দীর্ঘসময়ের সংঘবদ্ধ দুর্নীতির কারণে নাজেহাল দেশের ব্যাংকিং খাত। কয়েকটি ব্যাংক থেকে জনগণের জমানো আমানতের পুরোটাই লুটপাট করা হয়েছে। ওই ব্যাংকগুলো চরম অর্থসংকটে পড়েছে। মাত্র পাঁচ হাজার টাকাও দিতে পারছে না কোনো কোনো ব্যাংক। অর্থাৎ তারল্য সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। এরমধ্যে চতুর্থ প্রজন্মের ৯টি ব্যাংকের ৬টিতেই উদ্বৃত্ত তারল্য রয়েছে। অতিরিক্ত তারল্য থাকা ব্যাংকগুলো হলোÑ এনআরবিসি, মিডল্যান্ড, মেঘনা, মধুমতি, সাউথ বাংলা ও এনআরবি ব্যাংক। অন্যদিকে সমস্যায় আছে তিনটি ব্যাংক। এগুলো হলো- গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও পদ্মা ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক এবং সংশ্লিষ্ট ব্যাংক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
ব্যাংকারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ব্যাংকগুলো মূলত চলে জনগণের জমানো আমানতের অর্থ দিয়ে। আমানতকে ব্যাংকের ‘ব্লাড’ বলা হয়। সংগৃহীত আমানত আবার উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে ঋণ হিসেবে বিতরণ করা হয়। ঋণের বিপরীতের আদায়কৃত সুদ এবং কমিশন ব্যাংকের মূল আয়ের উৎস আয়। এই আয় থেকে আমানতের বিপরীতে সুদ বা মুনাফা প্রদান, ব্যাংকের দৈনন্দিন খরচ মেটানো, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনভাতা প্রদান এবং মুনাফা করে থাকে। মুনাফার অর্থ শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে ডিভিডেন্ট হিসেবেি বণ্টন করা হয়। জনগণের আমানতকে সুরক্ষিত রাখার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে কিছু নিয়মনীতি আবশ্যকভাবে পরিপালন করতে হয়। ব্যাংক কোম্পানি আইন ও বাংলাদেশের জারিকৃত নীতিমালা অনুসারে, গ্রাহকদের জমা টাকার সুরক্ষার জন্য ব্যাংকগুলোকে আমানতের একটি অংশ অর্থ বিধিবদ্ধ জমা (এসএলআর) হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রাখতে হয়। আর তা সংরক্ষণ করতে হয় সরকারের ট্রেজারি বিল-বন্ড কেনার মাধ্যমে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোকে তাদের কাছে থাকা গ্রাহকের মোট আমানতের বিপরীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নগদ ৪ শতাংশ সিআরআর (ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও) হিসেবে রাখতে হয়। এছাড়া আমানতের সাড়ে ৫ শতাংশ রাখতে হয় বিধিবদ্ধ জমা (এসএলআর) হিসেবে। অন্যদিকে প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলোকে মোট আমানতের বিপরীতে নগদে ৪ শতাংশ টাকা ও আমানতের ১৩ শতাংশ পরিমাণ বিল ও বন্ড বিধিবদ্ধ জমা (এসএলআর) হিসেবে রাখতে হয়। এ দুটি ক্ষেত্রে ব্যর্থ হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জরিমানার মুখে পড়তে হয় ব্যাংকগুলোকে। বিধিবদ্ধ ন্যূনতম জমার বাইরে ব্যাংকগুলো শক্তিমত্তার প্রকাশ হিসেবে অতিরিক্ত অর্থ জমা রাখে। অতিরিক্ত জমার পরিমাণ উদ্বৃত্ত বা অতিরিক্ত তারল্য বলে। যে ব্যাংকের উদ্বৃত্ত তারল্য যত বেশি ওই ব্যাংকে জনগণের আমানত তত বেশি নিরাপদ। অর্থফেরত পাওয়ার সুযোগ বেশি থাকে। এছাড়া ব্যাংকগুলোর ঋণ নির্ধারিত সীমা রয়েছে, যাকে ঋণ আমানত অনুপাতসীমা (এডিআর) বলা হয়। এখন প্রচলিত ধারার একটি ব্যাংক ১০০ টাকা আমানতের বিপরীতে ৮৭ টাকা এবং ইসলামী ব্যাংকগুলো ৯২ টাকা পর্যন্ত ঋণ দিতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের আগস্ট শেষে দেশের সরকারি-বেসরকারি ৪৬ ব্যাংকে অতিরিক্ত তারল্য রয়েছে, যার পরিমাণ এক