-->
শিরোনাম

সংকটেও সচল অর্থনীতির চাকা

নিখিল মানখিন
সংকটেও সচল অর্থনীতির চাকা

নিখিল মানখিন: বৈশ্বিক সংকটেও দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা আশঙ্কাজনক নয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে যেখানে অনেক উন্নত দেশ হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে দেশের অর্থনীতির চাকা বেশ ঊর্ধ্বমুখী। শঙ্কা কাটিয়ে ওঠার সংগ্রামে সফলতা দেখাচ্ছে বাংলাদেশ। জীবন ও জীবিকার সমন্বয় ঘটিয়ে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সচল রেখে বিশ্ব বাসীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে দেশটি।

 

বিশ্বের অন্যসব দেশের মতো দৈনন্দিন জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে গেলেও স্থবির হয়ে যায়নি দেশের অর্থনীতি। বরং বেড়েছে রেমিট্যান্স, হ্রাস পেয়েছে দরিদ্রতার হার এবং সংকটেও টিকে আছে রিজার্ভ। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিবেদন, অর্থনীতিবিদদের মতামত এবং মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার বাস্তবতা পর্যালোচনা করে দেশের অর্থনীতির এমন চিত্র পাওয়া গেছে।

 

চলতি বছরের শুরুতেই বিশ্ব অর্থনীতির জন্য অশনি এক বার্তা দিয়ে রেখেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। সংস্থাটি বলছে, নতুন বছরেই মন্দার কবলে পড়বে বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ দেশ। যার প্রভাব পড়বে সারাবিশ্বে।

 

আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা মন্দার এ আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন। ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসির এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়। ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা বলেন, নতুন বছর তথা ২০২৩ সালের বিশ্ব অর্থনীতি গত বছরের তুলনায় কঠিন সময় পার করবে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) অর্থনীতির গতি এরই মধ্যে মন্থর হয়ে গেছে।

 

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সুদহার বেড়ে যাওয়া ও চীনে নতুন করে করোনাভাইরাসের বিস্তার বিশ্ব অর্থনীতিকে হুমকির মুখে ফেলেছে। আইএমএফের প্রধান ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা বলেন, চলতি বছর যেসব দেশ মন্দার কবলে পড়বে না, সেসব দেশের মানুষও মন্দার ধাক্কা অনুভব করবে। ইউরোপ কোনোভাবেই মন্দা এড়াতে পারবে না। আর যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি মন্দার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে বলে জানিয়েছেন আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক।

 

বিশ্ব অর্থনীতির জন্য আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের এমন অশনি বার্তার মধ্যেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশের সার্বিক উন্নয়ন বিশ্বে প্রশংসিত। উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে ইতোমধ্যে পরিচিতি পেয়েছে দেশটি। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ উঠে গিয়েছিল ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে। মাথাপিছু আয় ছাড়িয়েছে ২৮০০ মার্কিন ডলার এবং বর্তমানে রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৩০ বিলিয়ন ডলারে। করোনা মহামারি মোকাবিলায় সফলতা দেখিয়ে বিশ্ববাসীকে চমক দিয়েছে দেশটি।

 

বিশ্বের ৩৪তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। করোনা মহামারি সামাল দেয়া শেষ না হতেই ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাব বিশ্বের অন্য সব দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও সজোরে আঘাত করে। ২০২২ সালের মাঝামাঝি সময় থেকেই দেশের অর্থনীতি নিয়ে দেশি ও বিদেশি বিশ্লেষকরা যে ধরনের শঙ্কা প্রকাশ করে আসছেন, দেশের সার্বিক অবস্থা সেদিকে না গিয়ে বেঁচে থাকার এবং উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখার মানদন্ডে বিশ্বে উদাহরণ সৃষ্টি করেছে।

 

সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আজকে সমগ্র বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দা। উন্নত দেশগুলো হিমশিম খাচ্ছে। নিজেদের মন্দার দেশ হিসেবে ঘোষণা করছে। আমরা কিন্তু বাংলাদেশ এখনো সেই পর্যায়ে যাইনি। আমরা আমাদের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সক্ষম হয়েছি।

 

