-->

ধানের উৎপাদনশীলতা হ্রাস, খাদ্য নিরাপত্তায় নতুন ঝুঁকি

জাফর আহমদ
ধানের উৎপাদনশীলতা হ্রাস, খাদ্য নিরাপত্তায় নতুন ঝুঁকি

ঢাকা: খাদ্য নিরাপত্তায় ভূমিকা রাখছে ব্রি-২৮ ও ব্রি-২৯ ধান। বোরা মৌসুমে এ ধান চাষ হয়। দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে সর্বোচ্চ ফলন দিচ্ছে এ ফসল। কিন্তু এ দীর্ঘ উৎপাদন প্রক্রিয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত, রোগপ্রতিরোধের ক্ষমতা হ্রাস, সারের অব্যাহত ব্যবহারের ফলে কার্যক্ষমতা হ্রাস পেয়ে উৎপাদনশীলতা কমে গেছে।

 

কৃষি বিজ্ঞানীরা বলছেন, অব্যাহতভাবে এ ধানের উৎপাদনশীলতা কমবে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য নিরাপত্তা ধরে রাখতে উচ্চফলনশীল নতুন ধানের জাত জরুরি ভিত্তিতে উৎপাদনে যেতে হবে। তা না হলে খাদ্য নিরাপত্তায় বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি হবে।

 

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে সর্বোচ্চ উৎপাদন হয়- এমন ধান হচ্ছে ব্রি-২৮ ও ব্রি-২৯। কিন্তু বর্তমানে এ ধানের উৎপাদন হেক্টরপ্রতি সাড়ে ৬ থেকে ৭ টনে নেমেছে। ২৫ বছর আগে যখন এ ধানের উৎপাদন শুরু হয়, তখন হেক্টরপ্রতি উৎপাদন হতো সাড়ে ৭ থেকে ৮ টন পর্যন্ত। ২৫ বছরের ব্যবধানে এ ধানে উৎপাদন কমেছে দেড় থেকে দুই টন। এ দুই জাতের উৎপাদনশীলতা হ্রাসের বিষয়টি স্বীকার করেন ব্রির গবেষণা পরিচালক ড. মোহাম্মদ খালেকুজ্জামান।

 

এদিকে মাঠপর্যায়ে কাজ করছেন- এমন এক কৃষি কর্মকর্তা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর মানিকগঞ্জের উপপরিচালক আবু মোহাম্মদ এনায়েত উল্লøাহও ধানের উৎপাদনশীলতা হ্রাসের বিষয়টি স্বীকার করেন। তিনি ফোনে ভোরের আকাশকে জানান, বর্তমানে জলবায়ু, সার ব্যবহারের ধারা, চাষের পদ্ধতি অব্যাহত থাকলে এ ধানের উৎপাদনশীলতা আরো কমবে। ফলে খাদ্য নিরাপত্তায় নতুন করে ঝুঁকি তৈরি হবে। ২০২১-১২ অর্থবছরে দেশে মোট ধানের উৎপাদন হয়েছে ৪ কোটি ৫ লাখ টন। এর মধ্যে ৪৫ থেকে ৫০ শতাংশ ব্রি-২৮ ও ব্রি-২৯। বাকি ধান আসে অন্যান্য জাতের ধান থেকে। সে বিবেচনায় ব্রি-২৮ ও ব্রি-২৯ ধানের উৎপাদন হ্রাসে খাদ্য উৎপাদনে বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। খাদ্য নিরাপত্তাঝুঁকির বিষয়ে চিন্তায় আছেন খোদ সরকারের কৃষি সম্পর্কিত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

 

এ বিষয়ে কৃষিমন্ত্রী ড. আ. রাজ্জাক বলেছেন, ব্রি-২৮ ও ব্রি-২৯-এর উৎপাদনশীলতা কমে আসার বিষয়টি আমরা অবগত। সম্ভাব্য ঝুঁকি মোকাবিলায় আমরা বিকল্প ব্যবস্থাও নিচ্ছি। পরিবর্তিত অবস্থা বিবেচেনায় উন্নত জাতের ধান প্রতিস্থাপনের চিন্তাও করছি বলে জানান তিনি। বলেন, শিল্পকারখানা স্থাপন, নদীভাঙন, ঘরবাড়ি তৈরিসহ নানা কারণে আমাদের আবাদি জমি কমছে। কিন্তু প্রতি বছর যুক্ত হচ্ছে নতুন মুখ। এ বাড়তি মানুষের চিন্তাও আমাদের করতে হচ্ছে। আমরা ইতোমধ্যে নতুন কিছু জাত আবিষ্কার করেছি, এসব জাত হলো ব্রি-৮৮, ৮৯ ও ৯২ ও বঙ্গবন্ধু-১০০। এতদিন যে সব ধান বেশি উৎপাদন হচ্ছিলো, এখন কমে যাচ্ছে। পুরোনো এ সব ধানের জায়গায় আমরা নতুন উচ্চফলনশীর ধান প্রতিস্থাপনে কাজ করছি। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিটের নতুন ছাড় করা ধানগুলো মধ্যে ব্রি-৮৮ ও ৮৯ হেক্টরপ্রতি ৯ থেকে ১০ টন ও বঙ্গবন্ধু-১০০ হেক্টরপ্রতি ৮ টন উৎপাদন হবে বলে জানান ব্রির গবেষণা পরিচালক খালেকুজ্জামান। এসব ধান ব্রি-২৮ ও ২৯-এ প্রতিস্থাপন হবে। ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। আগামী তিন বছরের মধ্যে নতুন জাতের এসব ধান পুরোপুরি মাঠপর্যায়ে চলে যাবে। সম্ভাব্য ঝুঁকি মোকাবিলায় ভূমিকা রাখবে নতুন উদ্ভাবিত এসব নতুন ধান।

