-->

খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সার আমদানি জোরদার

মো. রেজাউর রহিম
খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সার আমদানি জোরদার

মো. রেজাউর রহিম: বিশ্বব্যাপী চলমান অর্থনৈতিক সংকটময় পরিস্থিতিতে দেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে সরকার। এ জন্য কৃষি উৎপাদনের ধারবাহিকতা বজায় রাখা এবং নির্বিঘ্ন রাখতে প্রয়োজনীয় সার আমদানি ও কৃষকদের কাছে সরবরাহ ঠিক রাখতে সরকারের উচ্চপর্যায়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এ ছাড়া সংকট মোকাবিলায় দেশে সারের প্রয়োজনীয় মজুত গড়ে তোলার পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে।

 

কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়,বিশ্বব্যাপী চলমান সংকটে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারে খাদ্য সংকট। বিশেষ করে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং জালানি সংকটে বিশ^ব্যাপী খাদ্য উৎপাদন কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ অবস্থায় সামনের দিনগুলোতে আমদানি ব্যয় এবং সরবরাহ ঠিক রাখা অনেক দেশের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়ানোর আশঙ্কাও রয়েছে।

 

সার্বিক পরিস্থিতিতে সম্ভাব্য সংকট মোকাবিলায় আগাম প্রস্তুতি হিসেবে দেশে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে সরকার। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্ভাব্য সংকট মোকাবিলায় দেশের পতিত ও অব্যবহৃত জমিতে খাদ্যশস্য উৎপাদনে উদ্যোগ নেয়ার জন্য বারবার বলছেন। দেশে খাদ্যপণ্যের দাম মানুষের নাগালে রাখতে উৎপাদন ও সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার পাশাপাশি আমদানির্ভরতা দূর করতে দেশে সব ধরনের খাদ্যশস্য উৎপাদনে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে।

 

এদিকে, কৃষি উৎপাদন স্বাভবিক রাখতে অত্যন্ত জরুরি উপাদান সারের ওপর জোর দেয়া হয়েছে। যেহেতু দেশে উৎপাদত সার দিয়ে চাহিদা পূরণ হয় না, এ জন্য আগে থেকেই সার আমদানির মাধ্যমে প্রয়োজনীয় মজুত গড়ে তোলার পরিকল্পনাও নিয়েছে সরকার।

 

গত বৃহস্পতিবার সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে ১ হ্জাার ২৯৯ কোটি টাকার ইউরিয়া-এমওপি সার কেনার প্রস্তাবে অনুমোদন দিয়েছে সরকার। প্রস্তাবে এক লাখ ৬০ হাজার টন ইউরিয়া ও এমওপি সার কাতার, বেলগ্রেড ও কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেড (কাফকো) থেকে সার কেনার প্রস্তাবের অনুমোদন দেয়া হয়। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব সাঈদ মাহবুব খান জানান, শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি) রাষ্ট্রীয় চুক্তির মাধ্যমে কাতারের মুনাজাত থেকে দশম লটে ৩০ হাজার টন বাল্ক গ্র্যানুলার ইউরিয়া সার কেনার অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এতে খরচ হবে ২০১ কোটি ৭৪ লাখ ৮৫ হাজার ৯২১ টাকা।

 

এ ছাড়া শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন বিসিআইসির মাধ্যমে কাফকোর কাছ থেকে দশম লটে ৩০ হাজার টন ব্যাগড গ্র্যানুলার ইউরিয়া সার কেনার অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এতে খরচ হবে ১৯১ কোটি ৩ লাখ ১১ হাজার ৮৩৭ টাকা। তিনি বলেন, এ ছাড়া কৃষি মন্ত্রণালয়ের আরেক প্রস্তাবে বেলগ্রেড থেকে এক লাখ টন এমওপি সার কেনার অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এতে মোট খরচ হবে ৯০৬ কোটি ৬৯ লাখ ১৮ হাজার টাকা। এ ব্যাপারে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান ভোরের আকাশকে বলেন, বর্তমানে সারাবিশ্ব কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, আমরাও কঠিন সময় অতিক্রম করছি।

