পদ্মা সেতুর সঙ্গে সমান্তরালভাবে এগিয়ে চলেছে দক্ষিণাঞ্চলের অবকাঠামো নির্মাণের কাজ। নতুন করে জাগছে মানুষের স্বপ্ন। এ অঞ্চলে শিল্পকারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিপণন, সরবরাহ ও কৃষিপণ্য বাজারজাতকরণকে ত্বরান্বিত করবে। এসব কার্যক্রম কিছু মাঝামাঝি পর্যায়ে। কিছু ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো বলছে, এসব কার্যক্রম সম্পন্ন হলে কাক্সিক্ষত প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হবে।
এ বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরএ) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, পদ্মা সেতুর সঙ্গে কানেক্টিভিটি তৈরি হচ্ছে। কুয়াকাটার সঙ্গে হচ্ছে, মংলার সঙ্গে করছে, বেনাপোল বন্দরের সঙ্গে করছে, খুলনার সঙ্গে করছে, পায়রা বন্দরের সঙ্গে হচ্ছে। সড়ক উন্নয়নের ব্যাপক কাজ চলছে। একটি সেতুও হয়ে গেছে। আরো একটি হচ্ছে। মংলা ইপিজেড-শিল্পাঞ্চল সেটি তো আছেই। প্রত্যাশিত প্রবৃদ্ধি তা পেতে সময় লাগবে। কিন্তু সেতুকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড হবে, তা নিশ্চিত। ইতোমধ্যে দেখাও যাচ্ছে।
পদ্মা সেতু হওয়ার পর অর্থনৈতিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডগুলোকে গতিশীল করতে প্রয়োজনীয় সড়ক, সেতু ও বিদ্যুতের মতো অবকাঠামো নির্মাণের কাজ চলছে- যাতে এ অঞ্চলে শিল্পকারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে। ঢাকায় দ্রুত আসা-যাওয়া ও পণ্য আনা-নেওয়া করবে। পদ্মা সেতু অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা, সক্ষমতা ও প্রতিরোধ্য ইচ্ছাশক্তির প্রতীক। বিশ্বের প্রথম সারির অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান ও দাতা সংস্থাগুলোর বিরোধিতার মুখে নিজস্ব শক্তি ও সাহস নিয়ে নিজ অর্থায়নে প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে পদ্মা সেতু। যার সঙ্গে পুরো দেশের আবেগ জড়িত। জড়িত দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের স্বপ্ন। সেই বাস্তবতাতেই যুক্ত হয়েছে রামপালের মৈত্রী সুপার থার্মাল পাওয়ার প্রজেক্ট; পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্প ও পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের মতো ফার্স্ট ট্যাক প্রজেক্ট। এসব প্রকল্প পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও দেড় শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়তা করবে। পদ্মা সেতুর সঙ্গে ইতোমধ্যে দক্ষিণাঞ্চলের সব জেলাকে যুক্ত করার জন্য কাজ করছে সড়ক ও সেতু মন্ত্রণালয়।
সেতু উদ্বোধন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোর সঙ্গে পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা যোগাযোগের স্বপ্ন দ্বার খুলে যাবে। ইতোমধ্যে মানুষের মধ্যে সাজ সাজ রব। অপেক্ষা শুধু উদ্বোধনের। জাজিরা থেকে ভাঙা হয়ে গোপালগঞ্জ পর্যন্ত ফোরলেন সড়ক নির্মাণের কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে। গোপালগঞ্জের নড়াইলের লোহাগড়ার কালনা পর্যন্ত চারলেনের সড়কের কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে। খুব তাড়াতাড়ি উন্নত হবে কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা থেকে মংলা পর্যন্ত। এদিকে বরিশাল থেকে ভোলা, পটুয়াখালীর যোগাযোগ ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো হয়েছে।
পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকার সঙ্গে কুয়াকাটা পর্যন্ত ইতোমধ্যে যোগাযোগের জন্য সড়ক প্রস্তুত হয়েছে। এক্ষেত্রে পায়রা সেতু সংযোগ করেছে। পায়রা সেতু বাংলাদেশের সড়ক সেতু, যা পায়রা নদীর ওপর নির্মাণ করা হয়। সেতুটির দৈর্ঘ্য ১ হাজার ৪৭০ মিটার। এ সেতু নির্মাণের পর থেকে বরিশাল থেকে কুয়াকাটা পর্যন্ত ১১১.৫ কিলোমিটার যাত্রাপথে ফেরি পারাপারের প্রয়োজন শেষ হয়। ঢাকা-বরিশাল-পটুয়াখালী-কুয়াকাটা মহাসড়কের পটুয়াখালীর দুমকি উপজেলার লেবুখালী এলাকার পায়রা নদীর ওপর নির্মাণ করা হয় এ সেতু। দক্ষিণাঞ্চল মূলত কৃষিনির্ভর এলাকা। এখানে কৃষিপণ্য উৎপাদিত হলেও যোগাযোগের অভাবে চাষিরা দাম পান না। খাদ্যভাণ্ডারখ্যাত উত্তরাঞ্চলে খাদ্য উৎপাদন হওয়ার পাশাপাশি খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পকারখানাও গড়ে উঠেছে। হচ্ছে বড় বড় বিনিয়োগ। মূলত যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হওয়ার কারণে এমন পরিবর্তন এসেছে। দক্ষিণাঞ্চলে কৃষিপণ্য উৎপাদন হলেও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি না হওয়ার কারণে সেখানকার কৃষি ও কৃষক তিমিরেই থেকে গিয়েছিল।
উদ্যোক্তারা বলছেন, পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর থেকে সেই অন্ধকার কেটে যাবে। পদ্ম সেতু চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের চলাচল, ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসারে পদ্মা সেতু যোগাযোগের মহোৎসব শুরু হবে, সেই অবস্থাকে বিবেচনায় রেখেই এসব উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, বলে মনে করছে এ অঞ্চলের মানুষ। পদ্মা সেতু চালু হলে নতুন করে প্রাণচাঞ্চল্য তৈরি হবে মংলা বন্দরের। ঢাকার সাথে কমবে দূরত্ব। এজন্য সড়ক পথের কার্যক্রম ঢেলে সাজানো হচ্ছে। সেতুকেন্দ্রিক উন্নয়ন কাঠামো নির্মাণ এসব সড়ক নির্মাণের লক্ষ্য।
পদ্মা সেতু উদ্বোধনের অপেক্ষায়। নির্মাণকালে মাওয়া থেকে জেলা শহরমুখী সড়কের উন্নয়ন কাজ চলছে। ইতোমধ্যে বেশকিছু কলকারখানা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। অবকাঠামো গড়ে উঠেছে তার চারপাশে। নতুন নতুন বাড়িঘর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তার দুই পাশে জমির দাম বেড়ে গেছে। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর এসব উন্নয়ন কার্যক্রম বেড়ে যাবে বহুগুণ। মানুষের জীবনে পরিবর্তনের ছোয়া লেগেছে; অপেক্ষায় আছে ২৫ জুনের। যেন স্বপ্ন পৌঁছে যাবে বাড়ি। শুধু পদ্মা সেতু নির্মাণ হলেই হবে না, মানুষ শুধু ঢাকায় যাওয়া আসে করলেই হবে না, অর্থনৈতিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড যুক্ত হতে হবে। সেজন্য অপেক্ষা ২৫ জুনের। শিল্পায়নের জন্য অবকাঠামো মূল কথা। আমাদের অভিজ্ঞতাও আছে। ঢাকা ময়মনসিংহ, ঢাকা সিলেট ও ঢাকা টাঙ্গাইল সড়ক ফোরলেন হওয়ার সঙ্গে শিল্প কারখানা গড়ে উঠেছে। এসব এলাকা এখন বড় শিল্প এলাকা। এখানে কর্মসংস্থান, উৎপাদন, সেবা ও রপ্তানি আয়ে ভূমিকা রাখছে।
আহসান এইচ মনসুর ভোরের আকাশকে বলেন, পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে যেসব অবকাঠামো গড়ে উঠছে এখানেও শিল্প কারখানা গড় উঠবে। তবে এটা পদ্মা সেতু চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাতারাতি সব হয়ে যাবে না। এখন উন্নয়ন কার্যক্রম চলছে, এটা কাক্সিক্ষত জায়গায় যেতে হয়তো ৫-৬ বছর লাগবে। তবে যেসব অর্থনৈতিক জোন এসব অঞ্চলে গড়ে উঠেছে, সেগুলো উৎপাদনে যাওয়ার মতো জায়গা নিয়ে যেতে হবে।
মন্তব্য