-->
শিরোনাম

ঘুরে দাঁড়াচ্ছে রিজার্ভ

নিখিল মানখিন
ঘুরে দাঁড়াচ্ছে রিজার্ভ

নিখিল মানখিন: ঘুরে দাঁড়াচ্ছে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। বৈশ্বিক সংকটেও রিজার্ভের চাকা সচল হওয়ার বিষয়টি দেশের অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদরা।

 

তারা বলছেন, যেখানে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও পাকিস্তানসহ বিশ্বের অনেক দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিম্ন গামী, সেখানে বাংলাদেশের রিজার্ভের ঊর্ধ্বগতি নিঃসন্দেহে দেশের জন্য সুখকর। তবে রিজার্ভ রক্ষায় আরো বেশি সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।

 

বিশেষজ্ঞরা বলেন, ঋণ পরিশোধ, বিদেশ থেকে পণ্য, কাঁচামাল আমদানিসহ আন্তর্জাতিক প্রায় সব ধরনের লেনদেনে রিজার্ভে থাকা বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবহার করা হয়। ফলে রিজার্ভের পরিমাণ কমে গেলে আমদানি বাধাগ্রস্ত হয়। এতে অর্থনীতির গতি কমে যায়। এ ছাড়া রিজার্ভ কমে গেলে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধেও বিলম্ব হতে পারে।

 

বৈশ্বিক সংকটে অস্থির হয়ে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে অনেক দেশের অর্থনীতি। রিজার্ভ কমে যাওয়ায় গতি কমে গেছে আন্তর্জাতিক লেনদেনের। বন্ধ হতে চলেছে অনেক দেশের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম। বিশ্ব মন্দার ধাক্কা লাগে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও।

 

এক বছরের মধ্যেই দেশের রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার থেকে ৩২ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। তবে নতুন বছরের শুরুতেই দেশের রিজার্ভের গতিতে হওয়া লেগেছে। পরিমাণে কম হলেও বাড়তে শুরু করেছে দেশের রিজার্ভ।

 

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত ৩১ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৩২ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলার। ১৫ ফেব্রুয়ারি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়ায় ৩২ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলার। বর্তমানে রিজার্ভের পরিমাণ আরো বেড়েছে।

 

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, রপ্তানি ও রেমিট্যান্স ইতিবাচক ধারায় ফিরেছে। এ ছাড়া বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থার কারণে কমছে আমদানিও। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধীরে ধীরে বাড়ছে।

 

সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ হাবিবুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, অর্থনীতির বেশ কিছু সূচকে উন্নতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক যে টার্গেট নির্ধারণ করেছে, তাতে জুনে রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়াবে সাড়ে ৩৬ বিলিয়ন ডলার। আমদানি ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে। রপ্তানি আয় বেড়েই চলেছে। রেমিট্যান্সও বেড়ে গেছে।

 

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক সাংবাদিকদের বলেন, ধীরে ধীরে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ছে। সামনে রোজা ও ঈদ। তিনি মনে করেন, আগামী কয়েক মাসে রেমিট্যান্স প্রবাহ আরো বাড়বে। এতে রিজার্ভ আরও স্বস্তিদায়ক অবস্থানে ফিরবে। তবে রাতারাতি পরিস্থিতির উন্নতি হবে না।

 

এদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পূর্বাভাস অনুযায়ী, আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছর থেকে ধারাবাহিকভাবে বাড়বে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। আর ২০২৬-২৭ অর্থবছর শেষে দেশের রিজার্ভ প্রথমবারের মতো ৫০ বিলিয়ন ডলার বা ৫ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে। বাংলাদেশের অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক নিয়ে তৈরি এক প্রতিবেদনে সংস্থাটি এমন পূর্বাভাস দিয়েছে।

 

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জানুয়ারি পর্যন্ত সাত মাসে ৩ হাজার ২৪৫ কোটি ডলার বা প্রতি মাসে গড়ে ৪৬৪ কোটি ডলারের রপ্তানি আয় হয়েছে, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৯ দশমিক ৮১ শতাংশ বেশি। নভেম্বর, ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে প্রতি মাসে গড়ে ৫২০ কোটি ডলার রপ্তানি হয়েছে।

 

