-->
শিরোনাম

পদ্মা সেতু ‘দাবায়ে রাখতে পারবা না’র স্পিরিট

জাফর আহমদ
পদ্মা সেতু ‘দাবায়ে রাখতে
পারবা না’র স্পিরিট

উদ্বোধন হল বহুল প্রতীক্ষিত পদ্মা সেতুর। বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকার মতো আন্তর্জাতিক অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান পদ্মা সেতু থেকে সরে আসার পর নিজস্ব অর্থায়নে কাজ শুরু হয়। সে সময় আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এগিয়ে আসে। অগ্রণী ব্যাংক সেতুতে মার্কিন ডলার সরবরাহের দায়িত্ব নেয়। সার্বিক বিষয়ে কথা হয় অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মোহাম্মদ শামস উল ইসলামের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক জাফর আহমদ...

ভোরের আকাশ : পদ্মা সেতু নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণ শুরু হলে মার্কিন ডলার সরবরাহকারী ব্যাংক নিযুক্ত হয় অগ্রণী ব্যাংক। ২৫ জুন সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। উদ্বোধন হচ্ছে পদ্মা সেতু। অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে কী বলবেন?

মোহাম্মদ শামস উল ইসলাম : এটা একটি বিরাট ঘটনা। শুধু বাংলাদেশেরই নয়, পুরো উপমহাদেশের একটি বিরাট ঘটনা এটি। একটি সাহস। যেখানে বিশ্বব্যাংক আসেনি, সেখানে বাংলাদেশ এককভাবে নির্মাণের সাহস দেখিয়ে এটা করেছে। এটা একটি আশ্চর্যজনক ঘটনা ছিল। এটা একটি চ্যালেঞ্জ ছিল। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে আমরা সেই সেতু করতে পেরেছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সেই অসম্ভব সম্ভব হয়েছে। এটা আমাদের সেই স্পিরিট, বঙ্গবন্ধুর সেই অমর বাণী- ‘দাবায়ে রাখতে পারবা না’। শেখ হাসিনা করে সেটা বুঝিয়ে দিয়েছেন।

সাহসিকতার, দৃঢ়চেতা মনোবল দিয়ে সেতু করে দেখিয়ে দিয়েছেন- কোনো বাধাই আমাদের দাবিয়ে রাখতে পারে না। এটা একটি রোল মডেল হয়ে থাকল। একবার আমরা স্বপ্ন দেখেছিলাম পদ্মা সেতু হবে। আমাদের সে স্বপ্ন ভঙ্গ হলো। এরপর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বললেন সেতু হবে। দৃঢ়চেতা ও মনোবল ছিল বলে তিনি সেটা করেছিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর কাছে যে সাহস পেয়েছিলেন, দাবায়ে রাখতে পারবা না।

ভোরের আকাশ : অগ্রণী ব্যাংক পদ্মা সেতুর ডলার সরবরাহকারী হিসেবে কিভাবে যুক্ত হলো?

মোহাম্মদ শামস উল ইসলাম : ২০১২ সালে যখন পদ্মা সেতু করার ব্যাপারে কথা হলো, তখন অগ্রণী ব্যাংকের একটি অ্যাকাউন্ট হয় এবং আমরা সেখানে ছিলাম। পরবর্তী বছর থেকে ফরেন কারেন্সি পেমেন্ট শুরু হয়। পরে ২০১৬ সালে সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান সেতু বিভাগের যে মিটিং হয়, সেখানে সিদ্ধান্ত হয় বাণিজ্যিক অগ্রণী ব্যাংক ফরেন কারেন্সি দেবে। সে সময় তিনি বলেন, যদি কোনো কারণে ডলার সঙ্কুলান না হয়, তা হলে বাংলাদেশ ব্যাংকে ডলার সরবরাহ করবে। ২০১৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত আমরা ডলার দিচ্ছি। এক্সপোর্ট ও রেমিট্যান্স দিয়ে আমাদের যে ডলার আহরিত হয়, সেই ডলার দিয়ে আমরা ১.৪৫ বিলিয়ন ডলার জোগান দিয়েছি পদ্মা সেতুর জন্য।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এই ব্যাংকের নাম দিয়েছেন ‘অগ্রণী’ ব্যাংক। স্বাধীনপূর্ব হাবিব ব্যাংক ও কমার্স ব্যাংক একীভূত হয়। উনি নাম দিয়েছিলেন অগ্রণী ব্যাংক। সেই ‘অগ্রণী’ ব্যাংক অগ্রণী থাকবে। কিছুটা হলেও আমরা নামে সার্থকতা প্রমাণ করতে পেরেছি। আমাদের নিজস্ব রেমিট্যান্স, রপ্তানির মাধ্যমে ফরেন কারেন্সি থেকে এ পর্যন্ত ১.৪৫ বিলিয়ন ডলার পদ্মা সেতুতে সরবরাহ করেছি।

