বাংলাদেশের অর্থনীতিতে আলোচিত দুই সমস্যা রিজার্ভের অপ্রতুলতা ও উচ্চ মূল্যস্ফীতি বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক নীতি গ্রহণে বিলম্ব ও আন্তরিকতার অভাবের ফল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন অনেক আগেই ডলারের বিনিময় হার বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করা দরকার ছিল। কিন্তু সেটির ক্ষেত্রে সময়ক্ষেপণ করা হয়েছে। এ কারণে দেশে অবৈধ হুন্ডির বড় বাজার তৈরি হয়ে গেছে। অন্যদিকে ঋণের সুদহার বেঁধে রাখার কারনে মূল্যস্ফীতি বেড়েই চলেছে। সুদহার বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়ার ক্ষেত্রেও অনেক দেরি হয়ে গেছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর সারা বিশ্বে যখন মূল্যস্ফীতি বাড়ছিল, তখন প্রায় সব কেন্দ্রীয় ব্যাংকই সুদহার বৃদ্ধির মাধ্যমে তা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালায়। এতে করে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশই সফল হয়। তবে বাংলাদেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি দেখা গেলেও বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। বরং ঋণের সুদহারে ঊর্ধ্বসীমা ৯ শতাংশ বহাল রাখে। যদিও দেশের অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক তা আমলে নেয়নি। প্রায় সব দেশ যখন উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সফলতা পেতে শুরু করে, তখনো বাংলাদেশ ব্যাংক বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ রক্ষায় আমদানি সীমিত করে আনে। এতে করে উচ্চ মূল্যস্ফীতি দীর্ঘসময় ধরে বহাল রয়েছে। অবশ্য পরে ২০২৩ সালের জুলাই থেকে সুদহার বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে শুরু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যদিও সেটি অনেক বিলম্বিত পদক্ষেপ বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এরপর থেকে দেশের গড় মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য সুদহার বাড়িয়েই চলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু বেলাশেষে কোনো কাজেই আসছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ। সঠিক সময়ে সুদহার বৃদ্ধি করতে না পারায় এখন তার কোনো সুফল মিলছে না।
জানুয়ারিতে চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতি ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তখন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার জানিয়েছিলেন, মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের মধ্যে ধরে রাখার লক্ষ্য নিয়েই ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জানুয়ারি-জুন দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতি তৈরি করা হয়েছে। নতুন এই মুদ্রানীতির মাধ্যমে জুন মাসের মধ্যে মূল্যস্ফীতির হার ৭ দশমিক ৫ শতাংশে এবং বছর শেষে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে আশা করেছিলেন তিনি।
এর আগে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথমার্ধের মুদ্রানীতিতে জুনের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। শিষজ্ঞরা বলছেন যে সময় সারা দুনিয়ায় মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে যেসব ব্যবস্থা নিয়েছে, বাংলাদেশে সে সময় তা তো নেয়ইনি, বরং উল্টোপথে হেঁটেছে। সে কারণেই এখন অনেক কষ্ট হচ্ছে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ।
অর্থনীতি বিশেষজ্ঞরা বলেন,মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাজ শুধু সুদহার বাড়ানো নয়, নিত্যপণ্যের বাজারে অব্যাহত নজরদারি রাখাও তাদের দায়িত্ব ছিলো। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক তা না করে, শুধু সুদহার বাড়ানোর প্রজ্ঞাপন দিয়েই তাদের কাজ শেষ করছে।
তারা বলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের যুগান্তকারী উদাহরণ তৈরি করেছিল শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাদের মূল্যস্ফীতি যখন ৮০ শতাংশের কাছাকাছি ছিল, তখন সুদহার বাড়িয়েই বসে থাকেননি দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর। খুচরা বাজার থেকে শুরু করে পাইকারি বাজারের প্রত্যেকটি পণ্যে নজরদারি রেখেছে তারা। প্রতিদিনের পণ্যমূল্য শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওয়েবসাইটে এখনও পাওয়া যায়। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংক সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে পুরনো নীতিতেই চলছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন এখনও সময় আছে ঘুরে দাড়াবার সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংককে উৎসর্গিত হয়ে কাজ করতে হবে। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির এক্সিকিউটিভ কমিটির সদস্য প্রফেসর শাহানারা বেগম বলেন, উন্নয়নের সাথে মূল্যস্ফিতি বা ক্রয় ক্ষমতা হ্রাস পাওয়া কোন অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। যে কোন উন্নয়নে ব্যয় বাড়বে। আর উন্নয়ন ব্যয় বাড়লে অন্যান্য ক্ষেত্রে ব্যয় সংকুচিত হবে এটা কার না জানা। কিন্তু সেটাকে সময়ের ব্যবধানে সারিয়ে তুলতে না পারাটা ব্যর্থতা। কি কৌশলে অর্থনীতিকে সুরক্ষিত করতে হবে এটা বাংলাদেশ ব্যাংককে জানা দরকার ছিলো।
তিনি বলেন, ঋন বিতরনের পাশাপাশি তদারকি থাকা দরকার ছিলো। যা এখনও করা দরকার। তিনি বলেন রাজনৈতিক প্রভাবে একটি বলয় তৈরী হয়েছে, এরাই খেলাপি এরাই সুবিধাভোগী কিন্তু দেশের সকল অংশে সকল মহলে সুষম বন্টন করতে না পারা বর্তমান বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের অর্থনীতিকে একটি রাজনৈতিক অর্থনীতিতে পরিনত করেছে। এখন যদি দ্রুত থেকে দ্রুততম পন্থায় ঋন বিতরন করে সঠিক তদারকির মাধ্যমে তা আদায় করা যায়,তবে এ অবস্থা থেকে উত্তরণ হওয়া সম্ভব হবে। সেক্ষেত্রে ঋন বিতরনকারী ব্যাংকগুলো পরোক্ষভাবে ঋণ গ্রহিতার কার্যক্রম সার্বক্ষনিক তদারকি করতে হবে।
ভোরের আকাশ/ সু
মন্তব্য