জুতা রপ্তানিতে ভাটা পড়েছে। তাই চামড়া খাত নিয়ে দুশ্চিন্তা বাড়ছে। চলতি অর্থবছর ১৩৫ কোটি ডলার মূল্যের চামড়াজাত পণ্য রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার, যা ২০২২-২৩ অর্থবছরে এ খাতের মোট রপ্তানি আয়ের চেয়ে ১৩ কোটি ডলার বেশি। তবে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রথম প্রান্তিকের আয় আশাব্যঞ্জক নয়।
চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর এ তিন মাসে এসেছে ২৬ কোটি ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১৮ দশমিক ৪৪ শতাংশ কম। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১২ দশমিক ১৮ শতাংশ কম। উল্লিখিত তিন মাসে চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩০ কোটি ডলার। গত অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) আয় হয়েছিল ৩২ কোটি ডলার।
ব্র্যান্ড মূল্যে পণ্য বিক্রি করতে না পারা, ইউরোপ থেকে ক্রয়াদেশ কমে যাওয়া এবং ডলার সংকটসহ নানা কারণে দীর্ঘদিন ধরে ভুগছে দেশের চামড়া খাতের রপ্তানি। চলতি (২০২৩-২৪) অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) শিল্পখাতটির প্রধানতম পণ্য জুতার রপ্তানি যে পরিমাণ কমেছে, তা গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। এছাড়া প্রক্রিয়াজাত করা চামড়া রপ্তানিও নিম্নমুখী। তবে এ সময়ে অন্য চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি কিছুটা বেড়েছে।
জানা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে দেশের চামড়াজাত শিল্পের প্রধানতম পণ্য জুতা রপ্তানিতে আয় গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনি¤œ ১৪ কোটি ডলারে (১৪১ দশমিক ৮৩ মিলিয়ন ডলার) নেমে এসেছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৩২ দশমিক ৭৭ শতাংশ কম। আর তিন মাসে লক্ষ্যমাত্রার প্রায় ১৭ কোটি ডলারের চেয়ে ১৫ দশমিক ৯৬ শতাংশ কম। গত অর্থবছরের একই সময়ে ২১ কোটি ডলার মূল্যের জুতা রপ্তানি হয়েছিল।
চলতি অর্থবছর ১৩৫ কোটি ডলার মূল্যের চামড়াজাত পণ্য রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার, যা ২০২২-২৩ অর্থবছরে এ খাতের মোট রপ্তানি আয়ের চেয়ে ১৩ কোটি ডলার বেশি। তবে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রথম প্রান্তিকের আয় আশাব্যঞ্জক নয়।
২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরে করোনাকালীনও ১৪৮ দশমিক ৩৬ মিলিয়ন ডলার মূল্যের জুতা রপ্তানি হয়েছিল। চামড়াজাত জুতা শিল্প ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ে ২১০ দশমিক ৯৬ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছিল। চলতি অর্থবছর ৭০ কোটি ডলারের চামড়াজাত জুতা রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে উদ্যোক্তাদের। জুতার মতো না হলেও প্রক্রিয়াজাত চামড়া রপ্তানিও কিছুটা কমেছে। গত অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকের তুলনায় চলতি প্রান্তিকে যা কমেছে ১ দশমিক ৯৪ শতাংশ।
চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে চামড়া রপ্তানি থেকে এসেছে ৩ কোটি ডলারের বৈদেশিক মুদ্রা। অন্যদিকে তুলনামূলক ভালো অবস্থানে আছে চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি। প্রথম প্রান্তিকে চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১১ দশমিক ৩০ শতাংশ। একই সময়ে আয় হয়েছে প্রায় ১০ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছর চামড়াজাত পণ্য থেকে রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪৬ কোটি ডলার, যা গত অর্থবছরের চেয়ে ১০ কোটি ডলার বেশি।