ম্যাক্রো লেবেলে প্রধানমন্ত্রী দেখিয়েছেন পদ্মা সেতু আমরাই পারি। মাইক্রো লেবেলে অগ্রণী ব্যাংকও দেখিয়েছে জাতির পিতার দেওয়া অগ্রণী নামের সার্থকতা প্রমাণ করে। নামের সার্থকতা কিছুটা হলেও আমরা প্রমাণ করতে পেরেছি।

প্রকল্প থেকে বলা হচ্ছে সেতুর শেষ পর্যন্ত ২.৪ বিলিয়ন ডলারের প্রয়োজন হতে পারে। বাকি এক বিলিয়ন ডলারের প্রয়োজন হবে। এ পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কোনো ডলার দিতে হয়নি। এই যে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কোনো ডলার নেইনি। ফলে রিজার্ভে কোনো চাপ পড়েনি। অক্ষত থেকেছে রিজার্ভ। এটাও কিন্তু আমাদের একটি সক্ষমতার প্রকাশ।

ভোরের আকাশ : পদ্মায় ডলার সরবরাহ করে এক মাথা না নোয়ানো কাজের সাথে যুক্ত হয়েছেন। সেতু চালুর পর দক্ষিণাঞ্চলে বিনিয়োগের প্রয়োজন হবে। ব্যাংক খাত কিভাবে ভূমিকা রাখবে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক হিসেবে আপনারা কি করবেন?

মোহাম্মদ শামস উল ইসলাম : অগ্রণী ব্যাংক বিভিন্ন সূচকে অগ্রগামী রয়েছে। যেমন ধরুন সরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে নাম্বার ওয়ান, ইম্পোর্টে নাম্বার ওয়ান, রেমিট্যান্সে আহরণে ওয়ান, এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে ওয়ান। আমরা অফসোর র‌্যাংকিয়েও নাম্বার ওয়ান। ঋণ ফাইন্যান্সিংয়ে আমরা এগিয়ে আছি। ইসলামি ব্যাংকিং উইন্ডোতেও নাম্বার ওয়ান। করোনা মহামারির মধ্যে ক্ষুদ্র মাঝারি শিল্পের প্রণোদনা বিতরণ খুবই চ্যালেঞ্জ ছিল। এই প্রণোদনা বিতরণেও আমরা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে নাম্বার ওয়ান। কৃষিতে প্রণোদনা বিতরণেও আমরা এগিয়ে আছি।

সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর মূল্যায়ন করা হয়, যাকে বলে এ্যানিয়াল পারফর্মিং অ্যাগ্রিমেন্ট- এপিএ। এপিএ বাস্তবায়নে ২০১৯-২০ অর্থবছরে অগ্রণী ব্যাংক প্রথম হয়েছে।

আমরা পদ্মা সেতুতে ১.৪৫ বিলিয়ন ডলার ফাইন্যান্স করেছি শুধু তা নয়, আমরা অবকাঠামো উন্নয়নেও, বিশেষ করে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারে ফাইন্যান্স করেছি। ১৫টা পাওয়ার প্ল্যান্টে ফাইন্যান্স করেছি। এসব ঋণে কোনো খেলাপি নেই। ফলে আজকে অবকাঠামো থেকে শুরু করে দেশের দারিদ্র্য বিমোচন, নারীর ক্ষমতায়নসহ অর্থনৈতিক উন্নয়নে অগ্রণী ব্যাংক অবদান রাখছে।

