-->

ঘুরে দাঁড়াল রেমিট্যান্স

নিখিল মানখিন
ঘুরে দাঁড়াল রেমিট্যান্স

নিখিল মানখিন: ঘুরে দাঁড়াল রেমিট্যান্স। টানা ছয় মাসের খরা কাটিয়ে ফের মাসিক দুই বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করল।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পবিত্র রমজান ও ঈদের মাস এপ্রিলেও রেমিট্যান্সের ঊর্ধ্বমুখী অব্যাহত থাকবে। ২০২২ সালের আগস্টের পর টানা ছয় মাস মাসিক রেমিট্যান্সের পরিমাণ দুই বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে গিয়েছিল। রেমিট্যান্স বৃদ্ধিতে বহুমুখী কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে সরকার। রেমিট্যান্সের প্রবাহ যত বেশি বাড়ে, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ তত বেশি কমে আসবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

 

বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, চলতি বছরের মার্চে ২০১ কোটি ৭৬ লাখ ৮০ হাজার মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় (প্রতি এক ডলার ১০৭ টাকা ধরে) যার পরিমাণ ২১ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে এসেছে ২৩ কোটি ৪৬ লাখ ডলার বা ২৫১০ কোটি টাকার বেশি।

 

বিশেষায়িত ব্যাংকের মাধ্যমে ৪ কোটি ৫০ লাখ ডলার বা ৪৮২ কোটি টাকার প্রবাসী আয় এসেছে। বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে ১৭৩ কোটি ১৫ লাখ ডলার বা ১৮ হাজার ৫২৭ কোটি টাকা এবং বিদেশি খাতের ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে এসেছে ৬৫ লাখ ২০ হাজার ডলার। আর প্রতিদিন গড়ে এসেছে ৬ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার বা ৬৯৬ কোটি টাকা।

 

বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই ও আগস্ট) টানা দুই বিলিয়ন ডলার করে রেমিট্যান্স এসেছিল। কিন্তু সেপ্টেম্বর থেকে টানা ছয় মাস দেড় বিলিয়ন ডলারের ঘরেই থেমে যায়।

 

চলতি অর্থবছরের প্রথম মাসে (জুলাই) এসেছিল ২০৯ কোটি ৬৩ লাখ ডলার, আগস্টে এসেছিল ২০৩ কোটি ৬৯ লাখ ডলার, সেপ্টেম্বরে এসেছিল ১৫৩ কোটি ৯৬ লাখ মার্কিন ডলার, অক্টোবরে ১৫২ কোটি ৫৫ লাখ ডলার, নভেম্বরে ১৫৯ কোটি ৪৭ লাখ ডলার, ডিসেম্বরে ১৬৯ কোটি ৯৬ লাখ মার্কিন ডলার, জানুয়ারিতে ১৯৫ কোটি ৮৮ লাখ মার্কিন ডলার, ফেব্রুয়ারিতে ১৫৬ কোটি ১২ লাখ ডলারের রেমিট্যান্স। আর সদ্যবিদায়ী মার্চে এলো ২০১ কোটি ৭৬ লাখ ডলারের বেশি।

 

এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে দেশে মোট ২ হাজার ১০৩ কোটি ১৭ লাখ (২১.০৩ বিলিয়ন) মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল। এটি তার আগের অর্থবছরের চেয়ে ১৫ দশমিক ১১ শতাংশ কম। ২০২০-২১ অর্থবছরে ২ হাজার ৪৭৭ কোটি ৭৭ লাখ (২৪ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন) ডলারের রেমিট্যান্স এসেছিল।

 

বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় প্রতিষ্ঠিত দ্য গ্লোবাল নলেজ পার্টনারশিপ অন মাইগ্রেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (নৌম্যাড) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশিরা ২০১২ সালে মাত্র ১ কোটি ২০ লাখ ডলার রেমিট্যান্স নিজ দেশে নিয়েছিলেন। পরবর্তী এক দশকের মধ্যে এক বছর ছাড়া সংখ্যাটি কেবলই বেড়েছে।

 

এভাবে ২০২০-২১ অর্থবছরে ২৪ কোটি ৭৮ লাখ ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা, যা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অর্থবছর বা বছরে আসা সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স। তার আগে ২০১৯-২০ অর্থবছরে এসেছিল ১৮ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার।

 

২০১৮-১৯ অর্থবছরে আসে ১৬ দশমিক ৪২ বিলিয়ন ডলার। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এসেছিল ১৪ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন ডলার। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স পাঠানোর পরিমাণ ছিল ১ হাজার ২৭৬ কোটি ৯৪ লাখ মার্কিন ডলার। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে আসে ১ হাজার ৪৯৩ কোটি ১১ লাখ মার্কিন ডলার এবং ২০১৪-১৫ অর্থবছরে রেমিট্যান্স এসেছিল ১ হাজার ৫৩১ কোটি ৬৯ লাখ মার্কিন ডলার।

 