আর চলতি বছরের জানুয়ারিতে রেমিট্যান্স তথা প্রবাসী আয় বেড়ে ১৯৬ কোটি ডলারে ঠেকেছে। আগের মাস ডিসেম্বরে যা ১৭০ কোটি ডলারের নিচে ছিল। আগের তিন মাস নভেম্বর, অক্টোবর ও সেপ্টেম্বরে এসেছিল যথাক্রমে ১৫৯ কোটি ৫২ লাখ, ১৫২ কোটি ৫৫ লাখ এবং ১৫৩ কোটি ৯৬ লাখ ডলার। চলতি বছরের ফেব্রæয়ারি মাসের প্রথম ১০ দিনে ৬৪ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স এসেছে।

 

টাকার অঙ্কে ৬ হাজার ৭৭০ কোটি ৭৪ লাখ ২০ হাজার টাকা (প্রতি ডলার ১০৭ টাকা হিসাবে), যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে বেশি। ফলে ফেব্রুয়ারিতেও বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। আমদানি কমাতে শতভাগ পর্যন্ত এলসি মার্জিন, তদারকি জোরদারসহ বিভিন্ন উদ্যোগের মধ্যে ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসে আমদানি ব্যয় ২ দশমিক ১৫ শতাংশ কমে ৩ হাজার ৮১৩ কোটি ডলারে নেমেছে। সার্বিকভাবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর যে চাপ তৈরি হয়েছিল, তা ধীরে ধীরে কমে আসছে।

 

তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই ও আগস্ট দুই মাসে প্রবাসী আয় এসেছিল যথাক্রমে ২০৯ কোটি ৬৩ লাখ ডলার ও ২০৩ কোটি ৬৯ লাখ ডলার। এর পরই ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসী আয় আসা কমতে থাকে। সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর দুই মাসে প্রবাসী আয় আসে যথাক্রমে ১৫২ কোটি ৯৬ লাখ ডলার ও ১৫২ কোটি ৫৫ লাখ ডলার। এরপর থেকেই প্রবাসী আয় আসা বাড়তে থাকে। সর্বশেষ গত জানুয়ারি মাসে এসেছিল ১৯৫ কোটি ৮৮ লাখ ডলার।

 

অর্থনীতিবিদরা বলছেন,বাংলাদেশ ব্যাংক, আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বিএফআইইউর গৃহীত পদক্ষেপ অব্যাহত থাকলে আগামীতে প্রবাসী আয়ের ইতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকবে। আগামী মাসগুলোতে মালয়েশিয়াসহ অন্যান্য দেশে কর্মী যাওয়ার সংখ্যা বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে। প্রবাসী আয় বৃদ্ধিতে এটাও প্রভাব ফেলবে, বলছে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো।

 

অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ঠিক রাখতে প্রায় প্রতিদিনই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডলার বিক্রি অব্যাহত রয়েছে। রেমিট্যান্সের প্রধান শত্রæ হুন্ডি চক্রকে নিয়ন্ত্রণে তদারকি বাড়ানো হয়েছে। ফলে সার্বিকভাবে ডলারের সরবরাহ পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে।

 

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথমার্ধে অর্থাৎ জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে ১ হাজার ৪৯ কোটি ৩২ লাখ (১০.৪৯ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। যা ২০২১-২২ অর্থ বছরের একই সময়ের চেয়ে ২ দশমিক ৪১ শতাংশ বেশি। গত ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে ১০ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল দেশে।

 

পোশাক কারখানার মালিকরা বলছেন, আগে কারখানায় ইউরোপ-আমেরিকান বায়ারদের পণ্য তৈরি হতো। ইউক্রেন-রাশিয়া সংকট শুরু পর অর্ডার কমে যায়। তবে ২০২২ সালে ভারত-জাপান কিংবা অস্ট্রেলিয়ার মতো অপ্রচলিত বাজারে রফতানি করে ভালো আয় পাচ্ছেন তারা।

 

এদিকে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে সর্বশেষ যে পূর্বাভাস দিয়েছে, সেখানেও ভারত ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ায় ভালো অর্থনীতির দেশের তালিকায় সবার ওপরে রেখেছে বাংলাদেশকে।

 

ভোরের আকাশ/নি

মন্তব্য

Beta version