নিত্যপণ্যের বাজারে তেল ও চিনি সংকটের মধ্যেই দাম বেড়েছে পণ্য দুটির। বোতলজাত প্রতি লিটার সয়াবিন তেলের দাম ১২ টাকা এবং প্যাকেটজাত চিনির দাম কেজিতে বাড়ানো হয়েছে ১৩ টাকা, যা বৃহস্পতিবার থেকে কার্যকর হয়েছে। তবে কার্যকর হওয়া বাড়তি দামেও বাজারে মিলছে না তেল-চিনি। ক্রেতাদের কিনতে হচ্ছে এর চেয়েও বাড়তি দামে।
শুক্রবার রাজধানীর রায়ের বাজার ও আশপাশের এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, খোলাবাজারে নির্ধারিত দাম থেকে ১০ টাকা বেশি এবং পাইকারি বাজারে ৩-৫ টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে তেল-চিনি। রায়েরবাজারের সিদ্দিক স্টোরের এক কর্মী বলেন, খোলা সয়াবিন তেল পাইকারিতে বিক্রি হচ্ছে ১৮৮-১৯০ টাকায় এবং খুচরায় বিক্রি হচ্ছে ১৯৫-২০০ টাকায়। অন্যদিকে বোতলজাত সয়াবিন তেল গায়ে থাকা দামে বিক্রি হচ্ছে। এর মধ্যে ২ লিটার ৩৫৫ টাকা এবং ৫ লিটার ৮৮০ টাকায় আগের দামে বিক্রি হচ্ছে। নতুন দামের তেল এখনও বাজারে আসেনি। হয়তো কাল-পরশু নতুন দামের তেল বাজারে পাওয়া যাবে। তিনি আরও বলেন, আমরা পাইকারিতে খোলা চিনি বিক্রি করছি ১১০ টাকা কেজি দরে। তবে খুচরায় অনেকে ১২০ টাকা কেজি দরেও বিক্রি করছে। বুদ্ধিজীবী রোডের একটি দোকানের দোকানি রাজীব সংবাদমাধ্যমকে বলেন, আমরা খোলা তেল ১৯৫ টাকা লিটার এবং খোলা চিনি ১২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছি। বোতলজাত তেল এবং প্যাকেটজাত চিনি গায়ের দামে বিক্রি করছি।
এদিকে বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন বুধবার সয়াবিন তেলের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে আনুষ্ঠানিকভাবে জানায়। বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশনও ওই দিনই মন্ত্রণালয়কে জানায়, চিনির দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর আগে দাম বাড়ানোর বিষয়ে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেন দুটি সংগঠনের নেতারা। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, গত ১৭ নভেম্বর থেকে বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ১২ টাকা বেড়ে হয়েছে ১৯০ টাকা। আগে এ দাম ছিল ১৭৮ টাকা। এ ছাড়া ৮৮০ টাকায় বিক্রি হওয়া ৫ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ৪৫ টাকা বেড়ে হয়েছে ৯২৫ টাকা। অন্যদিকে খোলা সয়াবিনের দাম লিটারে ১৪ টাকা বেড়ে হয়েছে ১৭২ টাকা, যা আগে ১৫৮ টাকায় বিক্রি হতো। আর প্রতি লিটার খোলা পাম তেল বিক্রি হচ্ছে ১২১ টাকায়। অন্যদিকে প্রতি কেজি প্যাকেটজাত চিনির দাম ১৩ টাকা বেড়ে হয়েছে ১০৮ টাকা। আগে দাম ছিল ৯৫ টাকা। তবে আরও আগেই বাজারে চিনির দাম শতক ছাড়িয়ে গেছে। বাজারে দেখা দিয়েছে চিনির সংকটও। নতুন দাম অনুযায়ী, ৫০ কেজির চিনির বস্তার দাম হয়েছে ৫ হাজার ১০০ টাকা। এক্ষেত্রে প্রতি কেজি চিনির দাম পড়বে ১০২ টাকা। তবে বাজারে নির্ধারিত দামে কোথাও তেল-চিনি বিক্রি করতে দেখা যায়নি। এ ছাড়া বাজার ঘুরে কোনো কোনো দোকানে তেল পাওয়া যায়নি।
গত বৃহস্পতিবার সয়াবিন তেলের দাম লিটারপ্রতি ১২ টাকা বাড়িয়ে ১৯০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। একইসঙ্গে কেজিতে চিনির দাম ১২ টাকা বাড়িয়ে ১০৭ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার থেকেই সয়াবিন ও চিনির নতুন এ দাম কার্যকর হয়। ভোগ্যপণ্য বিপণনকারী শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ^জিৎ সাহা এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় তেলের দাম লিটারে ১২ টাকা ও চিনির দাম কেজিতে ১২ টাকা বাড়িয়েছে। আমাদের মৌখিকভাবে বিষয়টি মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে।