বাড়বে রেমিট্যান্স প্রবাহ: বাংলাদেশ ব্যাংক : বৈশ্বিক মন্দার মধ্যেও চলতি অর্থবছরে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়বে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ জন্য তারা পাঁচটি কারণ শনাক্ত করেছে। এগুলো হলো বিদেশে জনশক্তি রপ্তানি বৃদ্ধি, ডলারের বিপরীতে টাকার বড় ধরনের অবমূল্যায়ন, ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্সের বিপরীতে প্রণোদনা প্রদানের পদ্ধতি সহজ করা, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানোর সুযোগ দেয়া ও ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানোর ক্ষেত্রে আরোপিত সব ধরনের ফি বা কমিশন প্রত্যাহার করা।

 

এসব কারণে একদিকে দেশে রেমিট্যান্স পাঠানোর খরচ কমবে, অন্যদিকে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে প্রবাসীরা রেমিট্যান্সের বিপরীতে বেশি পরিমাণে অর্থ পাবে। সম্প্রতি প্রকাশিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

 

প্রতিবেদনে বলা হয়, বৈশ্বিক মন্দার মধ্যে অনেক দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আসে, যা মোট রেমিট্যান্সের ৫২ থেকে ৫৬ শতাংশ। এসব দেশে মন্দার আঘাত তেমন একটা আসেনি। তবে বৈশ্বিক মন্দায় অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের স্থবিরতা কাটিয়ে এখন গতিশীল করা হচ্ছে। এ কারণে এসব দেশে বাংলাদেশের জনশক্তির চাহিদা বেড়েছে।

 

এছাড়া মালয়েশিয়াও বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি নেয়া বাড়াচ্ছে। ফলে গত বছরের অক্টোবর-ডিসেম্বর এই তিন মাসে দেশ থেকে ২ লাখ ৬১ হাজার কর্মী বিদেশে গেছেন। এর আগের প্রান্তিকে অর্থাৎ জুলাই-সেপ্টেম্বরে গেছে ২ লাখ ৫৯ হাজার কর্মী। চলতি অর্থবছরের ছয় মাসে মোট ৫ লাখ ২০ হাজার কর্মী বিদেশে গেছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি গেছে সৌদি আরবে ৩৮ শতাংশ। এর বাইরে ওমানে ১৭ শতাংশ, মালয়েশিয়ায় ১৭ শতাংশ, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ৭ শতাংশ।

 

প্রবাসীরা যাতে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠাতে পারে সেজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট দেশের দূতাবাসগুলোর মাধ্যমে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। হুন্ডি নিরুৎসাহিত করতে দেশে-বিদেশে নেয়া হয়েছে নানা পদক্ষেপ। গত এক বছরের ব্যবধানে ডলারের বিপরীতে টাকার ২৫ শতাংশ অবমূল্যায়ন হয়েছে।

 

ফলে প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠালে ২৫ শতাংশ বেশি অর্থ পাচ্ছেন। এর সঙ্গে আরো যোগ হচ্ছে আড়াই শতাংশ প্রণোদনা। কোনো কোনো ব্যাংক আরো বেশি প্রণোদনা দিচ্ছে। আগে প্রণোদনা পেতে নানা জটিলতা ছিল। এখন এগুলো সহজ করা হয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

 

এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মার্চে বেড়েছে রেমিট্যান্স। বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রয়াস কাজে লেগেছে। তাদের নগদ প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে। এতে বিভিন্ন দেশে কর্মরত বাংলাদেশিরা বৈধ পথে (ব্যাংকিং চ্যানেল) রেমিট্যান্স পাঠাতে উৎসাহ পাচ্ছেন। ঈদ সামনে রেখে এপ্রিলেও ভালো রেমিট্যান্স আসবে বলেও মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

 

সম্প্রতি জনশক্তি রপ্তানিতে এই উল্লম্ফনে সন্তোষ প্রকাশ করে জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) সভাপতি আবুল বাশার সাংবাদিকদের বলেন, ‘এই যে আমরা ২০২২ সালে সাড়ে ১১ লাখ লোককে বিদেশে পাঠালাম, এটি একটি বিশাল বড় ঘটনা। এর ফলে গত কয়েক মাস ধরে রেমিট্যান্স ফের বাড়তে শুরু করেছে।

 

আরো বাড়ত যদি অবৈধ হুন্ডি বন্ধ করা যেত। করোনা মহামারির কারণে সব কিছু বন্ধ থাকায় বিশ্বব্যাপী অবৈধ হুন্ডি কর্মকান্ড বন্ধ ছিল। কিন্তু করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর থেকেই ফের হুন্ডি কর্মকান্ড চালু হয়েছে। ডলারের বাজারের অস্থিরতার কারণে সাম্প্রতিক সময়ে তা আরো বেড়ে গেছে।

 

তিনি বলেন, ‘২০২২ সালে যারা বিভিন্ন দেশে গেছেন, তারা বেশিরভাগ ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছেন। বেতন পাচ্ছেন; দেশে পরিবার-পরিজনের কাছে টাকা পাঠাচ্ছেন। সে হিসাবে রেমিট্যান্সের পরিমাণ অনেক বেড়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু সেটি হচ্ছে না। এটি একটি উদ্বেগের বিষয়।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version