 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উচ্চফলনশীল এ ধানের উৎপাদন কমার বিষয়টি মাঠপর্যায়েও আলোচিত হচ্ছে। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন কৃষক। রাজশাহীর বাঘমারার কৃষক ওবাইদুল হক বলেন, এ ধানের উৎপাদন কমে গেছে, আমরা কিছুদিন ধরে বুঝতে পারছি। কিন্তু নতুন যে ধানটি আসছে সেটা শুরু করব, ভরসা পারছি না। আবার প্রয়োজন মতো বীজও পাওয়া যাচ্ছে না বলে কেউ কেউ বলছেন। ধানের পুরোনো জাত নিয়ে প্রান্তিক পর্যায়ে কৃষক চিন্তিত। কুষ্টিয়া জেলার ভেড়ামারা উপজেলার কৃষকের সঙ্গে ফোনে কথা বললে তারা এমনটা জানান।

 

উপজেলার ষোলদাগ এলাকার কৃষক রফিকুল ইসলাম বলেন, ব্রি-২৮ ও ব্রি-২৯ জাতের ধানে রোগবালাই বেশি হয়। পোকা বেশি আক্রমণ করে। নতুন জাত খুঁজছি। আবার নতুন জাতের ঝুঁকিও কম না। নতুন উদ্ভাবিত উচ্চফলনশীল ধান পুরোনো ধানের স্থলাভিসিক্ত করার পরিকল্পনা নিলেও দ্রুত সম্ভব হচ্ছে না। প্রয়োজনীয় পরিমাণ বীজ না পাওয়া ও কৃষককে দ্রুত বোঝাতে না পারার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। তবে কৃষকের উৎকণ্ঠা দূর করতে সাহস দিচ্ছে দৌলতপুর উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা মো. নূরুল ইসলাম।

 

তিনি ফোনে ভোরের আকাশকে বলেন, প্রদর্শনী প্লট, বীজ সরবরাহের মাধ্যমে আমরা ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছি। আগামী ২০ শতাংশের বেশি জমিতে উন্নত জাতের ধান চাষ করতে পারব বলে আশা করছি। পর্যায়ক্রমে এ ধানের উৎপাদন বাড়াব। পুরোনো জাতের ধান নিয়ে কৃষক এতই হতাশ, উন্নত ও উচ্চফলনশীল নতুন জাত কৃষকের মাঝে না দিতে পারলে আগামীতে ধান চাষে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এতে খাদ্য নিরাপত্তায় বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি হবে।

 

এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর মানিগঞ্জের উপপরিচালক আবু মোহাম্মদ এনায়েত উল্লাহ বলেন, বীজের সমস্যা আছে। আবার নতুন ধান কৃষককে বুঝিয়ে চাষ করানোটাও কঠিন। বীজ বিএডিসি থেকে পেয়ে থাকি। বিএডিসি থেকে প্রয়োজন মতো বীজ সরবরাহ পাওয়াও একটি চ্যালেঞ্জ। আমরা যেটা করছি, গত বছর এখানকার মোট ধান চাষের জমির ১২ শতাংশ নতুন জাতের চাষ করেছি। সেখান থেকে সংগ্রহ করে রাখা বীজ দিয়ে এবার অর্ধেক জমিতে উচ্চফলনশীল ব্রি-৮৯ ও ব্রি-৯৩ উৎপাদন করব। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা অন্য কোনো সমস্যা না হলে সরকারের নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বেশি উৎপাদন হয়- এমন উন্নত জাতের ধান প্রতিস্থাপন সম্ভব হবে।

 

ভোরের আকাশ/আসা

মন্তব্য

Beta version