-->
বিনিয়োগকারীরা তীর্থের কাক

কোনদিকে যাচ্ছে পুঁজিবাজার?

মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ
কোনদিকে যাচ্ছে পুঁজিবাজার?

ঢাকা: পুঁজিবাজারে সবচেয়ে বড় ধস নামে ২০১০ সালে। এরপর বাজার আর দীর্ঘমেয়াদি ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। মাঝেমধ্যে কয়েকবার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেও তা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের প্রস্তুতি নেয়ার আগে আবারও পতনের ধারায় ফিরেছে সূচক। সর্বস্ব হারিয়ে পুঁজিবাজার থেকে বিদায় নিয়েছেন অনেক বিনিয়োগকারী। এর মধ্যে সব প্রতিকূল পরিস্থিতি সামাল দিয়ে এখনও লাখ লাখ বিনিয়োগকারী পুঁজিবাজারে টিকে আছেন। পরিস্থিতি বদলাবে এমন আশায় তীর্থেক কাকের মতো অপেক্ষা করছেন তারা। কিন্তু কিছুতেই বাজারচিত্র পাল্টাচ্ছে না। বরং দিন দিন পরিস্থিতি আরও নাজুক হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে লাখো বিনিয়োগকারীর একটাই প্রশ্ন- আসলে কোন দিকে যাচ্ছে পুঁজিবাজার।

 

পুঁজিবাজার পরিস্থিতি নিয়ে কথা বললে বাজার-সংশ্লিষ্টরা মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। পুঁজিবাজার পরিস্থিতি আগের চেয়ে ভালোর দিকে যাচ্ছে- অনেকে এমন কথা বললেও ভিন্ন কথা বলছেন কেউ কেউ। তাদের মতে, বাজার হিরুদের মতো কারসাজিকারীদের হাতে বন্দি। এদের হাত থেকে মুক্তি না পেলে বাজার কখনও তার স্বাভাবিক ধারায় ফিরে আসবে না।

 

বিষয়টি নিয়ে কথা বললে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক শাকিল রিজভী বলেন, ‘আগামীতে বাজার পরিস্থিতি আরও ভালো হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। এর প্রধান কারণ বাজারে সিংহভাগ কোম্পানির শেয়ারদর হাতের নাগালে রয়েছে। এসব শেয়ারদর এমন অবস্থানে রয়েছে যে, এখান থেকে আর হ্রাস পাওয়ার শঙ্কা নেই। দেখেশুনে বিনিয়োগ করলে এখান থেকে ভালো ফল প্রত্যাশা করাই যায়। তাছাড়া ব্যাংকে বিনিয়োগ না করে অনেকেই পুঁজিবাজারে আসছেন। এটাও বাজারের জন্য সুখবর। এমন হলে বাজার পরিস্থিতি আগামীতে আরও ভালো হবে।’

 

একই প্রসঙ্গে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, পৃথিবীর সব পুঁজিবাজারেই উত্থান-পতনের ঘটনা ঘটছে। আমাদের দেশেও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে আমাদের দেশের বিনিয়োগকারীরা অল্পতেই ধৈর্যহারা হয়ে পড়েন। যার প্রভাব পড়ে পুঁজিবাজারে। এমনটি না করে তারা যদি যে কোনো পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রস্তুত থাকেন, তাহলেই বাজারচিত্র বদলাবে।

 

অন্যদিকে, বিষয়টি নিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি ব্রোকারেজ হাউসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে চেষ্টা করলে বাজার পরিস্থিতি পাল্টানোর সম্ভাবনা কম। কারণ বাজার একটি চক্রের হাতে বন্দি। এটা নিয়ন্ত্রণ করছে হিরুর মতো খেলোয়াড়রা। এদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা এখান থেকে শুধু সর্বস্বান্তই হবেন, কিছু পাবেন না। তিনি বলেন, আগে যারা বাজার নিয়ে খেলেছেন, তাদের সেভাবে শাস্তি হয়নি। ফলে এখনও কারসাজিকারীরা নিশ্চিন্তে তাদের কাজ করে যাচ্ছেন।

 

