নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে নির্দিষ্ট আয়ের শ্রমজীবী মানুষের নাভিশ্বাস অবস্থা। নিত্যপণ্য থেকে শুরু করে সব ধরনের পণ্য ও সেবার মূল্য বেড়েছে। সরকারি হিসাবেই এ হার ৯ শতাংশের উপরে। নিত্যপণ্যসহ সব ধরনের সেবার মূল্যবৃদ্ধির হিসাবে মূল্যস্ফীতি আরো বেশি। আগস্ট-সেপ্টেম্বর দুই মাসে নিত্যপণ্যে এ নাগালছাড়া অবস্থা তৈরি হয়েছে। নির্দিষ্ট আয় দিয়ে চলছে না শ্রমজীবী মানুষের। তারা দিশাহারা। সরকারি হিসাবে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের নিচে। কিন্তু বাস্তব চিত্র হলো মূল্যস্ফীতি দুই ডিজিট অনেক আগেই ছাড়িয়ে গেছে, শ্রমজীবী মানুষের যাপিত জীবনের খরচের হিসাবে তাই বলে। সরকার যখন হিসাব করে, তখন ৪৫০টির মতো পণ্যের হিসাব করে। কিন্তু শ্রমজীবী মানুষের চাল, ডাল, লবণ, তেল, আটা, চিনি ১৭টি প্রধান পণ্য, পরিবহন ভাড়া গড় করলে গড় মূল্যস্ফীতি ১৮ শতাংশের উপরে উঠে যায়। কারণ শ্রমজীবী মানুষ প্রতিদিন যেমন মোবাইল কেনেন না, আবার বিলাসদ্রব্যও কেনেন না। ফলে সরকারের মূল্যস্ফীতির হিসাবে সঙ্গে শ্রমজীবী মানুষের রোজকার খরচের হিসাবের মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। পার্থক্যই নির্দেশ করে শ্রমজীবী মানুষের ওপর মূল্যবৃদ্ধির আঘাতটা কতটা তীব্র! ফলে তাদের জীবনযাপন দুর্বিষহ হয়ে উঠছে বলে মনে করেন সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের সভাপতি রাজেকুজ্জামান রতন।
করোনা মহামারি ও পরবর্তী সময়ে এবং ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র্র করে এমনিতেই নিত্যপণ্যসহ সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়েছিল। গত আগস্ট মাস থেকে এ মূল্যবৃদ্ধির হার আরো বেড়েছে। শ্রমিক তার উপার্জনের প্রায় পুরোটাই থাকা, খাওয়া আর সন্তানের লেখাপড়ার কাজে ব্যয় করেন। এসব নিত্যপণ্য ও সেবা কিনতে তাদের প্রাপ্ত মজুরি দিয়ে আর চলছে না। আগস্ট-সেপ্টেম্বর দুই মাসজুড়ে প্রতিদিনই নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। প্রতিদিনই চাল, ডাল, তরি-তরকারি, সাবান, চিনি, দুধ, কাপড়ের মধ্যে কোনো না কোনোটির দাম বেড়েছে। আগের দিন যে পণ্যসেবা এক দামে কিনেছে, পরদিনই তার কোনো না কোনোটিার দাম বেড়েছে। বাদ যায়নি মাথাব্যথা বা জ¦রের ট্যাবলেট থেকে শুরু করে পরিবহনের ভাড়াও, যা শ্রমিকের মজুরিকে ধাক্কা দিয়েছে। ফলে শ্রমিকের মজুরি দিয়ে আর চলছে না। এ অবস্থায় হয় খাওয়া কমিয়ে দিতে হয়েছে, না হয় ধারদেনা করে জীবন নির্বাহ করতে হয়েছে।
