মোতাহার হোসেন: করোনা ও পরবর্তী সময়ে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ঊর্ধ্বমুখী পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণসহ সাধারণ ভোক্তাদের অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে আমদানি পর্যায়ে শুল্কাহার হ্রাসসহ বেশ কিছু পদক্ষেপ নিচ্ছে সরকার। একই সঙ্গে পণ্য আমদানি পর্যায়ে সম্পূরক শুল্ক প্রথা বিলুপ্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে বিশেষ পরিস্থিতিতে আমদানি করা পণ্যের সম্পূরক শুল্কের পরিবর্তে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্কহার আরোপিত করার বিকল্প পদ্ধতির কথা ভাবছে সরকার।
খুব শিগগিরই এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হবে। এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলে দেশের সাধারণ মানুষসহ নিম্ন আয়ের মানুষ উপকৃত হবে। তবে তার আগে এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে বিদ্যমান বিধিবিধান, নীতি সংশোধন, পরিবর্তন-পরিমার্জন করতে হবে। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিচ্ছে ট্যারিফ কমিশন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ভোগ্যপণ্য আমদানি পর্যায়ে ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। এতে পণ্য আমদানি পর্যায়ে উচ্চমূল্য এবং স্থানীয়ভাবে বেশি দাম পড়ে। তখন ভোক্তা পর্যায়ে এর বিরূপ প্রভাব পড়ে। তবে স্থানীয়ভাবে সিন্ডিকেট, বাজার কারসাজি, পণ্যের অবৈধ মজুত গড়ে তোলায়ও অনেক সময় পণ্যমূল্য বেশি হয়ে থাকে। আবার বিদ্যমান কর কাঠামোতে বেশ কিছু ক্ষেত্রে অযৌক্তিক শুল্ক আরোপের সুযোগ রয়েছে, যা দেশের শিল্প বিকাশে বাধার পাশাপাশি আমদানি পণ্যের দাম অনেক বাড়িয়ে দিচ্ছে। তাই ভোক্তাদের সমস্যার বিষয়টি মাথায় নিয়ে সব ধরনের ভোগ্যপণ্য আমদানির শুল্ক ধাপে ধাপে কমিয়ে আনার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সরকার।
সূত্র জানায়, সরকারের উপরোক্ত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে ‘ন্যাশনাল ট্যারিফ পলিসি, ২০২৩’ জারি করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। একই সঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির নেতৃত্বে গঠন করা হয়েছে ১৬ সদস্যের একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি। এ কমিটি গত ১২ আগস্ট থেকে আগামী ছয় মাসের মধ্যে ভোগ্যপণ্যসহ সার্বিক আমদানি-রপ্তানিতে শুল্ক কর যৌক্তিকীকরণের লক্ষ্যে সময়বদ্ধ কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করবে। এ কর্মপরিকল্পনায় ধাপে ধাপে শুল্ক কর কমানো হবে।
সূত্র জানায়, গত কয়েক দশকে বিভিন্ন সময়ে রাজস্ব আহরণ এবং স্থানীয় শিল্পকে সুরক্ষা দেয়ার উদ্দেশ্যে আমদানি পর্যায়ে সম্পূরক শুল্ক (এসডি) ও নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক (আরডি) আরোপের পরিধি বাড়ানো হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে আমদানিতে যেখানে অন্যান্য শুল্কের গড়হার ছিল ১৫ শতাংশ, সেখানে সম্পূরক ও নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক আরোপ করা হয় ৩০ দশমিক ৫৮ শতাংশ।
ফলে বেশ কিছু খাতকে উচ্চ হারে শুল্ক গুনতে হচ্ছে। এতে আন্তর্জাতিক বাজারে স্থানীয় শিল্পের প্রতিযোগিতায় পৌঁছানোর লক্ষ্য ব্যাহত হচ্ছে। বর্তমানে দেশে প্রায় ৮১৪ ধরনের পণ্য আমদানিতে আরডি এবং ৩৪০ পণ্যে এসডি আরোপ রয়েছে।
প্রসঙ্গত জাতিসংঘের ঘোষণা অনুযায়ী, স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা (এলডিসি) থেকে বাংলাদেশের চূড়ান্ত উত্তরণ ঘটবে ২০২৬ সালে। এ উত্তরণের কারণে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যনির্ভর পণ্যের ওপর আরোপিত শুল্কহার নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বাংলাদেশকে ডবিøউটিওর নির্দেশিত ‘বাউন্ডরেট’ ট্যারিফে নামিয়ে আনতে হবে। ডব্লিউটিওর সব সদস্য দেশকে চুক্তি অনুযায়ী এলডিসি থেকে বের হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আগের নির্ধারিত উচ্চ ট্যারিফ বা শুল্কহারও বিধিবদ্ধ নিয়মে কমিয়ে আনার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
তাই এসব শুল্ক যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনতে ন্যাশনাল ট্যারিফ পলিসি জারি করল সরকার। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, সম্পূরক শুল্কের মূল উদ্দেশ্য ছিল বিলাসী পণ্য, অত্যাবশ্যক নয় ও সামাজিকভাবে অনভিপ্রেত পণ্যের ব্যবহার নিরুৎসাহিত করা। প্রথমদিকে দেশীয় ও আমদানিকৃত পণ্যের ওপর সমভাবে এ শুল্ক আরোপের বিধান ছিল। পরে তা সংশোধন করে আমদানি পণ্য ছাড়া দেশীয় ক্ষেত্রে মওকুফ করা হয়, যা অভ্যন্তরীণ কর আইনে অযৌক্তিক।