এদিকে বিশ্লেষক ও উদ্যোক্তারা ইউরোপে ক্রয়াদেশ কমে যাওয়া, এলসি খুলতে না পারা ও কাঁচামালের উচ্চমূল্যকেই চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য জুতার রপ্তানি কমার কারণ হিসেবে উল্লেখ করছেন।
এ বিষয়ে এপেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেডের চিফ ফিন্যান্সিয়াল অফিসার দিলীপ কাজুরির বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে ইউরোপের দেশগুলোর অর্থনৈতিক পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। এতে রপ্তানি আদেশ অনেকটাই নিম্নমুখী। পরিস্থিতির উন্নতি না হলে আমাদের কারখানাগুলো কীভাবে চলবে সেটা নিয়ে শঙ্কা উঁকি দিচ্ছে।
রপ্তানিকারকরা বলছেন, চলমান অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে ইউরো জোন থেকে রপ্তানি আদেশ কমায় এ শিল্পের রপ্তানি আয়ও কমেছে। এছাড়া ব্যাংকের অসহযোগিতার কারণেও ক্রেতাদের সঙ্গে লেনদেনে সমস্যা হচ্ছে। অন্য চ্যানেলে অর্থ আদান-প্রদান করতে হচ্ছে। পাশাপাশি বড় অংকের উৎসে কর মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
উদ্যোক্তাদের অভিযোগ, দেশে উচ্চমূল্যস্ফীতির কারণে কাঁচামালের দাম বেড়েছে। শ্রমিককেও মজুরি বেশি দিতে হচ্ছে। কিন্তু বিদেশি ক্রেতারা সে অনুপাতে পণ্যের দাম বাড়াচ্ছে না। এটিও রপ্তানি আয়ে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। অন্যদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে ইউরোপের অঞ্চলগুলোতে অর্থনীতি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। এ অবস্থায় ইউরোপের বাজার থেকে ক্রমাগত রপ্তানি আদেশ হ্রাস পাচ্ছে।
চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর এ তিন মাসে এসেছে ২৬ কোটি ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১৮ দশমিক ৪৪ শতাংশ কম। আর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১২ দশমিক ১৮ শতাংশ কম। উল্লিখিত তিন মাসে চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩০ কোটি ডলার।
গত বছরের একই সময়ের তুলনায় আগস্টে ৩৭ শতাংশ এবং সেপ্টেম্বরে এপেক্সের রপ্তানি ৫৮ শতাংশ কমেছে বলেও জানান তিনি। চলতি (অক্টোবর) মাসে রপ্তানির এ ক্রমহ্রাসমান ধারা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা নিয়ে চিন্তায় প্রতিষ্ঠানটি।
শাবাব লেদারের স্বত্বাধিকারী মাকসুদা খাতুন বলেন, চলতি বছরের শুরু থেকেই রপ্তানি কমছে। শেষ তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) বড় কোনো অর্ডার (ক্রয়াদেশ) পাইনি। আমরা এলসি নিতে পারছি না। ব্যাংকগুলো ওয়ার্ক অর্ডার/পারচেজ অর্ডার দিতে পারছে না। স¤প্রতি কয়েকটি ব্যাংক ঘুরেও বড় একটা অর্ডারের এলসি করতে পারিনি। কিছু ব্যাংক যদিও এলসি নিতে পারে, তারা পারচেজের অনুমতি দিচ্ছে না।
তিনি বলেন, অর্ডার পেয়ে ব্যাংকিং জটিলতায় ভুগছি। আবার ইউরোপের অনেক দেশ থেকে অর্ডার আসা কমে গেছে। কারণ সেসব দেশে উচ্চমূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। অন্যদিকে দ্রব্যমূল্য যে হারে বাড়ছে তাতে রপ্তানি পণ্যের রিপ্রাইজিং বা দাম সমন্বয় করা না হলে আমাদের টিকে থাকাই মুশকিল হবে। রিপ্রাইজিং না করলে আমাদের পুরোপুরি লোকসানে পড়তে হবে।