এর আগে দাম কমার মাত্র এক মাসের মাথায় বোতলজাত ও খোলা সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ১৫ টাকা করে বাড়ানোর প্রস্তাব করেছিলেন বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন। গত ২ নভেম্বর তারা প্রস্তাবটি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠান। এর ১৫ দিনের মাথায় আজ দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত এলো। দাম বাড়ানোর প্রস্তাবের চিঠিতে সংগঠনটি বলে, বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে ক্রুড অয়েলের দাম বেড়েছে। এছাড়া ডলারের বিপরীতে অস্বাভাবিক অবমূল্যায়ন হয়েছে টাকার। এ কারণে অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যরা ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এর আগে ১৬ জুলাই সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ১৪ টাকা কমানো হয়। ২৬ জুন তেলের দাম লিটারে ৬ টাকা কমিয়ে ১৯৯ টাকা করা হয়েছিল। তবে সরকার দাম কমানোর ঘোষণা দেয়ার পর দীর্ঘদিন ধরেই আগের দাম লিটারে ২০৫ টাকা দরে কিনতে বাধ্য হয় ক্রেতারা। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমার প্রভাবে দেশেও বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম লিটারে আরো ১৪ টাকা কমানো হয়েছে। এ নিয়ে গত এক মাসে দাম কমেছিল ২০ টাকা।
গত ২৬ জুন তেলের দাম লিটারে ৬ টাকা কমিয়ে ১৯৯ টাকা করা হয়েছিল। তবে সরকার দাম কমানোর ঘোষণা দেয়ার পর দীর্ঘদিন ধরেই আগের দাম লিটারে ২০৫ টাকা দরে কিনতে বাধ্য হয় ক্রেতারা। ব্যবসায়ীদের দাবি, এ তেল তাদের আগের কেনা, নতুন চালানা না আসা পর্যন্ত দাম কমানো যাবে না। অথচ যখন দাম বাড়ার সিদ্ধান্ত হয়, তখন সঙ্গে সঙ্গে তা বাড়িয়ে দেয়া হয়। করোনা পরিস্থিতির উন্নতির পর থেকে ভোজ্যতেলের আন্তর্জাতিক বাজার অস্থির হয়ে ওঠে। এক বছরেরও কম সময়ে দাম দ্বিগুণ হয়ে যাওয়ার প্রভাব পড়ে দেশে দেশে। ২০১৯ সালে অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের গড় মূল্য ছিল টনপ্রতি ৭৬৫ ডলার। ২০২০ সালে দাম ছিল ৮৩৮ ডলার এবং ২০২১ সালে সয়াবিনের টনপ্রতি দাম ছিল ১ হাজার ৩৮৫ ডলার। চলতি বছরের মার্চে বিশ^বাজারে প্রতি টন সয়াবিন তেলের দাম হয় ১ হাজার ৯৫৬ ডলার। সে সময় প্রতি ডলার ৮৬ টাকা হিসাবে লিটারপ্রতি দর দাঁড়ায় ১৫৩ টাকা। এক বছর আগেও বোতলজাত তেলের লিটার ছিল ১৩৪ টাকা করে। গত ৯ জুন বাজেট ঘোষণার দিন সর্বশেষ তেলের দাম বাড়ানো হয়েছিল। সেদিন লিটারে ৭ টাকা বাড়িয়ে বোতলজাত তেলের দাম ঠিক করা হয় লিটারে ২০৫ টাকা। খোলা সয়াবিন তেলের দাম ঠিক করা হয় ১৮৫ টাকা। তেল নিয়ে উৎকণ্ঠার মধ্যে হঠাৎ করেই আন্তর্জাতিক বাজারে দাম নিম্নমুখী হতে থাকে।
বিষয়টি নিয়ে কথা বললে ভোক্তাদের সচেতনতা বৃদ্ধি ও ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান ভোরের আকাশকে বলেন, যদি আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে মিল রেখে বা উৎপাদন কমে যাওয়ার কারণে তেল-চিনির দাম বেড়ে থাকে, তাহলে বিষয়টি মানতে হবে। এভাবে হলে দাম যুক্তভাবে বাড়ানো হয়েছে বলে মনে করি। তবে কোথাও সিন্ডিকেট রয়েছে কিনা, তা-ও খতিয়ে দেখা দরকার। কারণ এতে ভোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ার কারণে এখন তাদের সমস্যা আরো বেশি। তিনি বলেন সরকারের পক্ষ থেকে ১ কোটি পরিবারকে সুবিধা দেয়া হচ্ছে। এতে গরিব মানুষ উপকৃত হচ্ছে। এদের সংখ্যা আরো বাড়ানো উচিত। পাশাপাশি মানুষের আয় যাতে বাড়ে, সে ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে তাদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়েবে। তথ্য মতে সর্বশেষ গত ৩ অক্টোবর দেশের বাজারে সয়াবিন তেলের দাম কমানো হয় লিটারে ১৪ টাকা। চলতি মাসের ১ তারিখ আবার লিটারপ্রতি ১৫ টাকা দাম বাড়াতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেন ভোজ্যতেল পরিশোধন কারখানার মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম মোল্লা।
তিনি চিঠিতে উল্লেখ করেন, আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের মূল্যবৃদ্ধি ও ডলারের বিপরীতে টাকার অস্বাভাবিক দরপতনের ফলে সংগঠনভুক্ত সদস্যরা বোতলজাত প্রতি লিটার সয়াবিন তেলের দাম ১৯৩ টাকা করার প্রস্তাব করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ৪ নভেম্বর আন্তর্জাতিক ও দেশীয় চিনির বাজারমূল্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দেশি প্যাকেটজাত ১ কেজি চিনির দাম ৮৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৯৯ টাকা নির্ধারণ করে দেয় বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন (বিএসএফআইসি)। সংস্থাটির পক্ষ থেকে বলা হয়, কোনো বিক্রেতা এর থেকে বেশি দামে দেশি চিনি বিক্রি করতে পারবেন না।
ভোরের আকাশ/আসা
মন্তব্য