লাখ ৯০ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে চতুর্থ প্রজন্মের ৯ ব্যাংকের ছয়টিতে অতিরিক্ত তারল্য জমা রয়েছে। প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, চলতি বছরের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত চতুর্থ প্রজন্মের ৯ ব্যাংকের মধ্যে এনআরবিসি ব্যাংকের উদ্বৃত্ত তারল্য সবচেয়ে বেশি ২ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা। ব্যাংকটি ১৭ হাজার ১১৬টি কোটি টাকা আমানত সংগ্রহ করে ১৪ হাজার ১৬০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে। ব্যাংকটি ঋণ-আমানতের অনুপাত ৮২ দশমিক ৭৩ শতাংশ। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৯৫০ কোটি টাকা উদ্বৃত্ত তারল্য রয়েছে মিডল্যান্ড ব্যাংকের। ব্যাংকটির আমানতের পরিমাণ সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা। এরমধ্যে ঋণ বিতরণ করেছে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা। ঋণ-আমানত অনুপাতের প্রায় ৮৫ শতাংশ। এছাড়া ৮৫০ কোটি টাকা উদ্বৃত্ত তারল্য রয়েছে মেঘনা ব্যাংকের। ব্যাংকটি ৭ হাজার ৯০০ কোটি টাকা আমানত সংগ্রহ করে ৬ হাজার ৩০০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে। মেঘনা ব্যাংকের ঋণ-আমানত অনুপাত ৮০ শতাংশ। এনআরবি ব্যাংকের উদ্বৃত্ত তারল্য রয়েছে ২০০ কোটি টাকা। প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা আমানত সংগ্রহ করে ৫ হাজার ৯০০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করা এনআরবি ব্যাংকের এডিআর ৮৫ শতাংশ। প্রায় ৭ হাজার ৮০০ কোটি টাকা আমানত সংগ্রহ করে সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে মধুমতি ব্যাংক। মধুমতি ব্যাংকের ৮৩০ কোটি টাকা উদ্বৃত্ত তারল্য রয়েছে এবং এডিআর ৮৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ। সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক ১০ হাজার ২০০ কোটি টাকা আমানত সংগ্রহ করে ৮৪ শতাংশ ঋণ হিসেবে বিতরণ করেছে। ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা। সাউথ বাংলা ব্যাংকের উদ্বৃত্ত তারল্যের পরিমাণ ৫০০ কোটি টাকা। তবে নানা কারণে তারল্য সংকট চরম আকার ধারণ করেছে পদ্মা ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক এবং ইউনিয়ন ব্যাংকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, শরিয়াহভিত্তিক চারটি ব্যাংক ও প্রচলিত ধারার ৪২টি ব্যাংক তার সহজে বিনিময়যোগ্য সম্পদ বা এসএলআর হিসেবে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি অর্থ সংরক্ষণ করে রেখেছে। এর মধ্যে এসএলআর সংরক্ষণে শীর্ষে আছে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক। তাদের অতিরিক্ত জমা ৪৯ হাজার ৪৪ কোটি টাকা। এছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত আরও চারটি ব্যাংকে অতিরিক্ত এসএলআর জমা আছে। ব্যাংকগুলো হলো- অগ্রণী, রূপালী, জনতা ও বিডিবিএল। এসএলআর সংরক্ষণে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে বিদেশি মালিকানাধীন স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক। তাদের অতিরিক্ত জমা ১৬ হাজার ১৬৯ কোটি টাকা। ব্যাংক এশিয়ার অতিরিক্ত এসএলআর সংরক্ষণ আছে ৮ হাজার ৬১৯ কোটি, পূবালী ব্যাংকের ৮ হাজার ৫৩৪ কোটি ও ব্র্যাক ব্যাংকের ৮ হাজার ২৪৪ কোটি টাকা। এ ছাড়া ৫ হাজার থেকে ৭ হাজার কোটি টাকার অতিরিক্ত এসএলআর সংরক্ষণ আছে আরও ৭টি ব্যাংকের।
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য