যে কারণে ভালো হতে পারে পুঁজিবাজার : বাজারে এখনও অধিকাংশ শেয়ার ও ইউনিটদর কম। এখনও ১০ টাকার নিচে রয়েছে শতাধিক প্রতিষ্ঠানের শেয়ারদর। ২০ থেকে ৩০ টাকার মধ্যে রয়েছে প্রায় ৭০ শতাংশ শেয়ার। অন্যদিকে ৩০ থেকে ১০০ টাকা বা তার চেয়ে বেশি দর রয়েছে মাত্র ত্রিশ শতাংশ শেয়ারের। অতিমূল্যায়িত শেয়ার নেই বললেই চলে। একইভাবে ফ্লোর প্রাইস বেঁধে দেয়ার কারণে দর অস্বাভাবিক হ্রাস পাওয়ার শঙ্কা নেই। অন্যদিকে আইসিবিসহ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা বাজারে বিনিয়োগ অব্যাহত রেখেছে। সরকারের পক্ষ থেকে পুঁজিবাজার স্থিতিশীলকরণ ফান্ড গঠন চলমান রয়েছে। এই অর্থ বাজারে এলে বাজারের গতি আরও বাড়বে। সর্বোপরি পুঁজিবাজারে প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি হস্তক্ষেপ রয়েছে। তিনি সংশ্লিষ্টদের বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন।

 

যে কারণে চিত্র বদলাবে না : আগে যারা বাজার নিয়ে কারসাজি করেছেন, তাদের বিচার হয়নি। একইভাবে বর্তমানে যারা কারসাজি করছেন, তাদের শনাক্ত করা হলেও প্রমাণের অভাবে শাস্তির আওতায় আনা হচ্ছে না। পাশাপাশি হিরুর মতো নামধারী বড় বিনিয়োগকারী এবং প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা নিয়মের মধ্যে কৃত্রিমভাবে বাজারচিত্র বদলে দিচ্ছেন। এদের রুখতে না পারলে বাজারচিত্র বদলাবে না। সর্বোপরি সাধারণ বিনিয়োগকারীরা অতি লোভে গুজবে কান দিয়ে বিনিয়োগ করছেন। দ্রুত পোর্টফোলিও পরিবর্তন করছেন। এতে হাউস মালিকরা লাভবান হলেও তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। বাজারচিত্র বদলাচ্ছে না।

 

প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২০০৯-এর শেষের দিকে মাত্র দুই মাসের ব্যবধানে ডিএসইর সূচক প্রায় এক হাজার ২০০ পয়েন্ট বেড়ে আট হাজার ৯১৮-এ অবস্থান করে। আর ডিএসইর লেনদেন গিয়ে দাঁড়ায় তিন হাজার ২৪৯ কোটি টাকায়। ঊর্ধ্বমুখী বাজারে কোনো কোনো শেয়ার ৩০০ থেকে ৪০০ শতাংশ পর্যন্ত অতিমূল্যায়িত হয়ে পড়ে। এর পরপরই বাজারে ধস নামে। ২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বর এক দিনের ব্যবধানে সূচকের পতন হয় ৬০০ পয়েন্ট। অতিমূল্যায়িত শেয়ারগুলোর দর দ্রুত কমে যায়। ক্রেতাশূন্য হয়ে যায় পুঁজিবাজার। বড় ধরনের লোকসানের মুখে পড়েন বিনিয়োগকারীরা। পুঁজি হারিয়ে রাস্তায় নেমে আসেন লাখ লাখ বিনিয়োগকারী। ধকল সামাল দিতে না পেরে আত্মহত্যা করে খবরের শিরোনাম হন যুবরাজ, রনি, জামানসহ অনেকে। এরপর পেরিয়ে গেছে এক যুগ। এই সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি হস্তক্ষেপসহ সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু তারপরও সেই সময়ের ধসের রেশ কাটাতে পারেননি অনেক বিনিয়োগকারী।

 

পতনের পর পুঁজিবাজারের লাগাম টেনে ধরার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে বাজার উন্নয়নের জন্য নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এ সময় সরকারের পক্ষ থেকে বিনিয়োগকারীদের জন্য বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন এ প্যাকেজ ঘোষণা করে। এ প্রণোদনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য- বিনিয়োগকারীদের সুদ মওকুফ ও কোটা নিশ্চিতকরণ। গঠন করা হয় বাংলাদেশ ফান্ড। বাজারকে সাপোর্ট দেয়ার জন্য শেয়ার কিনতে এগিয়ে আসে আইসিবিসহ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা। কিন্তু কিছুতেই বাজারের পতন ঠেকানো সম্ভব হয়নি, বর্তমানেও যা চলমান রয়েছে। বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ যাতে ক্ষুণ্ন না হয় সে জন্য সরকারের পক্ষ থেকে বারবার তাগিদ দেয়া হয়েছে। আইপিও শিকারিদের দৌরাত্ম্য থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সবার জন্য আইপিওর শেয়ার সমহারে বণ্টনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। নতুন করে সাজানো হয়েছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের চেয়ারম্যান একং কমিশনারদের। বর্তমানে তারা পুঁজিবাজারে ভালো কোম্পানির শেয়ার আনার পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগ আনার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। তবে কারসাজিকারীদের বাগে না আনতে পারায় বাজারচিত্র বদলাচ্ছে না।

 

ভোরের আকাশ/আসা

মন্তব্য

Beta version