 

তিনি বলেন, দেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেবে। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রয়োজনীয় নির্দেশনার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, দেশের সব এলাকায় থাকা অনাবাদি জমি খুঁজে বের করতে মন্ত্রিপরিষদ সচিবসহ সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।

 

পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, দেশের সব জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) অনাবাদি জমি খুঁজে বের করা এবং আবাদযোগ্য করে তুলে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির কার্যক্রম জোরদারের ব্যবস্থা নেয়ার জন্যও বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। আশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, খাদ্য উৎপাদন নির্বিঘ্ন করতে সারসহ প্রয়োজনীয় উপকরণের সরবরাহ যে কোনো মূল্যে নিশ্চিত করা হবে। সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী ভবিষ্যতে প্রয়োজনীয় সারের মজুত গড়ে তোলার বিষয়টিকেও সরকার প্রাধান্য দিয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

 

সূত্র জানায়, দেশে বছরে ২৬ লাখ টন ইউরিয়া, সাড়ে ৭ লাখ টন টিএসপি (ট্রিপল সুপার ফসফেট), সাড়ে ১৬ লাখ টন ডিএপি (ডাই-অ্যামোনিয়া ফসফেট) এবং সাড়ে ৮ লাখ টন এমওপি সারের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ১০ লাখ টন ইউরিয়া সার দেশে উৎপাদিত হয়। সারের বাকিটা মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরব, কাতারসহ কয়েকটি দেশ থেকে আমদানি হয়। এ ছাড়া দেশে টিএসপি, ডিএপি ও এমওপি সারের চাহিদার বড় অংশ আমদানির মাধ্যমে পূরণ করা হয়।

 

জানা গেছে, বর্তমানে ইউরিয়া সারের মজুত রয়েছে প্রায় ৬ লাখ ৪৫ হাজার টন, টিএসপি ৩ লাখ ৯৪ হাজার টন, ডিএপি ৭ লাখ ৩৬ হাজার টন, এমওপি ২ লাখ ৭৩ হাজার টন। যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায়ও বেশি। গত বছর এই সময়ে ইউরিয়া সারের মজুত ছিল ৬ লাখ ১৭ হাজার টন, টিএসপি ২ লাখ ২৭ হাজার টন, ডিএপি ৫ লাখ ১৭ হাজার টন।

 

এ ছাড়া কৃত্রিমভাবে যাতে কেউ সারের সংকট তৈরি করতে না পারে এবং দাম বেশি নিতে না পারে, সে বিষয়ে সতর্ক রয়েছে সরকার। এ জন্য কৃষি মন্ত্রণালয় ও মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা নিবিড় তদারকি কার্যক্রম হাতে নিয়েছেন। এ ছাড়া কারসাজি বা কেউ সারের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির চেষ্টা করলে তাদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনার কার্যক্রমও অব্যাহত রেখেছে সরকার।

 

জানা গেছে, সম্ভাব্য সংকট মোকাবিলায় বিলাসী প্রকল্প না নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ ছাড়া অপচয় কমানোর জন্য সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ বন্ধ এবং মিতব্যয়ী হওয়ার ওপর জোর দিয়েছে সরকার। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে সরকার খাদ্য মজুতের ওপর জোর দিয়েছে। বিশেষ করে চাল-গম সরকারি উদ্যোগে খাদ্যশস্য আমদানির জোরালো পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে ১১ লাখ টন চাল সরকারি উদ্যোগে আমদানি হচ্ছে। এ ছাড়া বেসরকারি ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে দেশে ১৩ লাখ টন চাল আমদানির অনুমোদন দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি সরকারিভাবে রাশিয়া থেকে ৫ লাখ টন গম আমদানির অনুমোদন দিয়েছে ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি। সেই অনুমতির প্রথম চালান ৫২ হাজার টন গম নিয়ে রাশিয়া থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছায় গত ১৩ অক্টোবর।