অর্থনীতিবিদ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম সম্প্রতি সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কিছুটা হ্রাস পেলেও এখন আমরা যে অবস্থার মধ্যে আছি, সেটি আশঙ্কাজনক নয়।

 

তিনি বলেন, অতি সাম্প্রতিক মুডিস পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি কিছুটা কমেছে, কিন্তু ২০২৩ সাল নাগাদ ৫ শতাংশ বৃদ্ধি হবে। উন্নত দেশগুলোও চলমান মূল্যস্ফীতি ও অর্থনৈতিক মন্থরতার শিকার, এই প্রেক্ষাপটে আমাদের ৫ শতাংশ গ্রোথ (প্রবৃদ্ধি) খুব খারাপ নয়।

 

ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, মূল্যস্ফীতি আমরা কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি, সেটি নিয়ে আলোচনা হতে পারে। তবে যখন মূল্যস্ফীতি বহির্বিশ্বের কারণে হয়, অভ্যন্তরীণ কোনো নীতি অনুসরণ করে সেটিকে কমানো বেশ কঠিন। সামগ্রিক চাহিদা নিয়ন্ত্রণ করে যদি আমরা মূল্যস্ফীতি কমানোর চেষ্টা করি, তাহলে সেটি প্রবৃদ্ধির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে যোগ করেন ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম ।

 

বৈশ্বিক সংকটেও মধ্যম অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হবে এডিবি : চলতি বছরের গত ৪ মার্চ প্রকাশিত সর্বশেষ এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে যে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে, তাতে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি গন্তব্যে অর্থনৈতিক মন্থরতা দেখা দিতে পারে। তবে ২০২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি ৫ দশমিক ৩ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

 

বাংলাদেশে এডিবির কান্ট্রি ডিরেক্টর এডিমন গিনটিং এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, বাংলাদেশের সরকার তুলনামূলক ভালোভাবেই বাহ্যিক প্রতিক‚লতা মোকাবিলা করছে। তাছাড়া সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে সংস্কার কার্যক্রম শুরু করেছে তারা।

 

রেমিট্যান্স : বেড়েছে রেমিট্যান্স প্রবাহ। চলতি এপ্রিল মাসে ৭ তারিখ পর্যন্ত ব্যাংকিং চ্যানেলে ৪৭ কোটি মার্কিন ডলার সমপরিমাণ অর্থ দেশে এসেছে। এই হিসাবে দৈনিক গড়ে এসেছে ৬ কোটি ৮১ লাখ ডলার। চলমান ধারা অব্যাহত থাকলে চলতি মাসের শেষে রেমিট্যান্স ২ বিলিয়ন ডলার ছাড়াবে।

 

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, মার্চ মাসে বৈধ পথে ২০১ কোটি ৭৭ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। যা আগের মাসের চেয়ে ৪৫ কোটি ৭২ লাখ ডলার বেশি। গত ফেব্রুয়ারিতে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৫৬ কোটি ১২ লাখ ডলার। এছাড়া আগের বছরের (২০২২ সালের) মার্চ তুলনায় রেমিট্যান্স বেড়েছে ৮ দশমিক ৪৯ শতাংশ বা ১৫ কোটি ৮০ লাখ ডলার। গত বছর মার্চে প্রবাসী আয় ছিল ১৮৫ কোটি ৯৭ লাখ ডলার।

 

২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম (জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত) ৯ মাসে মোট রেমিট্যান্স এসেছে ১ হাজার ৬৩০ কোটি মার্কিন ডলার। আগের অর্থবছরের একই সময়ে রেমিট্যান্স এসেছিল এক হাজার ৫২৯ কোটি ডলার। আলোচ্য সময়ে ৭৪ কোটি মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স বেশি এসেছে।

 

বিদায়ী ২০২১-২০২২ অর্থবছরে মোট রেমিট্যান্স এসেছিল ২ হাজার ১০৩ কোটি ১৭ লাখ মার্কিন ডলার। এর আগে ২০২০-২১ অর্থবছরে রেমিট্যান্স আহরণের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৪৭৭ কোটি ৭৭ লাখ মার্কিন ডলার।

 

