওয়াল্টনের বিক্রয় প্রতিনিধি মো. হবিবুর রহমানের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, বিগত তিন মাসে ফ্রিজের দাম পর্যায়ক্রমে দুই থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। ওয়াল্টনে ১০০ লিটার থেকে ৬১৯ লিটার পর্যন্ত প্রায় ২০০ প্লাস মডেলের ফ্রিজ বিক্রি হয়। এর মধ্যে ২০০ থেকে ৩০০ লিটারের মধ্যে ফ্রিজ বেশি বিক্রি হয়। এ ধরনের ফ্রিজ সাধারণ মানুষ বেশি কেনে। ১২ হাজার ৯৯০ থেকে শুরু প্রায় ১ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ফ্রিজ বিক্রি করছে ওয়াল্টন। তবে ঈদের বেচাকেনা জুলাইয়ের ১ তারিখ থেকে শুরু হতে পারে। ৩৩৩ লিটার ৪২ হাজার ৫০০ টাকায় ৩৩৩ লিটার এবং ৩৬ হাজার টাকার ২৬৫ লিটার ফ্রিজ বেশি বিক্রি হচ্ছে। কারণ হচ্ছে এগুলোর ডিপ কিছুটা বড়। ডিপ ফ্রিজের মধ্যে ৩২ হাজার ৫০০ টাকার ২০৫ লিটারের ফ্রিজটা বেশি বিক্রি হচ্ছে।
বাজেট এবং ডলারের দাম বৃদ্ধির কারণে বাজারে কেমন প্রভাব পড়ছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে কথা হয় এস.এ ইলক্ট্রেনক্সি কনকা শো-রুমের ম্যানেজার মো. আবু সোহলের সঙ্গে। তিনি বলেন, প্রতিবছর ২৫% ফ্রিজ বিক্রি করে থাকে কনকা কোম্পানি। তবে এবার দাম কমিয়ে তা ৩৫% বিক্রি করার টার্গেট নিয়েছে কোম্পানি। ১৬৫ লিটার থেকে ৬৪৬ লিটার পর্যন্ত ফ্রিজ এখানে বিক্রি হয়। এর মধ্যে ইনভার্টার প্লাস এবং ডিজিটাল ডিসপ্লে ফ্রিজ বেশি বিক্রি হয়। কনকায় ২৯ হাজার ৭৮০ টাকা থেকে শুরু করে ১ লক্ষ ১৯ হাজার ৯০০টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। আমরা বর্তমানে ফ্রিজে ১০ থেকে ১২ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় দিচ্ছি। আমাদের এখানে ৭০ টি মডেলের উপর ফ্রিজ আছে।
সাম্প্রতিক প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৮ সালের পর দুই বছর সময়কালেই দেশের রেফ্রিজারেটরের বাজার ১৩১ মিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ৫৪৯ মিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। আর এ বাজারের ৮০ শতাংশ দেশিয় প্রতিষ্ঠানের দখলে থাকবে। ২০১০ সালের আগে দেশের রেফ্রিজারেটর বাজারের ৮০ শতাংশই ছিল বিদেশি ব্র্যান্ডগুলোর দখলে।
দেশীয় ফ্রিজ নির্মাতাদের সংগঠন বাংলাদেশ রেফ্রিজারেটরস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের হিসাব অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ফ্রিজের বার্ষিক বাজার প্রায় ৪০ লাখ। এর প্রায় ৩০ শতাংশই বিক্রি হয় কোরবানির ঈদের আগে। দেশীয় বিভিন্ন ব্র্যান্ড যেমন: ওয়ালটন, মার্সেল, যমুনা, মাইওয়ান, মিনিস্টারের পাশাপাশি হিটাচি, সিঙ্গার, এলজি, তোশিবা, ওয়ার্লপুল, অ্যারিস্টন, সামস্যাং, শার্পসহ আমদানি করা বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ফ্রিজও বেশ বিক্রি হচ্ছে।
মন্তব্য