 

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, সরকারি খাদ্য গুদামে গত বুধবার (৯ নভেম্বর) পর্যন্ত দেশে গমের মজুত ছিল ২ লাখ ১৩ হাজার ১৬ টন, যা স্বাভাবিকের চেয়ে কম। উল্লেখ্য, গম বাংলাদেশের দ্বিতীয় প্রধান খাদ্যশস্য। দেশে বছরে প্রায় ৭৫ লাখ টন গমের চাহিদা রয়েছে। ১০ লাখ টন গম দেশে উৎপাদিত হয়। চাহিদার অবশিষ্ট গম ভারত, রাশিয়া, ইউক্রেন, কানাডা, আর্জেন্টিনা এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা হয়। আর আমদানির বড় অংশ বেসরকারি খাতে ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে হয়ে থাকে। খাদ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, সরকারিভাবে দেশে মাত্র পাঁচ লাখ টন গম আমদানি হয়। বাকি ৬০ লাখ টন গম বেসরকারি উদ্যোগে আমদানি হয়।

 

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশ মোট গম আমদানির ৬৩ শতাংশ রাশিয়া ও ইউক্রেন, ১৮ শতাংশ কানাডা এবং বাকিটা যুক্তরাষ্ট্র, আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়াসহ আটটি দেশ থেকে আমদানি করে। ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশে আমদানিকৃত মোট গমের ৪৫ শতাংশ রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে, ২৩ শতাংশ কানাডা থেকে, ১৭ শতাংশ ভারত থেকে এবং বাকিটা অন্য কয়েকটি দেশ থেকে এসেছে।

 

এদিকে, সরকারি উদ্যোগে আমদানি করা ৫২ হাজার ৫০০ টন গম নিয়ে লাইবেরিয়ার পতাকাবাহী জাহাজ ‘ম্যাগনাম ফরচুন’ গত বুধবার চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙ্গরে এসে পৌঁছেছে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারীতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর ইউক্রেন থেকে প্রথম কোনো খাদ্যপণ্যের জাহাজ বাংলাদেশে পৌঁছাল। এ ছাড়া রাশিয়া থেকে গমের আরো চালান শিগগির চট্টগ্রামে বন্দরে পৌঁছাবে বলে জানা গেছে।

 

বিষয়টি নিশ্চিত করে চট্টগ্রাম জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক আবদুল কাদের বলেন, গত বুধবার বিকেলে জাহাজটি চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙ্গরে এসে পৌঁছেছে। তিনি বলেন, যাচাই-বাছাই শেষে সবকিছু ঠিক থাকলে গম খালাসের বিশেষায়িত সাইলো জেটিতে ভিড়বে ইউক্রেনের জাহাজ ‘ম্যাগনাম ফরচুন’। তিনি জানান, এর আগে গত ১৩ অক্টোবর রাশিয়া থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে আসে ৫২ হাজার টন গমবাহী জাহাজ ‘সিলাক-২’। এ ছাড়া রাশিয়া থেকে গমের আরো চালান শিগগির চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছাবে বলে জানান তিনি।

উল্লেখ্য, গত ফেব্রুয়ারী মাসে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর দেশ দুটি থেকে বাংলাদেশে গম আমদানি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা ভারত থেকে আমদানি বাড়িয়ে দেন। তবে দেশটি গত মে মাসে গম রপ্তানি বন্ধ ঘোষণা করে। এতে বাংলাদেশের বাজারে গমের দাম বেড়ে যায়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যানুযায়ী, গত অক্টোবরে দেশে খাদ্যে মূল্যস্ফীতির হার ৮ দশমিক ৫০ শতাংশ। আর খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৫৮ শতাংশ। 

 

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version