একইভাবে কাস্টমস আইন ১৯৬৯ অনুযায়ী সরকার প্রয়োজনে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক আরোপের ক্ষমতা পায়। তবে এ শুল্ক ছিল সম্পূর্ণভাবে সাময়িক, যার স্থায়িত্ব এক অর্থবছর পর্যন্ত। তবে অনেক ক্ষেত্রে এ ধরনের শুল্ক অর্থবছরের শুরুতেই ধারাবাহিকভাবে আরোপ হয়ে আসছে। অর্থাৎ প্রতি অর্থবছর বিপুল সংখ্যক পণ্যের ওপর ৩ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক আরোপ করা হয়। ফলে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্কের সাময়িক প্রকৃতি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, রাজস্ব বাড়ানোর অন্যতম উদ্দেশ্যে এসব নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক আরোপ করা হলেও সে লক্ষ্য অর্জন হচ্ছে না। উদাহরণ দিয়ে পলিসিতে বলা হয়, সমপর্যায়ের দেশ ভিয়েতনামের কর-জিডিপির অনুপাত (মোট দেশজ উৎপাদনের তুলনায় রাজস্ব আহরণ) ১৩ দশমিক ৩১ শতাংশ হলেও বাংলাদেশে মাত্র ৮ দশমিক ৪২ শতাংশ। অথচ সমপর্যায়ের দেশগুলোতে মোট রাজস্বের তুলনায় আমদানি পর্যায়ে রাজস্ব বাংলাদেশের তুলনায় অনেক কম। অর্থাৎ সমপর্যায়ের দেশগুলো রাজস্ব আদায়ে আমদানি পর্যায়ে শুল্ক-করের ওপর নির্ভারতা কমিয়েছে।
প্রস্তাবিত সুপারিশে বলা হয়, বর্তমানে বিশেষ বিবেচনায় ব্যবহারকারীভিত্তিক শুল্ক ও কর ছাড় দেয়ার পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। কিন্তু শিল্প খাতে প্রায় ৫০ শতাংশ অবদান রাখা ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তারা এ ধরনের ছাড় পান না। তাই বাজার বৈষম্যের সৃষ্টি হয়। তাছাড়া কর কাঠামোতে দেশীয় শিল্পকে দীর্ঘ সময়ের জন্য সুরক্ষা দেয়া হলে তাদের মধ্যে উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানে পৌঁছানোর উদ্যোগ গ্রহণে অনীহা দেখা দেয়।
এ কারণেই বাংলাদেশে বর্তমানে বহুমুখী পণ্য উৎপাদিত হওয়া সত্তেও রপ্তানিতে খুব বেশি অবদান রাখতে পারছে না। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ শুল্ক ও কর কাঠামো পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে দেশের উৎপাদিত পণ্যকে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানে পৌঁছানো ও রপ্তানি বহুমুখীকরণের মাধ্যমে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
এ ধরনের অযৌক্তি শুল্ক আরোপের কারণে শিল্পায়নের বিস্তৃতিতে বাধার পাশাপাশি আমদানিকৃত ভোগ্যপণ্যের দামও বেড়ে যাচ্ছে। স্থানীয় বাজারে পণ্যমূল্যের অসামঞ্জস্যতা কমাতে আমদানি পর্যায়ে শুল্ক ধাপে ধাপে কমিয়ে আনা এ নীতিমালার অন্যতম উদ্দেশ্য। এ ছাড়া এই নীতিমালার আলোকে সম্পূরক শুল্কের বিলোপের পাশাপাশি নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক শুধু জরুরি পরিস্থিতিতে আরোপের উদ্যোগ নেয়া হবে। একই সঙ্গে আমদানি পর্যায়ে মোট শুল্ক করের অনুপাত কমিয়ে আনবে সরকার। শুল্ক কাঠামো সহজীকরণে অপ্রয়োজনীয় জটিলতা পরিহারের উদ্দেশ্যে সমজাতীয় পণ্যের শুল্ক ও কর যথাসম্ভব সমান রেখে শুল্ক ব্যবস্থায় অধিকতর স্বচ্ছতা আনা হবে।
তবে প্রয়োজন দেখা দিলে কোনো কোনো পণ্যের ওপর মিশ্র শুল্ক বা মৌসুমি শুল্ক আরোপ করা হবে। আমদানির কারণে দেশীয় শিল্পের স্বার্থহানি ঘটলে সংশ্লিষ্ট শিল্পের ক্ষতি লাঘবে অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক, কাউন্টারভেইলিং শুল্ক এবং সেইফগার্ড শুল্ক-সংক্রান্ত বিধিমালার আওতায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। শতভাগ রপ্তানিমুখী শিল্প ও প্রচ্ছন্ন রপ্তানিকারকদের জন্য প্রদত্ত বন্ড সুবিধা ব্যবস্থাকে আরো অধিকতর স্বচ্ছ ও সহজ করা হবে।
এ প্রসঙ্গে বাজার বিশ্লেষক ড. আসাদুজ্জামান বলেন, এটি একটি ভালো ও যুগোপযোগী উদ্যোগ। উন্নয়নশীল দেশের উত্তরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা ও ডব্লিউটিওর নির্দেশিত বিধিবদ্ধ নিয়ম প্রতিপালনে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নির্ধারিত শুল্কহার বাউন্ডরেট ট্যারিফের মধ্যে নামিয়ে আনার কোনো বিকল্প নেই। তবে এ সিদ্ধান্ত কাগজে সীমাবদ্ধ রাখলে লক্ষ্য পূরণ হবে না। প্রতি বছরই বাজেটারি পদক্ষেপের মাধ্যমে এর প্রত্যাশিত হার বাস্তবায়নও জরুরি।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য