রাজেকুজ্জামান রতন ভোরের আকাশকে বলেন, শ্রমজীবী মানুষের প্রটিনের প্রধান উৎস ডিম ও ব্রয়লার মুরগির কথা যদি বলেন তারও দাম বেড়েছে। মুরগির দাম কেজিতে বেড়েছে ২০ টাকার ওপরে, ডিমের ডজনেও বেড়েছে ২০ টাকার বেশি। কাজেই ৯ শতাংশ মূল্যস্ফীতির যে কথা সরকার বলছে, তা অনেক আগেই ছাড়িয়ে গেছে। একদিকে মুল্যস্ফীতি বাড়ছে বলছে; অন্যদিকে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে গার্মেন্টস মালিকসহ রপ্তানিকারকরা একটু সুবিধা পাচ্ছে। আবার কাঁচামাল আমদানি করতে বেশি দাম দিতে হচ্ছে, এভাবে তারা ব্যালেন্স করছে। এ শ্রমজীবী মানুষের ব্যালেন্স করার উপায়টা কী? শ্রমজীবী মানুষ কোনোভাবেই এ ব্যালেন্স করতে পারছে না। হয় খাবার কমিয়ে দিতে হচ্ছে বা অন্যান্য খরচ কমিয়ে দিতে হচ্ছে। কারণ তারা তো বাড়ি ভাড়া কমাতে পারবে না, গাড়ি ভাড়া কমাতে পারবে না, ওষুধের দাম কমাতে পারবে না, চালের দাম কমাতে পারবে না। তারা কমাতে পারবে কী, কমাতে পারবে খাওয়া, কাপড় কেনা। ফলে ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া পড়ছে শরীরের ওপর এবং মনের ওপর। এতে অসন্তোষ মনোভাব নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে শ্রমজীবী মানুষ এক দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন।
আশুলিয়ার শ্রমিক রাকিব উদ্দিন, যিনি স্বামী-স্ত্রী মিলে নামকরা দুটি ভিন্ন কারখানায় চাকরি করেন। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে তার সংসারে টান পড়েছে। আগে দুজনের আয় দিয়ে সংসার চালিয়ে কিছু টাকা সঞ্চয়ও করতেন। তিনি ফোনে ভোরের আকাশকে বলেন, জিনিসপত্রের দাম আগে বাড়লেও এবার বেশি বাড়ায় বেশি সমস্যায় পড়তে হয়েছে। সঞ্চয় করা যাচ্ছে না। আগে বছরখানেক খরচ কমিয়ে সংসার চালাতাম। এ বছরে এসে কোনোভাবেই চলছে না। বাধ্য হয়ে অর্ধেক ভাড়ার বাসাতে গেছি, খাওয়া-দাওয়া কমাতে হয়েছে; তাতেও সামাল দেয়া যাচ্ছে না। যারা একা চাকরি করে সংসার চালান তাদের অবস্থা কী- রাকিবের প্রশ্ন। তার কথাতেই শ্রমজীবী মানুসের অবস্থা ফুটে উঠেছে।
মিরপুর, আশুলিয়া-সাভার, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জের শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির ফলে শ্রমিককে উভয় সংকটে মধ্যে পড়তে হয়েছে। বেতন বাড়ছে না, বাড়তি আয়ও নেই। প্রাপ্ত বেতন দিয়ে শ্রমিকের চলছে না। এ কথা কোথাও বলারও সুযোগ নেই। বেতন বৃদ্ধির কথা বলতে গেলেই চাকরিচ্যুত করে বা চিহ্নিত করে রাখে, আশপাশের কোনো কারখানায়ও বিক্ষোভ হলে এসব মার্ক করে রাখা শ্রমিককে চাকরিচ্যুত করে। পুলিশের ভয় দেখানো হয়। চাকরিচ্যুত করা শ্রমিকের ছবি-বায়োডাটা অনলাইনে অন্য কারখানায় ছড়িয়ে দেয়া হয় বা দেয়ালে টাঙিয়ে দেয়া হয়। ফলে ওই শ্রমিকের চাকরি পাওয়া কঠিন হয়ে যায়। এভাবে শিল্পকারখানাজুড়ে আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করে রাখা হয়েছে। চাকরিচ্যুত শ্রমিকটি জানান, শুধু চাকরিচ্যুতই করা