বিদেশ থেকে ফরেন কারেন্সি অবদান রাখছি। খাদ্য নিরাপত্তায় ভূমিকা রাখছি। জাতীয় উন্নয়নে আমরা শামিল হচ্ছি। কিছু চ্যালেঞ্জ আছে, তার পরও আমরা এগিয়ে যাব। আমরা আমাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি, ড. জায়েদ বখতের মতো একজন স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদ আমাদের চেয়ারম্যান। পর্ষদ, কর্মকর্তা সবাই এই অভীষ্ট লক্ষ্য সামনে রেখে কাজ করছি। আমরা মনে করি দেশ এগিয়ে যাবে, আমরা উন্নত হব।

স্বাধীনতাপরবর্তী ৪৫ বছরে যে উন্নতি হয়েছে, গত পাঁচ বছরে অগ্রণী ব্যাংক তার চেয়ে বেশি উন্নতি হয়েছে। আমি দায়িত্ব নিয়েছি পাঁচ বছর। এই পাঁচ বছরে আমানত এসেছে ৫১ হাজার কোটি টাকা। আর ৪৫ বছরে আমানত এসেছে ৪৯ হাজার কোটি টাকা। এ নিয়ে অগ্রণী ব্যাংকের আমানতের পরিমাণ এক লাখ কোটি টাকা। আমরা এক ট্রিলিয়ন কোটি টাকার ক্লাবের মেম্বর। একইভাবে ঋণ বিতরণ বলেন, প্রফিট আর্নিং বলেন, খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনা বলেন- সব ক্ষেত্রে আমরা উন্নতি করছি। ২০১৬ সাল থেকে পাঁচ বছরে মাত্র ৩ শতাংশ ঋণ খেলাপি হয়েছে।

আজকের এই মাহেন্দ্রক্ষণে আমরা আনন্দিত। জাতির পিতা যে দেশ দিয়েছিলেন; সুজলা, সুফলা, শস্য-শ্যামলা দেশ গড়ার যে স্বপ্ন দেখেছিলেনÑ সেই স্বপ্ন কিন্তু তিনি বাস্তবায়ন করে যেতে পারেননি। সাড়ে ৩ বছরের মাথায় ঘাতকরা তাকে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে আমাদের স্বপ্ন-সাধকে থামিয়ে দিয়েছিল। তারই যোগ্য উল্টরসূরি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তা শুধু পূর্ণই করেননি। অনেক বড় বড় স্বপ্ন তিনি বাস্তবায়ন করেছেন। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু হবে, এটা কি আমরা কোনো দিন ভেবেছিলাম! এমন স্বপ্ন দেখার দুঃসাহস কোনোদিনই হয়নি। আজ সাহসের সাথে সেই সেতুর স্বপ্ন শুধুই দেখেননি, বাস্তবায়ন করেও দেখিয়েছেন। তিনি দেখিয়েছেন বাঙালির কোনোদিন মাথা নোয়াবার নয়। বাঙালিকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারে না।

ভোরের আকাশ : সেতু চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের সামনে থেকে প্রতিবন্ধকতা দূর হয়ে যাবে। কৃষি, বাণিজ্য আপনাআপনি সচল হয়ে যাবে। এরপর বিনিয়োগের প্রয়োজন। ব্যাংক খাত বিনিয়োগের জন্য কতটা প্রস্তুত। অগ্রণী ব্যাংক কতটা প্রস্তুত?

