-->

৫ আগস্টের পর ভারত থেকে পণ্য আমদানি কমেছে কতটা

বিবিসির প্রতিবেদন

ভোরের আকাশ ডেস্ক
৫ আগস্টের পর ভারত থেকে পণ্য আমদানি কমেছে কতটা

গত আগস্ট মাসে দেশে রাজনৈতিক পালাবদলের পর বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম যেভাবে আকাশ ছুঁয়েছে, তাতে অনেকেই ধারণা করছেন ভারত থেকে পণ্য রপ্তানির পরিমাণ আচমকা কমে যাওয়াটা এর পেছনে একটা বড় কারণ হতে পারে। কথাটা হয়তো আংশিকভাবে সত্যিও, কারণ আগস্ট মাসেই বাংলাদেশে ভারত থেকে রপ্তানি এক লাফে প্রায় ২৮ শতাংশ কমে গিয়েছিল- যদিও তা সেপ্টেম্বরে ধীরে ধীরে কিছুটা ‘স্বাভাবিক’ পর্যায়ে ফিরে এসেছে। তবে চলতি অক্টোবরেই যেভাবে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যেকার বেনাপোল-পেট্টাপোল স্থল বন্দর নানা কারণে দিনের পর দিন বন্ধ থেকেছে, তাতে এই মাসেই দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ আবারও কমে গেলে অবাক হওয়ার কিছু নেই বলেও বিশ্লেষকরা মনে করছেন। এরই মধ্যে গত মাসের মাঝা-মাঝি ভারত বাংলাদেশে পেঁয়াজ রপ্তানির ওপর বেশ কিছু বিধিনিষেধ তুলে নেয়- যদিও পর্যবেক্ষকদের ধারণা সেই সিদ্ধান্তের পেছনে আসল কারণ ছিল মহারাষ্ট্রের আসন্ন নির্বাচন। তাতে ক্রেতাদের সাময়িক স্বস্তি মিললেও বাংলাদেশের বাজারে পেঁয়াজের দাম আবারও ভীষণ বেড়ে গেছে। সঙ্গে চাল, ভোজ্য তেল ও চিনিরও। খবর বিবিসি।

এদিকে ভারতে একাধিক গবেষণা সংস্থা বা রেটিং এজেন্সি তাদের সাম্প্রতিক রিপোর্টে মন্তব্য করেছে, বাংলাদেশে অস্থিরতা যদি বেশি দিন চলে তাতে ভারতের রপ্তানিমুখী বিভিন্ন শিল্প মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এবং বাংলাদেশে রপ্তানির পরিমাণ হু হু করে কমতে পারে। ভারতের সবচেয়ে পুরনো রেটিং এজেন্সি ‘ক্রিসিল’ যেমন তাদের এক রিপোর্টে বলেছে, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ অবশ্যই আগামী দিনে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যে বড়-সড় প্রভাব ফেলবে- তবে তাতে সব খাতে বা সব শিল্পে সমান প্রভাব পড়বে না, কোনটায় বেশি বা কোনটায় কম হবে। ‘আইডিয়াজ ফর ইন্ডিয়া’ থিঙ্কট্যাঙ্কের তরফে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে আবার বলা হয়েছে, ভারত থেকে বাংলাদেশে বর্ষাকালীন বা খরিফ কৃষিপণ্যের রপ্তানি এবার ভীষণভাবে মার খেতে পারে। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে যে ‘অবাধ বাণিজ্য চুক্তি’ (ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট বা ‘সেপা’) নিয়ে বহু বছর ধরে আলোচনা চলছিল, এখন তার ভবিষ্যৎ নিয়েও আশঙ্কা প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞরা। চুক্তিটি অদূর ভবিষ্যতে সই করা যাবে, এমন সম্ভাবনা দেখছেন না কেউই। সব মিলিয়ে, ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য যে এই মুহূর্তে একটা প্রবল অনিশ্চয়তার মুখে দাঁড়িয়ে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

ভারতের বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয় প্রতি মাসে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের যে পরিসংখ্যান প্রকাশ করে, তা থেকেই স্পষ্ট যে গত আগস্টে বাংলাদেশে পণ্য রপ্তানি একটা বড়-সড় হোঁচট খেয়েছিল। ওই ডেটা বলছে, ২০২৩ সালের আগস্টে যেখানে ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রায় ৯৪৪ মিলিয়ন বা ৯৪ দশমিক চার কোটি ডলারের পণ্য (‘মার্চেন্ডাইজ’) রপ্তানি করা হয়েছিল, ২০২৪-এর আগস্টে সেটাই কমে দাঁড়ায় মাত্র ৬৮১ মিলিয়ন বা ৬৮ দশমিক এক কোটি ডলারে। ফলে গত বছরের আগস্টের তুলনায় চলতি বছরের আগস্টে ভারতের রপ্তানি কমেছিল ২৭.৮৫ শতাংশ। অথচ তার ঠিক আগের মাসেই (জুলাই ২০২৪) রপ্তানির পরিমাণ তার আগের বছরের জুলাইয়ের তুলনায় ১১ দশমিক ১৩ শতাংশ বেড়েছিল। ২০২৩ এর জুলাইতে ৭২৩ মিলিয়ন ডলারের জায়গায় ২০২৪ এর জুলাইতে রপ্তানি করা হয়েছিল ৮০৪ মিলিয়ন ডলারের পণ্য।

