-->
শিরোনাম
বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ

প্রধানমন্ত্রীর সফর যুগসন্ধিক্ষণের সূচনা

জাফর আহমদ
প্রধানমন্ত্রীর সফর যুগসন্ধিক্ষণের সূচনা

ঢাকা: বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগে তালিকায় থাকা দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র সামনের সারির। আগে থেকেই প্রবাসী আয় ও প্রধান রপ্তানিপণ্য তৈরি পোশাকের বড় বাজার দেশটি। প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক যুক্তরাষ্ট্র সফরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্কের নতুন উচ্চতায় পৌঁছানোর সুযোগ তৈরি হয়েছে। অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্র সফর করে সেখানকার উদ্যোক্তাদের বাংলাদেশে এমন সময় বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়েছেন, বাংলাদেশে বিনিয়োগে নতুন সুযোগ সুবিধার কথা বলেছেন, যখন যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের বাজারে চীনের আধিপত্য কমাতে নতুন দেশের সন্ধানে আছে। ইতোমধ্যে দেশটিতে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের বাজার বড় হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর যুক্তরাষ্ট্র সফরের মধ্য দিয়ে সেখানকার সরাসরি বিনিয়োগ বৃদ্ধির পাশাপাশি রপ্তানি বৃদ্ধির সুযোগ তৈরি হয়েছে।

 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুই সপ্তাহের বেশি সময় যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র সফর করেছেন। এ সময় তিনি যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোক্তাদের বাংলাদেশে যৌথ বা এককভাবে বিনিয়োগের আহ্বান করেন। বাংলাদেশে বিনিয়োগে যেসব প্রতিবন্ধকতা আছে বা বিদেশি উদ্যোক্তারা যেসব পরিস্থিতিকে বাধা বলে মনে করেন, সেগুলোও দূর করার আশ^াস দেন তিনি। বিষয়গুলো বাংলাদেশে বিনিয়োগ হওয়ার পথে একটি উল্লেখযোগ্য দিক বলে মনে করেন তারা। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন যখন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিরোধে জড়িয়ে পড়েছেন, সেসময়ে প্রধানমন্ত্রীর যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে বৈঠক বিনিয়োগ বৃদ্ধির পথে একটি ইতিবাচক বার্তা দিয়েছে। বাংলাদেশে অন্যতম প্রধান বিদেশি বিনিয়োগকারী দেশ যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের গ্যাস ও পেট্রোলিয়াম, টেক্সটাইল ও ওয়ারিং, বিদ্যুৎ, ট্রেডিং এবং ব্যাংকিং খাতে বিনিয়োগ রয়েছে।

 

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, চলতি ২০২২ সালের জানুয়ারি-মার্চ তিন মাসেই ১০২ মিলিয়ন সরাসরি বিনিয়োগ এসেছে। এছাড়া পূর্বের বিনিয়োগ রয়েছে দেশটির। প্রধানমন্ত্রীর সফর ও সেখানকার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বাংলাদেশের বিনিয়োগকারীর মতবিনিময় এবং বিনিয়োগে সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধিতে প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসের ফলে বিনিয়োগ বৃদ্ধির নতুন পথ খুলেছে। প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী তৈরি পোশাক খাতের এক উদ্যোক্তা এমনটাই জানান। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি আগে থেকেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত মাসেও বেড়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সফরকেও আমরা কাজে লাগাব।

 

বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে জমি পাওয়া, নিবন্ধনের ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর, বিনিয়োগের শেষে মুনাফাসহ অর্থ দেশে ফেরত নেয়ার ক্ষেত্রে বাধা হয়। এসব কারণে বিদেশি বিনিয়োগ করতে নিরুৎসাহিত হয়। প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় বিনিয়োগকারীদের আশ্বস্ত করেছেন এসব সমস্যা সমাধান ও অর্থনৈতিক জোনে বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগকারীরা ইচ্ছা করলে একক বা যৌথ বিনিয়োগ করতে পারে। নিশ্চই এটা কথার কথা নয়। এ ধরনের বক্তব্য বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগের পালে হাওয়া লাগতে পারে বলে মনে করেন বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন।

 

তিনি ভোরের আকাশকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিফলন দেখাতে হবে। তিনি বলেন, চীন থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগকারীরা বিকল্প দেশ খুঁজছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারের একচ্ছত্র আধিপাত্য কমাতে বাণিজ্য সংঘাত চলছে। ভূরাজনৈতিক কারণেও দ্বন্দ্ব প্রকট হয়েছে দেশ দুটির মধ্যে। যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগকারীররা নতুন দেশের সন্ধানে আছে। তারা চীন থেকে বের হতে চায়। এ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশে সুযোগ-সুবিধা দেয়ার ঘোষণা সময়োপযোগী।

