নিখিল মানখিন: বৈশ্বিক সংকটেও সন্তোষজনক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেছে দেশ। গত দশ অর্থবছরের মধ্যে সর্বোচ্চ বৈদেশিক আয় হয়েছে সদ্য বিদায় নেয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরে। এ সময়ে মোট ৭ হাজার ৭১৭ কোটি ডলার বা ৭৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেছে। এর মধ্যে দেশে বৈধ পথে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় এসেছে ২ হাজার ১৬১ কোটি ডলার বা সাড়ে ২১ বিলিয়ন ডলার।
আর একই সময়ে রপ্তানি হয়েছে ৫ হাজার ৫৫৬ কোটি ডলার বা সাড়ে ৫৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। অর্থাৎ বিদায়ী অর্থবছরে গড়ে প্রতি মাসে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়েছে প্রায় সাড়ে ৬ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংক এবং রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক এবং রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) জানায়, রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয় (রেমিট্যান্স) থেকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়েছে ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭ হাজার ৬৮৫ কোটি ডলার বা ৭৭ বিলিয়ন ডলার, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৬৪ বিলিয়ন ডলার, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৪৪ বিলিয়ন ডলার, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রায় ৫৭ বিলিয়ন ডলার, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে প্রায় ৫২ বিলিয়ন ডলার, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৪৮ বিলিয়ন ডলার, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৪৯ বিলিয়ন ডলার, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে প্রায় ৪৪ বিলিয়ন ডলার এবং ২০১৩-১৪ অর্থবছরে প্রায় ৪৫ বিলিয়ন ডলার।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈশ্বিক সংকটেও দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা আশঙ্কাজনক নয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে যেখানে অনেক উন্নত দেশ হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে দেশের অর্থনীতির চাকা বেশ ঊর্ধ্বমুখী। শঙ্কা কাটিয়ে ওঠার সংগ্রামে সফলতা দেখাচ্ছে বাংলাদেশ। জীবন ও জীবিকার সমন্বয় ঘটিয়ে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সচল রেখে বিশ্ব বাসীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে দেশটি। বিশ্বের অন্যসব দেশের মতো দৈনন্দিন জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে গেলেও স্থবির হয়ে যায়নি দেশের অর্থনীতি। বরং বিদাীয় বছরের মোট রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয় (রেমিট্যান্স) সন্তোষজনক পর্যায়ে রয়েছে। কারণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান দুটি উৎস হলো রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঝুঁকিপূর্ণ বিশ্ব অর্থনীতির মধ্যেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশের সার্বিক উন্নয়ন বিশ্বে প্রশংসিত। উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে ইতোমধ্যে পরিচিতি পেয়েছে দেশটি। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ উঠে গিয়েছিল ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে। করোনাভাইরাস ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বর্তমানে রিজার্ভ নেমে এসেছে ৩০ বিলিয়ন ডলারে। তবে মাথাপিছু আয় বেড়ে হয়েছে ২৮০০ মার্কিন ডলার। আর করোনা মহামারি মোকাবিলায় সফলতা দেখিয়ে বিশ্ববাসীকে চমকে দিয়েছে দেশটি। বিশ্বের জর্জরিত অর্থনীতির ময়দানে দাঁড়িয়ে গত পাঁচটি অর্থবছর ধরে সন্তোষজনক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশ।
প্রবাসী আয়: বাংলাদেশ ব্যাংক এবং রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) জানায়, দেশে বৈধ পথে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় এসেছে ২ হাজার ১৬১ কোটি ডলার। এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে এসেছিল ২ হাজার ১০৩ কোটি ডলার। সে হিসেবে প্রবাসী আয় বেড়েছে প্রায় ৩ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রবাসী আয়ে ছিল ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ।
এর মধ্যে গত জুন মাসে প্রবাসী আয় এসেছে ২১৯ কোটি ৯০ লাখ ডলার। সাম্প্রতিক সময়ে এত আয় একক কোনো মাসে আসেনি। এর আগে ২০২০ সালের জুলাইয়ে প্রবাসী আয় এসেছিল ২৫৯ কোটি ৮২ লাখ ডলার। তখন করোনার প্রকোপে চলাচল বন্ধের কারণে হুন্ডি বন্ধ ছিল। ফলে বৈধ পথে আয় আসা বেড়েছিল।
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের সাবেক চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, প্রবাসী আয় বাড়ায় ডলারের সরবরাহ বেড়েছে, এটা অর্থনীতির জন্য খুবই ভালো খবর। এই ধারা অব্যাহত থাকলে খুবই ভালো হয়। আগামী দু-তিন মাস এই ধারা অব্যাহত থাকলে বোঝা যাবে ডলারের পরিস্থিতি কী হয়। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি চাহিদা কমিয়ে সরবরাহ বাড়ানোর জন্য। যাতে ডলার পরিস্থিতির উন্নতি হয়।
রপ্তানি আয়: বাংলাদেশ ব্যাংক এবং রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) জানায়, রেমিট্যান্সের পর পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ ইতিবাচকভাবে বছর শেষ করেছে। সদ্য বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছে ৫ হাজার ৫৫৬ কোটি ডলারের পণ্য। এই রপ্তানি এর আগের অর্থবছরের তুলনায় ৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ বেশি। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৩৪.৩৮ শতাংশ।
এক অর্থবছরে ৫ হাজার ৫৫৬ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। যদিও বিদায়ী অর্থবছরের রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫ হাজার ৮০০ কোটি ডলার। সেই লক্ষ্যের চেয়ে রপ্তানি কম হয়েছে ৪.২১ শতাংশ বা ২৪৪ কোটি ডলার।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) প্রকাশিত পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, মে মাসের ধারবাহিকতায় জুন মাসেও রপ্তানিতে ইতিবাচক প্রভাব অব্যাহত রয়েছে। শুধু গত জুনে ৫০৩ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। গত বছরের জুনের তুলনায় এই রপ্তানি ২ দশমিক ৫১ শতাংশ বেশি। জুনে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন ডলার। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম ৯ দশমিক ৬১ শতাংশ অর্জিত হলেও প্রবৃদ্ধি হয়েছে আড়াই শতাংশ।
গত বছরের এ সময়ে ৪ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। মার্চে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি ছিল ২ দশমিক ৪৯ শতাংশ, এপ্রিলে ১৬ দশমিক ৫২ শতাংশ। তবে মে মাস থেকে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি দেখতে শুরু করে। সেই মাসে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ২৬ শতাংশের বেশি। জুন মাসে প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকল।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য