৫ আগস্ট বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নাটকীয় পরিস্থিতিতে দেশ ছাড়তে হয়- আর তার তিনদিন পর দায়িত্ব নেয় মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকার। সে সময় দিনের পর দিন রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সীমান্তের স্থল-বন্দরগুলোতে স্থবিরতার প্রভাব নিশ্চিতভাবেই দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের ওপর পড়েছে। তবে দিল্লির থিঙ্কট্যাঙ্ক আরআইএস-এর অর্থনীতিবিদ ড. প্রবীর দে মনে করছেন, আগস্টের অনিশ্চয়তা সেপ্টেম্বরে বেশ কিছুটা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছে। তিনি বলছিলেন, চলতি বছরের আগস্টে বাংলাদেশে ভারতের রপ্তানি ও সে দেশ থেকে আমদানি, দুটোই মারাত্মকভাবে কমেছিল। কিন্তু পরের মাসেই সেটা কিছুটা পুষিয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছে।

দিল্লিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডেটাও বলছে, ২০২৩-র সেপ্টেম্বরে যেখানে ভারত বাংলাদেশে প্রায় ৮৭০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছিল, ২০২৪-এর সেপ্টেম্বরে সেখানে প্রায় ৮৬১ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করা সম্ভব হয়েছে। তবে, এর একটা কারণ হতে পারে, পেট্রাপোল বা হিলি স্থলবন্দরে আগস্ট মাসে আটকে থাকা পণ্য অবশেষে সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশে ঢুকতে পেরেছে এবং সেই মাসের পরিসংখ্যানে যুক্ত হয়েছে।

ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান খুঁটিয়ে দেখলে অবশ্য দেখা যায়, বাংলাদেশে সব ধরনের পণ্যের রপ্তানিই যে কমেছে, তা কিন্তু নয়। বরং কোনও কোনও বিশেষ পণ্যর রপ্তানি আগস্ট মাসেও বেড়েছে। যেমন ফার্মাসিউটিক্যাল প্রোডাক্টস বা ওষুধের রপ্তানি (তার আগের বছরের আগস্ট মাসের তুলনায়) ৩২ শতাংশ বেড়েছিল। তৈরি পোশাক শিল্পের অপরিহার্য কাঁচামাল তুলার রপ্তানিও বেড়েছে ১৩ শতাংশ। একইভাবে আলুসহ বিভিন্ন শাকসব্জির রপ্তানি বেড়েছিল ১৮ শতাংশ। তামাক, তামাকের বিকল্প, তামাকজাত দ্রব্যর রপ্তানি বেড়েছিল রেকর্ড ৩৯২ শতাংশ! কিন্তু, এগুলো ব্যতিক্রম হিসেবেই ধরতে হবে, কারণ বেশির ভাগ পণ্যের ক্ষেত্রেই ভারত থেকে রপ্তানির পরিমাণ সাঙ্ঘাতিকভাবে কমেছে। যেমন- ফল, বাদাম, শুকনো ফল ইত্যাদির আমদানি কমেছিল প্রায় ৫৬ শতাংশ। আর বিভিন্ন সিরিয়াল বা শস্যদানার (যেমন ডাল ইত্যাদি) ক্ষেত্রে এই পরিমাণটা ছিল ৯৫ শতাংশ! চকোলেট তৈরির জন্য দরকারি কোকো বা কোকো প্রিপারেশনের আমদানি কমে যায় ৮৭ শতাংশ। সিল্ক বা রেশম আমদানি কমেছে ৯৪ শতাংশ, খেলনা ও ক্রীড়া সরঞ্জামের ক্ষেত্রে পরিমাণটা ছিল ৮৩ শতাংশ। কৃষিকাজের জন্য অপরিহার্য রাসায়নিক সারের আমদানিও ৯৪ শতাংশ কমে গিয়েছিল, মানে বলতে গেলে ভারত থেকে বাংলাদেশে সার আসা একরকম বন্ধই হয়ে গিয়েছিল। বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত ক্রেতারা গত কয়েক সপ্তাহে বাজারে কাশ্মীরি আপেল বা একটা সামান্য চকোলেট কিনতে গিয়েও যে দাম শুনে অবাক হয়েছেন- তার কারণটা বোঝা তাই খুব কঠিন নয়!

