মোতাহার হোসেন: পর্যটন নগরী কক্সবাজারের সঙ্গে ঢাকার রেল যোগাযোগ স্থাপন এবং পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানী ঢাকার যোগাযোগ হয়েছে সহজ। পাশাপাশি সারা দেশের সঙ্গে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের যোগাযোগ আরও সহজ করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। একই সঙ্গে চট্টগ্রাম থেকে সড়ক পটথে কক্সবাজারের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে ওই সড়ককে চার লেনে উন্নীত করার কাজ চলমান রয়েছে। শিগগিরই চট্টগ্রাম কক্সবাজার সড়ক চার লেনে উন্নীত হলে রেল পথের মতো সড়ক পথেও যোগাযোগ ব্যবস্থার আমুল পরিবর্তন হবে। তাছাড়া কর্নফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু টানেল ব্যবহার করে কক্সবাজার যাওয়া যাবে এক ঘণ্টা কম সময়ে।
অর্থনীতি বিদদের মতে, সারা দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম এবং পর্যটন নগরী কক্সবাজারের সড়ক ও রেল যোগাযোগ স্থাপন হওয়ায় দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।
রেল মন্ত্রণালয়ের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, ঢাকার সঙ্গে পর্যটন নগরী কক্সবাজারের সরাসরি রেল যোগাযোগ স্থাপন হওয়ায় পর্যটন নগরীর পর্যটন কেন্দ্রিক ব্যবসা বাণিজ্যি সম্প্রসারণ হবে। একই সঙ্গে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আগত ভ্রমণকারীরা সহজে স্বাচ্ছন্দে কক্সবাজার ভ্রমণ করতে পারবে।
সড়ক ও সেতু বিভাগের একাধিক সূত্র জানায়, শীতলক্ষ্যা নদীর ওপর নির্মিত তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতু যুক্ত করেছে ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট এবং ঢাকা -মাওয়া- খুলনা মহাসড়কের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ। এর সঙ্গে ধলেশ্বরী নদীর ওপর নারায়ণগঞ্জের পঞ্চবটি থেকে মুন্সীগঞ্জের মুক্তারপুর সেতু পর্যন্ত ১০ দশমিক ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ আধুনিক সড়ক নির্মাণ হচ্ছে। এটি হয়ে গেলে দক্ষিণাঞ্চলের যানবাহন ঢাকায় প্রবেশ না করে তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতু হয়ে পদ্মা সেতু দিয়ে দক্ষিণপশ্চিমাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চলে যাতায়াত করতে পারবে সহজেই। এতে সময় এবং দূরত্ব দুইই কমবে।
নারায়ণগঞ্জের সদর ও বন্দর উপজেলাকে সংযুক্ত করা তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতু উদ্বোধন করা হয়েছে গত ১০ অক্টোবর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বীর মুক্তিযোদ্ধা এ কে এম নাসিম ওসমানের নামে নামকরণ করা সেতুটির উদ্বোধন করেন। সেতুটি নারায়ণগঞ্জের পাশাপাশি দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য সম্ভাবনার নতুন দ্বার উন্মোচন করেছে।
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যানবাহন ও যাত্রীরা যাত্রাবাড়ী-পোস্তগোলা ব্রিজ হয়ে অথবা চাষাঢ়া-সাইনবোর্ড রুটে চট্টগ্রামে যান। এখন শীতলক্ষ্যা সেতু দিয়ে যানবাহনগুলো ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ শহরকে বাইপাস করে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে। এতে রাজধানী ও নারায়ণগঞ্জ শহরের ওপর চাপ কমাবে এবং তীব্র যানজটের ভোগান্তি থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।
এর সঙ্গে ফরিদপুরের ভাঙ্গা ও সিরাজগঞ্জের পর এবার ইন্টারসেকশন সম্বলিত দৃষ্টি নন্দন সড়ক নির্মাণ হচ্ছে নারায়ণগঞ্জের পঞ্চবটিতে। পঞ্চবটি মোড় থেকে ছয় লেন সড়ক ৩১০ মিটার করে ফতুল্লা- ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ দুই দিকে প্রসারিত হবে। বর্তমানে সরু এই সড়ক মুন্সীগঞ্জ জেলা শহরের সঙ্গে রাজধানী ঢাকার যোগাযোগের প্রধান পথ। আঁকাবাঁকা সড়কে প্রায়ই ঘটে দুর্ঘটনা।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, পঞ্চবটি-মুক্তারপুর সড়ক প্রশস্তকরণ ও দোতলা রাস্তা নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় নারায়ণগঞ্জের পঞ্চবটি চৌরাস্তা থেকে ছয় লেনের ৩১০ মিটার দৈর্ঘ্যরে একটি সড়ক ফতুল্লা-ঢাকার দিকে ও নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়ার দিকে একই দৈর্ঘ্যরে আরেকটি সড়ক নির্মিত হবে। পাশাপাশি পঞ্চবটি থেকে চরসৈয়দপুর এলাকায় তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতু পর্যন্ত ১০ দশমিক ৩৭ কিলোমিটার পথে ৯ দশমিক ০৯ কিলোমিটার দোতলা সড়ক ও পঞ্চবটি থেকে কাশিপুর পর্যন্ত ৩ দশমিক ৫ কিলোমিটার বর্তমান দুই লেনের গড়কটি চার লেনে উন্নীত হবে। আবার তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতু থেকে মুক্তারপুর সেতু পর্যন্ত ৩ দশমিক ৭৫ কিলোমিটারের বর্তমান দুই লেনের সড়কটি চার লেনে উন্নীত হবে।