দেশীয় উদ্যোক্তাদের অভিযোগ, সরকার চামড়া শিল্পের অন্যতম রপ্তানি পণ্য জুতা রপ্তানিতে ৭৭ শতাংশ প্রাক-মুনাফা উৎস কর আরোপ হয়েছে, যা রপ্তানিকারকদের জন্য বাড়তি বোঝা। রপ্তানি আদেশ কমে যাওয়ায় বড় বড় কোম্পানি সমস্যায় পড়ছে। বিপরীতে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশে উৎপাদিত নন-লেদার ফুটওয়্যার বা চামড়াবিহীন জুতার চাহিদাও ধীরে ধীরে বাড়ছে। আরোপিত উৎস কর দিতে কোম্পানিগুলোর আপত্তি নেই। কিন্তু তারা মনে করে, রপ্তানিতে এই ভাটার সময়ে চামড়া শিল্পের প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবসা কীভাবে টিকিয়ে রাখবে সে বিষয়টি সরকারের চিন্তায় থাকা উচিত।
২০২১ সালে নন-লেদার ফুটওয়্যার পণ্য রপ্তানি শুরু করে আরএফএল। বর্তমানে বিশ্বের ৩৭টি দেশে আরএফএল ফুটওয়্যারের পণ্য রপ্তানি হচ্ছে। এরমধ্যে ইউরোপের দেশের সংখ্যাই বেশি। আরএফএলের রপ্তানি ইউনিটে মাসিক উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় চার লাখ জোড়া ফুটওয়্যার। সক্ষমতার ৮৫ শতাংশ বর্তমানে ব্যবহার হচ্ছে। রপ্তানি ইউনিটে উৎপাদন লাইন আছে ছয়টি।
রপ্তানির ক্ষেত্রে আরএফএল ফুটওয়্যার বর্তমানে স্নিকার, লেডিজ সুজ, লেডিস স্যান্ডেল ও বিভিন্ন ধরনের কিডস আইটেম উৎপাদন করে। বিশ্ববাজারের চাহিদা বিবেচনায় শিগগির হাই-এন্ড বা বেশি মূল্যের নন-লেদার ফুটওয়্যার উৎপাদনে যাবে প্রতিষ্ঠানটি। এর মাধ্যমে অধিক পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনও সম্ভব হবে। আরএফএল ফুটওয়্যারের পণ্যসমূহ বর্তমানে নরসিংদীর ডাঙ্গা ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের কারখানায় উৎপাদন হচ্ছে। যেখানে প্রায় আড়াই হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।
এ বিষয়ে দেশের বৃহৎ শিল্প পরিবার প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক (বিপণন) কামরুজ্জামান কামাল বলেন, নন-লেদার ফুটওয়্যারের কাঁচামাল দেশে উৎপাদন করা সম্ভব হলে এ খাতেও ভালো সম্ভাবনা আছে। আরএফএলের নন-লেদার ফুটওয়্যারে যেসব কাঁচামাল ব্যবহার করা হয় তার বেশিরভাগই চীন থেকে আমদানি করা। তবে ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ নিয়ে আরএফএল এখন ব্যাপকভাবে কাজ করছে, যেন নিজেরাই কাঁচামাল উৎপাদন করতে পারে। শিগগির নন-লেদার ফুটওয়্যারে ব্যবহৃত সোল নিজেরা উৎপাদনের প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে।
চলমান অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে ইউরো জোন থেকে রপ্তানি আদেশ কমায় এ শিল্পের রপ্তানি আয়ও কমেছে। এছাড়া ব্যাংকের অসহযোগিতার কারণেও ক্রেতাদের সঙ্গে লেনদেনে সমস্যা হচ্ছে। অন্য চ্যানেলে অর্থ আদান-প্রদান করতে হচ্ছে। পাশাপাশি বড় অংকের উৎসে কর মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তিনি আরো বলেন, নন-লেদার ফুটওয়্যারের জন্য বর্তমানে যেসব কাঁচামাল আমদানি করা হচ্ছে, এগুলো দেশে উৎপাদন করা গেলে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে লিড টাইম (ক্রয়াদেশ পাওয়া থেকে ক্রেতার কাছে পণ্য পৌঁছানো পর্যন্ত সময়) অনেক কমে আসবে। সরকার যদি ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ প্রতিষ্ঠায় পোশাক শিল্পের মতো সুবিধা দেয়, তবে এ খাতেও দেশীয় বিনিয়োগকারীরা এগিয়ে আসবে। তখন অ্যাকসেসরিজসহ নন-লেদার ফুটওয়্যারের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজও গড়ে উঠবে।
দেশে প্রয়োজনীয় ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ গড়ে উঠলে বিদেশি ক্রেতারা বাংলাদেশ থেকে আরও বেশি করে পণ্য কিনতে উৎসাহিত হবেন। কারণ, লিড টাইম তখন অনেক কমে যাবে। তাছাড়া যে কোনো সময় ক্রেতারা ক্রয়াদেশের পরিমাণ বাড়ালেও সেটা গ্রহণ করা সম্ভব হবে।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য