ভারতের পেট্রাপোল ও বাংলাদেশের বেনাপোলের মাঝে সীমান্তে যে স্থলবন্দর রয়েছে, দুদেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ পণ্যের আদানপ্রদান হয় সেই পথ দিয়েই। দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের ৩০ শতাংশেরও বেশি এই একটি বন্দরই সামলায়। পেট্রাপোল প্রান্তে অবস্থিত ইন্টিগ্রেটেড চেক পোস্ট বা আইসিপি-টি দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম স্থলবন্দরও বটে। কিন্তু কথায় কথায় যেভাবে এই বন্দরে কাজ থমকে যায় এবং পণ্যবোঝাই ট্রাকগুলোকে দিনের পর দিন সীমান্তে অপেক্ষা করতে হয়, তাতে দুই দেশের ব্যবসায়ীরাই একরকম তিতিবিরক্ত। যেমন- চলতি অক্টোবর মাসের গোড়াতেই যখন পশ্চিমবঙ্গে শারদীয় দুর্গোৎসব চলছিল, তখন পেট্রাপোল বন্দর টানা পাঁচদিন বন্ধ ছিল। সে সময় নয় থেকে ১৩ই অক্টোবর সেখানে কোনো মাল খালাস হয়নি বললেই চলে। সেই পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হতে না হতেই ভারত সরকার জানিয়ে দেয়, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ আগামী ২৪শে অক্টোবর পেট্রাপোলে একটি আধুনিক টার্মিনাল ভবন উদ্বোধন করতে আসবেন, তাই নিরাপত্তার কারণে বন্দরের কাজকর্ম আবারও চারদিন বন্ধ রাখা হবে। এই নির্দেশ অনুযায়ী সোমবার মানে থেকে স্থলবন্দরের কাজ বন্ধও হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অনুষ্ঠান বাতিল হওয়ায় গত মঙ্গলবার বিকেল থেকে পেট্রাপোল আবার চালু হয়েছে।

ভারতের প্রথম সারির অর্থনীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘আইডিয়াজ ফর ইন্ডিয়া’ বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পালাবদলের পর দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে কী প্রভাব পড়তে পারে, তা নিয়ে সেপ্টেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করে। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব পাবলিক ফিনান্স অ্যান্ড পলিসি-র দুজন গবেষক, রাধিকা পান্ডে ও রচনা শর্মা সেখানে দেখিয়েছেন, চড়া মূল্যস্ফীতি আর তরুণদের মধ্যে চরম বেকারত্বের কারণে বাংলাদেশে আমদানির চাহিদা বহু দিন ধরেই কমছিল। এটা বিশেষ করে প্রকট ছিল নন-টেক্সটাইল খাতে। তারা বলছেন, বাংলাদেশের ডলার সংকটের কারণে আমদানি পরিস্থিতি আরও ‘ভালনারেবল’ হয়ে ওঠে। আর জুলাই-পরবর্তী রাজনৈতিক অস্থিরতা ‘পরিস্থিতিকে এখন আরও অনেক জটিল করে তুলতে পারে’।

ওই গবেষণাপত্রে তারা দেখিয়েছেন, ২০১০-১১ সালেও যেখানে বাংলাদেশে ভারতের বার্ষিক রপ্তানি ছিল মাত্র তিন দশমিক দুই বিলিয়ন ডলারের, ২০২১-২২ অর্থ বছরেই সেটা বেড়ে দাঁড়ায় ১৬ দশমিক দুই বিলিয়ন ডলারে। কিন্তু তার পরের দুবছরেই সেই অঙ্কটা আবার কমতে থাকে। এর পেছনে যেমন বাংলাদেশের ডলার সংকট ও চড়া মূল্যস্ফীতির একটা বড় ভূমিকা ছিল, তেমনই দায়ী ছিল ভারতের নেওয়া বেশ কিছু পদক্ষেপও। দেশের বাজারে দাম নাগালে রাখার চেষ্টায় ভারত যেভাবে চাল, গম বা চিনির মতো কৃষিপণ্যর রপ্তানিতে দফায় দফায় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, রপ্তানির অঙ্কটা কমার সেটাও একটা বড় কারণ। রাধিকা পান্ডে ও রচনা শর্মা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ২০২১-২২ অর্থ বছরেও যেখানে বাংলাদেশ ছিল সারা বিশ্বে ভারতের চতুর্থ বৃহত্তম রপ্তানি বাজার; ২০২৩-২৪ অর্থ বছরেই তারা কিন্তু নেমে গিয়েছিল আট নম্বর স্থানে। ফলে ভারত থেকে রপ্তানির এই নিম্নমুখী প্রবণতাটা চলতি বছরের পাঁচই আগস্ট থেকে নয়, তারও অনেক আগে থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। তবে ‘অয়েল মিল’ (পশু আহার, কিংবা যা থেকে ভোজ্য তেল তৈরি হয়) বা মশলাপাতির রপ্তানি যে সাম্প্রতিক অস্থিরতার পর ‘পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে’- গবেষণাপত্রে সে কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। গুজরাটের সুরাটে যে শাড়ি ও ফেব্রিকের কারখানাগুলো বাংলাদেশে বিপুল রপ্তানি করে থাকে, তারাও এই মুহুর্তে ‘নতুন অর্ডারের অভাবে এবং পুরনো পেমেন্ট না-পেয়ে’ ধুঁকছে। বাংলাদেশে ভারতের রপ্তানির এক-পঞ্চমাংশই ইঞ্জিনিয়ারিংসামগ্রী, সেগুলোর চাহিদাও হু হু করে কমছে বলে ওই রিপোর্ট সতর্ক করে দিয়েছে।

 

ভোরের আকাশ/রন

মন্তব্য

Beta version