এছাড়া প্রকল্প এলাকায় ১৭ দশমিক ৬১ কিলোমিটার ড্রেন ও ৪টি টোলপ্লাজা নির্মাণ করা হবে। এটি হবে ফরিদপুরের ভাঙ্গা এবং সিরাজগঞ্জের পর তৃতীয় ইন্টারসেকশন সংবলিত দৃষ্টিনন্দন সড়ক। এছাড়া, চর সৈয়দপুরে তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতু পয়েন্টে একটি গোলচত্বর থাকবে। প্রকল্প পরিচালক জানান, পঞ্চবটি-মুক্তারপুর সড়কে ২ দশমিক ৮০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে ৬টি র্যাম্পসহ দুই লেন বিশিষ্ট ৯ দশমিক ৬ কিলোমিটার হচ্ছে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে।
প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে মুন্সীগঞ্জবাসী সহজে দ্রুত তম সময়ে যানজট মুক্ত পঞ্চবটি নারায়ণগঞ্জ হয়ে ঢাকায় যাতায়াত করতে পারবে। চর সৈয়দপুরে তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতু পয়েন্টের গোলচত্বর থেকে মুক্তারপুর সেতু পর্যন্ত সড়কটি চার লেনে উন্নীত হলে দক্ষিণাঞ্চলের যানবাহন ঢাকায় প্রবেশ না করে সেতু হয়ে পদ্মা সেতু দিয়ে উত্তরাঞ্চলে চলাচল করতে পারবে। প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে ড্রেন নির্মাণ, ৬টি ওজন স্টেশন, চারটি টোল প্লাজা এবং ফুট ওভার ব্রিজ নির্মাণ। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সূত্র মতে প্রস্তাবিত প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে এ সড়কে যাতায়াতে সময় বাচবে প্রায় ৬২ দশমিক ৮৯ শতাংশ এবং যানবাহনের গতি বাড়বে প্রায় ৫ গুণ।
সূত্র জানায়, ২০০৮ সালে ধলেশ্বরী নদীর ওপর নির্মিত ষষ্ঠ বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু উদ্বোধনের পর থেকে এর সংযোগ রাস্তা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে পঞ্চবটি-মুক্তারপুর সড়ক। এটি খুব সংকীর্ণ (গড় প্রশস্ততা ৫ দশমিক ৫ মিটার) ও আঁকাবাঁকা। রাস্তার দুই পাশেই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বসতবাড়ি থাকায় প্রায়ই দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। মুন্সীগঞ্জের মুক্তারপুরে পাঁচটি সিমেন্ট কারখানা এবং কয়েকটি হিমাগার আছে। ফলে, ওই সড়কে ২৪ টন থেকে ৫০ টনের ভারী যানবাহন নিয়মিত চলাচল করায় প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে।
প্রকল্প এলাকায় বিসিক শিল্পাঞ্চল এবং রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানা থাকায় প্রতিদিন কয়েক লাখ শ্রমিক এ রাস্তা ব্যবহার করেন। এ অবস্থা বিবেচনা করে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ ‘পঞ্চবটি থেকে মুক্তারপুর সেতু পর্যন্ত সড়ক প্রশস্তকরণ ও দোতলা রাস্তা নির্মাণ’ প্রকল্প গ্রহণ করে। ২০২০ সালের ৮ ডিসেম্বর একনেক সভায় এ প্রকল্প অনুমোদিত হয়।
প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ২ হাজার ২৪২ কোটি ৭৭ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। প্রকল্পটি জিওবি এবং বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়িত হবে। এর মেয়াদকাল ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। গত ১৪ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সারা দেশের ১৫৭টি উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ১০ হাজার ৪১টি অবকাঠামোর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন ও উদ্বোধন করেছেন। এর মধ্যে পঞ্চবটি-মুক্তারপুর সড়ক প্রশস্তকরণ ও দোতলা রাস্তা নির্মাণ কাজের ভিত্তিপ্রস্তরও রয়েছে। সেদিন সকালে সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে এ প্রকল্পগুলো উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী।
সূত্র জানায়, নারায়ণগঞ্জের পঞ্চবটি থেকে চর সৈয়দপুরে নির্মানাধীন শীতলক্ষ্যা সেতু পর্যন্ত হবে ফ্লাইওভারটি। এটি ব্যবহারে সবচেয়ে বেশি সুবিধা ভোগ করবে মুন্সীগঞ্জবাসী। এরপর আবার চর সৈয়দপুর থেকে মুক্তারপুর সেতু পর্যন্ত হবে চার লেন সড়ক। সফল রাষ্ট্রনায়ক বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা নারায়ণগঞ্জের পঞ্চবটি থেকে মুন্সীগঞ্জের মুক্তারপুর ব্রিজ পর্যন্ত সড়ক প্রশস্তকরণ ও দোতলা সড়কের নির্মাণ কাজের শুভ উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে মুন্সীগঞ্জবাসীর জন্য সম্ভাবনার এক নব দুয়ার উন্মোচন করেছেন।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য