মোহাম্মদ শামস উল ইসলাম : সেতু চালুর পর ২ থেকে ২.৫ শতাংশ জিডিপি বাড়বে। ৬ কোটি মানুষ অধ্যুষিত ২১টি জেলার মানুষ এর সুবিধাভোগী।

আমাদের এডি রেশিও ৬০ শতাংশের মধ্যে রয়েছে। এর অর্থ হলো আমাদের ঋণ বিতরণ করার সুযোগ আছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর সরকারি উন্নয়ন কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পর্ক রেখেই বিনিয়োগ করে থাকে। সারা বাংলাদেশে ৯৬৮টি শাখা আছে। দক্ষিণাঞ্চলের উন্নয়নে আমরা ভূমিকা রাখতে পারব। অর্থনৈতিক বির্নিমাণে আমরা যুক্ত থাকব। জাতির জনকের যে প্রত্যাশিত উন্নয়ন, সেই উন্নয়নে আমরা বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে পারব।

ভোরের আকাশ : পূর্বাঞ্চল বন্যায় ডুবে গেছে, উত্তরাঞ্চলেও বন্যার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। এ সময়ে যদিও মাঠে শস্য নেই। তারপরও আগামীর খাদ্য নিরাপত্তার জন্য সজাগ দৃষ্টির প্রয়োজন আছে। বন্যাপরবর্তী রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যক ব্যাংক হিসেবে আপনাদের কী ভূমিকা থাকবে?

মোহাম্মদ শামস উল ইসলাম : আগেও বন্যাদুর্গত এলাকায় সাড়ে ৪ শতাংশ সুদহারে কৃষকদের মাঝে ঋণ বিতরণ করেছি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ইতোমধ্যে বলেছেন, উপদ্রুত মানুষের ঋণ আদায়ের চেয়ে পুনর্বাসনের জন্য ঋণ বিতরণ অব্যাহত রাখতে হবে। রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক হিসেবে সেটা করছি। ইতোমধ্যে আমরা সিলেট ও সুনামগঞ্জের ডিসি মহোদয়কে ৫ লাখ টাকা হস্তান্তর করেছি। আমরা একদিনের বেতন দিয়ে ও সিএসআর থেকে কিছু টাকা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে ২ কোটি টাকা দেওয়ার কথা চিন্তা করছি। সুখে-দুঃখে জনগণের পাশে থাকতে চাই। অগ্রণী ব্যাংক জনগণের ব্যাংক, দেশের ১৭ কোটি মানুষ এই ব্যাংকের মালিক। এই মানুষের জন্য আমরা কাজ করছি। অর্থনৈতিক প্রফিট যেমন করতে হবে, সোস্যাল প্রভিটও আর্ন করতে হবে। ৩২টি সেবা আছে জনগণের ব্যাংক হিসেবে কোনো সার্ভিস চার্জ নেইনি। এমনকি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যে শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট আছে, সেই বৃত্তি বিতরণও আমরা ফ্রি করছি। এখানে আমরা ১ কোটি টাকা প্রভিট করতে পারতাম।

পেন্ডামিকের সময় আমরা প্রবাসীদের অর্থ পাওয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা করেছি। প্রবাসীরা দেশে যে পরিমাণ টাকা পাঠিয়েছিলেন তার সাথে সরকারের ২ শতাংশ প্রণোদনার সঙ্গে আমরা ১ শতাংশ বেশি করে দিয়ে রেমিট্যান্সযোদ্ধাদের সহায়তা করেছি। এই যে ১ শতাংশ আমরা অতিরিক্ত দিয়েছি, আমরা মনে করি এটা প্রণোদনা নয়। যে জনগণ রাষ্ট্রের মালিক, আমরা সেই মালিককে ১ শতাংশ লভ্যাংশ দিয়েছি।

স্বাধীনতাপরবর্তী জাতির পিতা এসব ব্যাংককে জাতীয়করণ করেন। সেই স্পিরিট নিয়ে আমরা এসব কাজ করছি। আমাদের মূল যে স্পিরিট সমাজতান্ত্রিক ধারণা, সেই স্পিরিটকে সমুন্নত রেখেছি।

পেন্ডামিকের সময় সীমিত আকারে লোকবল দিয়ে আমাদের সকল শাখা খোলা রেখেছিলাম। করোনা মহামারির সময় আমাদের ২১ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী মৃত্যুবরণ করেছেন; একজন পরিচালক ইন্তেকাল করেছেন। এভাবে আমরা জাতীয় দুর্যোগে ভূমিকা রেখেছি।

আগামীতেও যে কোনো প্রয়োজনে আমরা মানুষের পাশে থাকব।

মন্তব্য

Beta version