রপ্তানি আয় বেড়েছে : বৈশ্বিক মন্দার মধ্যেও বাড়ছে রপ্তানি আয়। চলতি অর্থবছরের (২০২২-২০২৩) প্রথম ৯ মাসে রপ্তানি আয় ৪ হাজার কোটি মার্কিন ডলারের অঙ্ক ছাড়িয়েছে। গত বছরের একই সময়ের চেয়ে এ রপ্তানি আয় ৮ শতাংশ বেশি। রপ্তানি টার্গেটের চেয়ে তা কিছুটা কম হলেও অর্থবছর পুরতে আরো আড়াই মাস বাকি। ২০২১-২২ অর্থবছরের নয় মাসে রপ্তানি আয়ের পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৮৬০ কোটি মার্কিন ডলার। সে তুলনায় চলতি অর্থবছরে রপ্তানি আয় বেশি এসেছে।

 

দেশে দারিদ্র্যের হার কমে ১৮.৭ শতাংশ : গত ১২ এপ্রিল বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ( বিবিএস) প্রকাশিত খানা আয় ও ব্যয় জরিপ ২০২২ অনুযায়ী, মোট জনংখ্যার ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ দরিদ্র। এর আগে ২০১৬ সালের জরিপে দারিদ্র্যের হার ছিল ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ। ২০২২ সালের জরিপে গ্রামে দারিদ্র্যের হার ২০ দশমিক ৫ শতাংশ এবং শহরে ১৪ দশিমক ৭ শতাংশ। ২০১৬ সালে যা ছিল যথাক্রমে ২৬ দশমিক ৪ এবং ১৮ দশমিক ৯ শতাংশ।

 

বিশ্বে ৩৪তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ : বাংলাদেশ ইতোমধ্যে রূপকল্প-২০২১ বাস্তবায়ন করে স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তরিত হয়েছে; ২০৩০ সালে এসডিজি বাস্তবায়নের লক্ষ্য পূরণ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাংক, জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক থিংকট্যাংক ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের মানদন্ডে বাংলাদেশের অগ্রগতি বিপুলভাবে স্বীকৃত।

 

২০২২ সালে বাংলাদেশ সারাবিশ্বে ৩৪তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ হিসাবে পরিগণিত হয়েছে। লন্ডনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ইকোনমিক্স অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চের (সিইবিআর) ২০২৩ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০৩৭ সালে বাংলাদেশ ২০তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে।

 

লন্ডনভিত্তিক আন্তর্জাতিক পরামর্শক কোম্পানি প্রাইস ওয়াটার্স কুপার্স (পিডব্লিউসি) ২০১৭ সালে ২০৫০ সালে বিশ্ব অর্থনীতি কী হবে, তা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে যার নাম ‘দ্য ওয়ার্ল্ড ইন ২০৫০’। এতে বলা হয়েছে, ২০৫০ সাল পর্যন্ত ভিয়েতনাম, ভারত ও বাংলাদেশ হবে বিশ্বের দ্রুত তম বর্ধনশীল অর্থনীতি। ২০২৩ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে চলতি মূল্য ২০৩৭ সালে বাংলাদেশের জিডিপির আকার হবে ১৬২৮ বিলিয়ন ডলার (দেড় ট্রিলিয়নের বেশি)।

 

অর্থাৎ বাংলাদেশ ২০২২ সালের ৩৪তম অবস্থান থেকে ১৪ ধাপ এগিয়ে ২০৩৭ সালে ২০তম বৃহত্তম অর্থনীতি হবে। বোস্টন কনসালটেটদ্রু গ্রুপ অর্থনীতি ট্রিলিয়ন ডলারে পরিণত হতে ২০৪০ সাল নাগাদ লাগতে পারে।

 

শেখ হাসিনার সময়োচিত অর্থনৈতিক সংস্কারের প্রশংসায় ব্লুমবার্গ : বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যেও ‘সময়োচিত সংস্কার পদক্ষেপ’ গ্রহণের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রশংসা করে বিশ্বখ্যাত সংবাদ সংস্থা ব্লুমবার্গ বাংলাদেশে আগামী সাধারণ নির্বাচনে তার নেতৃত্বাধীন সরকার চতুর্থ মেয়াদে নির্বাচিত হবে বলে ইঙ্গিত দিয়েছে।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version