-->
শিরোনাম
মূল্যস্ফীতির বেহিসাব

ধনীর বাজারে গরিবের কষ্ট

জাফর আহমদ
ধনীর বাজারে গরিবের কষ্ট

আয় কম, জীবনযাপনের ব্যয় বেশি। নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্যের চাপে পিষ্ট কম আয়ের শ্রমজীবী মানুষ। চাল, ডাল, আটা, লবণ, তেল, মুরগি, ডিম, যাতায়াত খরচে চলে যাচ্ছে আয়ের সবটুকু।

 

চলতি বছরের আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল সাড়ে ৯ শতাংশ। অর্থাৎ গত বছরের আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে যে দামে পণ্য ও সেবা কেনা হয়েছিল, এ বছর আগস্ট-সেপ্টেম্বর দুই মাসে তার চেয়ে সাড়ে ৯ শতাংশের মতো বেড়েছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়াধীন পরিসংখ্যান ব্যুরো মিরপুরের ভাসানটেকের রাহেলা, নাটোরের লালপুরের শেল্টার সেন্টারের হাসেম আলী, আশুলিয়ার শ্রমিক মোহন মিয়া, রাজশাহী শহরের উচ্চ আয়ের প্রভাষক আজগর আলী ও মিরপুর ১০-এর তুলনামূলক অভিজাত এলাকার আলী আযমের জীবন নির্বাহের খরচের গড় করে মূল্যস্ফীতি নির্ণয় করা হচ্ছে।

 

অর্থনীতিবিদ ও শ্রমিক নেতারা বলছেন, একটি ভ্রান্ত ভিত্তির ওপর মূল্যস্ফীতি হিসাব করার কারণে শ্রমিক, কম আয়ের প্রান্তিক মানুষ জীবন নির্বাহে যে হারে খরচের সম্মুখীন হচ্ছে, তা প্রতিফলিত হচ্ছে না। গতকাল ঢাকার বাজারের মূল্য পরিস্থিতির সঙ্গে শ্রমজীবী মানুষ যেসব পণ্য ও সেবা কিনেছিল, সে দাম গত বছরের একই সময়ের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায় গড় বৃদ্ধির হার পণ্য ও সেবাভেদে ১০ থেকে ৫৫ শতাংশ পর্যন্ত। এসব পণ্য একসঙ্গে করলে মূল্যস্ফীতি ২০ শতাংশের নিচে হবে না। গত বছর অক্টোবর মাসে রাজধানীতে মোটা চাল বিক্রি হয়েছিল ৪২ থকে ৪৮ টাকায়, গতকাল বিক্রি হয়েছে ৪৬ থেকে ৫৪ টাকায়; বৃদ্ধির হার প্রায় ১৮ শতাংশ। গতকাল মোটা ডাল বিক্রি হয়েছে ৯৫ থেকে ১০৫ টাকায়, এক বছর আগে বিক্রি হয়েছিল ৮৫ থেকে ৯০ টাকায়; বৃদ্ধির হার প্রায় ১০ শতাংশ। গত বছর ভোজ্যতেল প্রতি কেজি বিক্রি হয়েছিল ১৪৫ টাকায়, এ বছর বিক্রি হচ্ছে ১৮০ থেকে ১৮৫ টাকায়; বৃদ্ধির হার প্রায় ২৭ শতাংশ।

 

গত বছরে আটা বিক্রি হয়েছিল ৩৫ টাকায়, এবার বিক্রি হচ্ছে ৫৫ থেকে ৫৮ টাকায়; বৃদ্ধির হার প্রায় ৫৫ শতাংশ। একইভাবে চিনির দাম বেড়েছে ২৫ শতাংশ, গুঁড়া দুধ ৩০ শতাংশ, লবণ ৩০ শতাংশ এবং গরিব মানুষের প্রোটিনের প্রধান ভরসা ব্রয়লার মুরগি ও ডিমের হালিতে বেড়েছে যথাক্রমে ৩১ শতাংশ ও ৪২ শতাংশ। এভাবে অন্যান্য নিত্যপণ্য ও সেবার দাম বেড়েছে, যা কোনোভাবেই সাড়ে ৯ শতাংশ নয়।

 

মূল্যস্ফীতি নির্ণয়ের পদ্ধতি সঠিক নয়। এ হিসাবে শ্রমজীবী ও কম আয়ের মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় প্রতিফলিত হয় না বলে মনে করেন শ্রমিক ফ্রন্টের সভাপতি রাজেকুজ্জামান রতন। তিনি ভোরের আকাশকে বলেন, সরকারের হিসাবে মূল্যস্ফীতি এক অঙ্কের ঘরে। বাস্তব চিত্র হলো, মূল্যস্ফীতি দুই ডিজিট অনেক আগেই ছাড়িয়ে গেছে, শ্রমজীবী মানুষের যাপিত জীবনের খরচের হিসাবে তাই-ই বলে। সরকার যখন হিসাব করে তখন চার শতাধিক পণ্যের হিসাব করে। কিন্তু শ্রমজীবি মানুষের চাল, ডাল, লবণ, তেল, আটা, চিনিসহ ১৭টি প্রধান পণ্য, পরিবহন ভাড়া গড় করলে মূল্যস্ফীতি ১৮ শতাংশের ওপরে উঠে যায়। কারণ শ্রমজীবী মানুষ প্রতিদিন যেমন মোবাইল কেনে না, আবার বিলাসদ্রব্যও কেনে না। ফলে সরকারের মূল্যস্ফীতির হিসাবের সঙ্গে শ্রমজীবী মানুষের রোজকার খরচের হিসাবের মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। পার্থক্যটা নির্দেশ করে শ্রমজীবী মানুষের ওপর মূল্য বৃদ্ধির আঘাতটা কতটা তীব্র। ফলে তাদের জীবনযাপন দুর্বিষহ হয়ে উঠছে।

