-->
শিরোনাম
আগামী মাসে পাচ্ছে প্রথম কিস্তি

আইএমএফের ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ অনুমোদন

সুদের হার ২ দশমিক ২ শতাংশ

মো. রেজাউর রহিম
আইএমএফের ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ অনুমোদন

মো. রেজাউর রহিম: বিশ্বব্যাপী জ্বালানী ও গ্যাস সংকট এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে চলমান অর্থ সংকটময় পরিস্থিতিতে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে ইতিবাচক ধারা বজায় রাখা, করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে বাস্তবমুখী কর্মসূচি বাস্তবায়নে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে চাওয়া আর্থিক সহায়তা বিষয়ে অগ্রগতি হয়েছে।

 

আগামী ৩০ জানুয়ারি অনুষ্ঠিতব্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) নির্বাহী বোর্ডের সভায় বাংলাদেশের জন্য ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন (৪৫০ কোটি ডলার) ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন হচ্ছে। এ ঋণের ওপর গড় সুদের হার হবে ২ দশমিক ২ শতাংশ। আর এ ঋণের প্রথম কিস্তি বাংলাদেশ আগামী মাসে পাচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে।

 

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা পরিস্থিতিতে সংকটের মুখে থাকা অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এবং বর্তমান সরকারের উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশ বিনির্মাণের আইএমএফের ঋণ গুরুত্বপুর্ণ ভ‚মিকা রাখবে। সহায়তার এই অর্থ জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, সামাজিক নিরাপত্তা, দারিদ্র্য বিমোচন খাতে ব্যয় করা হবে।

 

এ বিষয়ে সংস্থাটির সঙ্গে গত কয়েক মাস ধরে আলোচনা চলছে। ২০৪১ সাল নাগাদ বাংলাদেশকে একটি উন্নত, সমৃদ্ধ ও উচ্চ আয়ের দেশে উত্তরণের স্বপ্ন বাস্তবায়নে আইএমএফ বাংলাদেশকে আর্থিক সহায়তা অব্যাহত রাখবে।

 

এদিকে এক বিবৃতিতে গত সোমবার বাংলাদেশ সফররত আইএমএফের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) অ্যান্তইনেত মনসিও সায়েহ বাংলাদেশের জন্য ঋণদানে ইতিবাচক আশা প্রকাশ করেছেন। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের গৃহীত সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতিগুলো দেশের মুদ্রাস্ফীতি স্থিতিশীল রাখতে, ঋণ থেকে জিডিপি অনুপাত কম রাখতে সাহায্য করেছে।

 

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদারের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পেয়ে আমি আনন্দিত। তিনি বলেন, গত এক দশকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং সামাজিক উন্নয়ন চোখে পড়ার মতো। যা দেশের মানুষের দারিদ্র্য হ্রাসে স্থিতিশীল অগ্রগতি এবং জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে ভ‚মিকা রেখেছে। তবে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও করোনা মহামারি এবং এরপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট অর্থমন্দার ধাক্কা মোকাবিলা করছে।’

 

সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে গণভবনে সাক্ষাৎকালে আইএমএফের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর বলেন, ২০৪১ সাল নাগাদ বাংলাদেশকে একটি উন্নত, সমৃদ্ধ ও উচ্চ আয়ের দেশে উত্তরণে সহায়তা অব্যাহত রাখবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল।

 

অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ভোরের আকাশকে জানান, এর আগে সরকার আইএমএফের কাছে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ চেয়ে চিঠি দেয়ার পর সংস্থাটির একটি প্রতিনিধি দল গত নভেম্বরে বাংলাদেশ সফর করে গেছে। বাংলাদেশকে ঋণ দেয়ার ব্যাপারে আইএমএফ প্রাথমিক সম্মতিও দিয়েছে। আইএমএফের কাছ থেকে বড় অঙ্কের এই ঋণ প্রক্রিয়া চ‚ড়ান্ত করার জন্যই মূলত সংস্থাটির ডিএমডি বাংলাদেশ সফর করছেন বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, অ্যান্তোইনেত মনসিও সায়েহর নেতৃত্বে আসা প্রতিনিধি দলের এবারের সফরকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে নিয়েছে সরকার।

 

তিনি বলেন, আগামী মাসের প্রথম কিস্তিতে ৪৫ কোটি ৪৫ লাখ ডলার পাওয়া যাবে। এরপর প্রতি ছয় মাস পরপর পর্যালোচনা করে কিস্তির অর্থ ছাড় করা হবে।

 

জানা গেছে, আগামী ৩০ বা ৩১ জানুয়ারি সংস্থাটির প্রধান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিতব্য বৈঠকেই বাংলাদেশের ঋণ পাওয়ার বিষয়টি অনুমোদন হবে। আর সেই বোর্ড মিটিংয়ে বাংলাদেশ ঋণ পেতে পারে কিনা কিংবা ঋণ ফেরত প্রদানে কতটা সক্ষম সেসব বিষয়ে চ‚ড়ান্ত সুপারিশ করবেন অ্যান্তোইনেত মনসিও সায়েহ। এ কারণে তার এই সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছে বাংলাদেশ।

 