হয়নি। অন্যান্য কারখানায় নাম ছবি পাঠানো হয়েছে, যাতে তার চাকরি না হয়। আমি তো কারখানায় বেআইনি কিছু করিনি, কোনো শ্রমিক সমস্যায় পড়লে তার পক্ষে কথা বলেছি, ফাও খাটাতে চাইলে কারণ জানতে চেয়েছি, বেতন দিতে দেরি হলে কেন দেয়া হচ্ছে না- কবে দেয়া হবে জানতে চেয়েছি। এটাই আমার অপরাধ। তিনি ছাঁটাই, নির্যাতন বন্ধ ও মজুরি বোর্ড গঠন করে বেতন বৃদ্ধির দাবি জানান।
শ্রমিক সংগঠনগুলোও মজুরি বোর্ড গঠন করে বেতন বৃদ্ধি করার দাবি জানিয়ে আসছে। যতদিন পর্যন্ত বেতন বৃদ্ধি না হবে, ততদিন মহার্ঘ ভাতা ও রেশনের মাধ্যমে নিত্যপণ্য সরবরাহের দাবি জানিয়ে আসছে সংগঠনগুলো। তারা ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, সাভার-আশুলিয়ায় বিক্ষোভ মিছিলও করেছে। চাল, আটা, তেলসহ নিত্যপণ্য, জালানি তেল, সিলিন্ডার গ্যাসের দাম ও গণপরিবহনের ভাড়া কমানো এবং শ্রমজীবী ও নিম্নআয়ের মানুষের রেশনের দাবিতে নারায়ণগঞ্জে বিক্ষোভ করেছে রিকশা-ভ্যান শ্রমিক ইউনিয়ন।
সমাবেশে শ্রমিক নেতারা বলেন, প্রতিনিয়তই নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে। অব্যাহত দাম বৃদ্ধিতে শ্রমজীবী মানুষ দিশাহারা। নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির ফলে শ্রমিক ভালো নেই, বারবার সরকারের মন্ত্রীরাও বলছেন। এ সমস্যা সমাধানে তারা খোলাবাজারে বিক্রি হওয়া কম দামের চাল, ডাল, চিনি, তেল শ্রমিকের মাঝেও বিক্রি করার কথা বললেও বাস্তবে এর প্রতিফলন নেই।
বলা হচ্ছে, যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক মূল্যস্ফীতির আঘাত পড়েছে দেশের বাজারে। এ কারণে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। শ্রমজীবী মানুষের বক্তব্য, তাহলে আন্তর্জাতিক মূল্যস্ফীতি ও ডলারের দাম বৃদ্ধির ফলে রপ্তানি আয় বেড়েছে তার ফল পাচ্ছেন মালিকরা।
শ্রমজীবী মানুষ ভালো নেই বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশিও স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক মূল্যস্ফীতি ও রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। সরকারের কিছু করণীয় নেই। তারপরও শুল্ক কমিয়ে ও বাজারে বিভিন্নভাবে তদারকি করে পণ্যমূল্য কমানোর সর্বাত্মক চেষ্টা করা হচ্ছে। কম আয়ের মানুষের জন্য ওপেন মার্কেট সেলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। শ্রমজীবী মানুষের কষ্ট লাঘবে সরকারের উচিত, আমরাও চেয়েছিলাম দ্রব্যমূল্য সিন্ডিকেটের হাত থেকে বের করা এবং শ্রমজীবী মানুষকে রক্ষার জন্য রেশন চালু করা। সরকার বলছে, ওপেন মার্কেটের ব্যবস্থা করেছি। কারখানার চাকরি বাদ দিয়ে শ্রমিক কি লাইন ধরে চাল, ডাল, তেল সংগ্রহ করতে পারবে! ওপেন মার্কেট সেল শ্রমজীবী মানুষের কোনোই কাজে আসছে না।
ভোরের আকাশ/আসা
মন্তব্য