 

বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সমস্যা দূর করতে কাজ করছে বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)। ব্যাবসা বাণিজ্যের নিবন্ধন, পানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও অন্যান্য সেবা একত্রে দিতে বিডা যে কাজ করছে, সেটা দ্রুত করতে হবে। বিদেশিদের অর্থ দেশে আসতে, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা থেকে টাকা বিদেশে ফেরত পাঠানো পর্যন্ত সব ক্ষেত্রে বাংলাদেশে সমস্যা রয়েছে। দেশে বিনিয়োগের টাকা আনা যত সহজ, নিয়ে যাওয়া তার চেয়ে শতগুণ কঠিন। এ কারণেও বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগকারীদের দেশে আহ্বান জানাচ্ছেন; এসব বিনিয়োগকারীরা নতুন দেশ খুঁজছে, তখনো বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সমস্যাগুলো বিদ্যমান। এসব সমস্যা যদি সমাধান না করা হয়, তাহলে প্রধানমন্ত্রীর যুক্তরাষ্ট্র সফর, আলাপ-আলোচনা আনুষ্ঠানিকতার মধ্যেই রয়ে যাবে, কোনো কাজ হবে না- বলেন এ অর্থনীতিবিদ। একক দেশ হিসেবে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে প্রধান দেশ হলো যুক্তরাষ্ট্র।

 

বিজিএমইএ সূত্র জানায়, প্রতিদিনই যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে কার্যাদেশ বাড়ছে। চীনের উইঘুর প্রশ্ন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে চীনের তৈরি পোশাক, তুলা ও তুলাজাত পণ্য রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। ফলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে দুই প্রধান প্রতিপক্ষ চীন ও ভিয়েতনাম অসুবিধায় আছে। ভিয়েতনাম অতিমাত্রায় চীননির্ভর হওয়ার কারণে দেশটি সমস্যায় আছে। এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশ সুবিধাজনক অবস্থায় আছে।

 

এ বিষয়ে নিট তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) কার্যনির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম ভোরের আকাশকে বলেন, চীনের সঙ্গে উইঘুর ইস্যুসহ নানা কারণে যুক্তরাষ্ট্রের খারাপ সম্পর্ক যাচ্ছে। তারা চীনের তুলাসহ নানা বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এ অবস্থায় চীনের তৈরি পোশাক যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি কমেছে; যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারা বাংলাদেশমুখী হয়েছে। গত কয়েক মাসে যুক্তরাষ্ট্রের কার্যাদেশ বেড়েছে, এখনো সে ধারা অব্যাহত আছে। দেশটিতে বাংলাদেশের রপ্তানি বেড়েছে। আগামীতে এ ধারা অব্যাহত থাকবে বলে মনে হচ্ছে।

 

তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির তথ্য মতে, ২০২১ সালের একই সময়ের তুলনায় বাংলাদেশ থেকে পোশাক আমদানি ৫৪.৪৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে যেখানে বিশ্ব থেকে তাদের আমদানি ৩৯.০৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। উল্লেখিত সময়ের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ থেকে ৫.৭১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের পোশাক আমদানি করেছে। উল্লেখিত সময়ে চীন থেকে আমদানি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৪০ শতাংশ। চীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য শীর্ষ পোশাক আমদানির উৎস।

 

উল্লেখিত সময়ে চীন থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পোশাক আমদানি হয়েছে ১২.৭৯ বিলিয়ন ডলার। একই সময়ে ভিয়েতনাম থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আমদানি ৩৫.৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে; আমদানি পৌঁছেছে ১০.৯১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি বৃদ্ধির হার চীন ও ভিয়েতনামের তুলনায় বেশি। চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য বৈরী তৈরি হওয়ার পর থেকে প্রবৃদ্ধির হার বেড়েছে।

 

মোহাম্মদ হাতেম বলেন, তৈরি পোশাক রপ্তানি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র এখন আকর্ষণীয় দেশ। এক্ষেত্রে ব্যবসায়ী প্রতিনিধি দলসহ প্রধানমন্ত্রীর যুক্তরাষ্ট্র সফর তৈরি পোশাক রপ্তানি বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখতেও পারে। তবে বাংলাদেশের ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা থাকার কারণে সরাসরি বিনিয়োগে আসা আশা করা ঠিক হবে না। যুুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ আসার ক্ষেত্রে তাদের সঙ্গে বিদ্যমান রাজনৈতিক সম্পর্ক প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে না মনে করেন ড. জাহিদ হোসেন।

 

তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক খুবই শক্ত। যুক্তরাষ্ট্র তৈরি পোশাকের বড় বাজার। শ্রমবাজারের জন্যও যুক্তরাষ্ট্র বড় দেশ।

 

 

মন্তব্য

Beta version