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সঙ্গে বৈঠকেও আইএমএফ ডিএমডি বাংলাদেশের ঋণ পাওয়ার বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করেছেন। অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে একান্ত এই বৈঠকে সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ছাড়া কেউ অংশগ্রহণের সুযোগ পাননি। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং ডলার সংকটের মধ্যেও বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির সূচকগুলো ভালো থাকায় সন্তোষ প্রকাশ করেছে আইএমএফ। এ কারণে চলতি বছরের মধ্যে বাজেট সহায়তা হিসেবে প্রথম কিস্তির অর্থ পাবে বাংলাদেশ।

 

এ ছাড়া পরবর্তী আরো সাতটি কিস্তিতে আইএমএফ ঋণের পুরো অর্থ পরিশোধ করবে। স¤প্রতি সচিবালয়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জানান, আইএমএফ সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিতে রাজি। এ অর্থ বাংলাদেশ পাবে সাত কিস্তিতে। এ ছাড়া নভেম্বর মাসে এ ঋণ পাওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশে এসেছিলেন সংস্থাটির কর্মকর্তা রাহুল আনন্দ। এ ঋণের অর্থ দিয়ে সামষ্টিক অর্থনীতি স্থিতিশীল রাখা এবং দুর্দশায় পড়া জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দিয়ে দৃঢ়, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং পরিবেশবান্ধব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এগিয়ে নেয়ার প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সামষ্টিক অর্থনীতির ঝুঁকি কমিয়ে আনতেও এ ঋণের অর্থ ব্যয় করা হবে।

 

এর আগে আইএমএফ প্রতিনিধি দলের নভেম্বরের সফরে বেশ কিছু শর্ত নিয়ে আলোচনা হয়। এর মধ্যে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের ভর্তুকি ব্যয় কমিয়ে আনার ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া হয়েছিল। আইএমএফের শর্ত মেনে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বাড়িয়ে মূল্য সমন্বয় করেছে সরকার। এ ছাড়া আর্থিক খাতের সংস্কারের বিষয়টি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সংস্কার, আইন বাস্তবায়ন ও ডিজিটালাইজেশন, ব্যাংক খাতের সংস্কার ও খেলাপি ঋণ এবং সরকারের বিভিন্ন খাতের ভর্তুকি কমাতে সরকার কাজ করছে। এ ছাড়া আইএমএফের দেয়া বেশ কিছু পরামর্শ বাস্তবায়নও শুরু করেছে সরকার।

 

জানা গেছে, আন্তর্জাতিক আর্থিক এই সংস্থাটি বাংলাদেশকে তিনটি পর্যায়ে ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেবে। আইএমএফ এক্সটেন্ডেড ক্রেডিট ফ্যাসিলিটির (ইসিএফ) অধীনে ৮২২ দশমিক ৮২ মিলিয়ন সম্পূর্ণ সুদমুক্ত এসডিএফ প্রদান করবে। আইএমএফ ফ্লোটিং এসডিএফআই অন্তত ১ শতাংশ সুদের হারে এক্সটেনডেড ফান্ড ফ্যাসিলিটির (ইসিএফ) অধীনে বাংলাদেশকে আরো এক হাজার ৬৪৫ দশমিক ৬৪ মিলিয়ন এসডিএফ দেবে। রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি ফ্যাসিলিটির (আরএসএফ) অধীনে ফ্লোটিং এসডিএফআই অন্তত শূন্য দশমিক ৭৫ শতাংশ সুদের হারে ১ বিলিয়ন ডলার এসডিআর দেবে। এই ঋণ সাত কিস্তিতে পাওয়া যাবে।

 

সুদের হার ফ্লোটিং হবে। এসডিআর সুদের হার অনুযায়ী সামগ্রিক ঋণের পরিমাণের ওপর গড় সুদের হার হবে ২ দশমিক ২ শতাংশ। ৩৫২ দশমিক ৩৫ মিলিয়ন এসডিআর বা প্রায় ৪৪৭ দশমিক ৪৮ মিলিয়ন মূল্যের ঋণের প্রথম কিস্তি পাওয়া যাবে ফেব্রুয়ারীতে এবং পরবর্তী ছয়টি সমান কিস্তি হবে ৫১৯ মিলিয়ন এসডিআর বা প্রায় ৬৫৯ দশমিক ১৮ মিলিয়ন ডলার।

 

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ এর আগে ১২ বার আইএমএফের ঋণ পেয়েছে। ১৯৭২ সালে সদস্য হওয়ার পর আইএমএফ থেকে প্রথম ঋণ পায় ১৯৭৪ সালে। ২০১২ সালে নেয়া সর্বশেষ ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৮ কোটি ৭০ লাখ ডলার। সেটাই ছিল আইএমএফের কাছ থেকে নেয়া সর্বোচ্চ ঋণ। আর এবার বাংলাদেশ পাবে প্রায় ৪৫০ কোটি ডলার। এ অর্থের মধ্যে ৩২০ কোটি ডলার পাওয়া যাবে বর্ধিত ঋণ সুবিধার (ইসিএফ-ইএফএফ) আওতায় এবং বাকি ১৩০ কোটি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলায় দেবে সংস্থাটি। এ ঋণ পেলে আগামী অর্থবছরের বাজেটে অর্থ ব্যয়ের জন্য সরকারের হাতে বাড়তি অর্থ থাকবে। পাশাপাশি উন্নত দেশ বিনির্মাণে কাজ আরো সহজ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

 

ভোরের আকাশ/নি

মন্তব্য

Beta version