 

অর্থনীতিবিদ ও শ্রমিক নেতারা বলছেন, সরকারের হিসাবে মূল্যস্ফীতি কম দেখানো হচ্ছে। এর মাধ্যমে এক ধরনের তুষ্টি আছে। দেশের অর্ধেকের বেশি শ্রমজীবী ও প্রান্তিক গরিব মানুষ। যাদের আয়ের প্রায় পুরোটাই চলে যাচ্ছে নিত্যপণ্য ও জরুরি সেবা কিনতে। দেশের মূল্যস্ফীতির যে হিসাব দেখানো হচ্ছে, তা উচ্চবিত্ত মানুষ ও অভিজাত এলাকার হিসাব করে। এর ফলে ধনী মানুষের সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্যের তলে চাপা পড়ে যাচ্ছে জীবনযাত্রায় ব্যয় বৃদ্ধিজনিত কষ্ট। তারা বলছেন, মূল্যস্ফীতি ও ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় রপ্তানিকারক ও বড়লোকেরা একটু সুবিধা পাচ্ছে। আবার কাঁচামাল আমদানি করতে বেশি দাম দিতে হচ্ছে, এভাবে তারা ব্যালেন্স করছে। শ্রমজীবী মানুষ কোনোভাবেই এই ব্যালেন্স করতে পারছে না। হয় খাবার অথবা অন্যান্য খরচ কমিয়ে দিতে হচ্ছে। কারণ তারা তো বাড়িভাড়া কমাতে পারবে না, গাড়িভাড়া কমাতে পারবে না, ওষুধের দাম কমাতে পারবে না, চালের দাম কমাতে পারবে না। তারা কমাতে পারবে কি, পারবে না। কমাতে পারবে খাওয়া ও কাপড় কেনা। ফলে ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া পড়বে শরীর ও মনের ওপরে, যা উৎপাদনশীলতায় আঘাত করবে।

 

মূল্যস্ফীতির হিসাবে শ্রমজীবী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী প্রতিফলিত হচ্ছে না বলে মনে করেন সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান। তিনি ফোনে ভোরের আকাশকে বলেন, অফিসিয়ালি যে মূল্যস্ফীতি আমরা দেখছি, সাধারণ মানুষ আরো বেশি মোকাবিলা করে।

 

পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব-নিকাশ আরো ঠিক করা দরকার; ভিত্তি বছর ঠিক করা দরকার। তারা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য আলাদা হিসাব-নিকাশ বের করতে পারে। গড় হিসাব দিয়ে যে মূল্যস্ফীতি দেখানো হয়, সেখানে সাধারণ মানুষের বাস্তবতার চিত্র প্রতিফলিত হয় না। এই গড়মূল্য দেখে নীতিনির্ধারণ করা ঠিক হবে না। নীি নির্ধারণের ক্ষেত্র ধরে নিতে হবে সাধারণ মানুষ আরো বেশি মূল্যস্ফীতি মোকাবিলা করছে এবং সেভাবেই সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিগুলো নিতে হবে।

 

মূল্যস্ফীতির যে হিসাব, সেখানে শ্রমজীবী মানুষ ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বাস্তবতা প্রতিফলন হয় না, এটা সত্য কথা। তবে মূল্যস্ফীতির যে হিসাবটা করা হয় তা গড়। যেখানে চালের ব্যাপারে বিশেষভাবে নেয়া হয়। গড় হিসাবে সব জিনিসের সমান ধরা হয় না। চালের গড়টা বেশি থাকে। আবার অভিজাত এলাকা হিসেবে বারিধারার কথা বলি- সেখানকার জীবনযাত্রার ব্যয়টা অন্যভাবে নেয়া হয়। সাধারণত সার্ভে করে এটা বের করা হয়। বিভিন্ন এলাকার হাউসগুলোর চাহিদার হিসাব নিয়ে গড় করা হয়। তবে সব জনগোষ্ঠীর জন্য সঠিক চিত্র তুলে ধরতে এসব মানুষের ভিন্নভাবে হিসাব করা যেতে পারে।

 

প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য সঠিক পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়নে বস্তি ও কম আয়ের মানুষের বসবাস করা এলাকার মানুষের ভোগ-পরিস্থিতি ভিন্নভাবে ডাটা সংগ্রহ করতে পারে। এবং এর ভিত্তিতে মূল্যস্ফীতি নির্ণয় করতে পারে। তাহলে শ্রমজীবী ও স্বল্প আয়ের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সঠিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারে।

 

ভোরের আকাশ/আসা

মন্তব্য

Beta version