অর্থনীতির জন্য বিষফোড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে দুর্বল ব্যাংকগুলো। তবে সেগুলো ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। তারা খেলাপি ঋণ আদায়ের সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও তাদের সহায়তা করছে। এরই মধ্যে কম সুদে ঋণ দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ঋণ আদায়ে ব্যাংকগুলোকে কঠোর হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।
শ্রেণিকৃত ঋণের মাত্রা, মূলধনের পর্যাপ্ততা, ঋণ-আমানত অনুপাত ও প্রভিশনিং বা নিরাপত্তা সঞ্চিতির পরিমাণ—এই চারটি দিক বিবেচনায় নিয়ে ১০টি দুর্বল ব্যাংক চিহ্নিত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এগুলো হলো—বাংলাদেশ ন্যাশনাল ব্যাংক, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান ও এবি ব্যাংক। তালিকায় জনতা ব্যাংকের নামও রয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, ঋণ ব্যবস্থাপনায় ব্যাংকগুলোর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নসংক্রান্ত বিষয়ে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিতে ঋণ পুনঃতফসিলীকরণ ও পুনর্গঠন সংক্রান্ত মাস্টার সার্কুলার জারি করা হয়েছে। এ সার্কুলারে বর্ণিত শর্ত মোতাবেক ব্যাংকগুলো উপরোক্ত বিষয়ে নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিতে পারবে, যা আগে অনেকটা অস্বচ্ছ এবং অসমভাবে করা হতো। এদিকে, আর্থিক অনিয়মে দুর্বল হয়ে পড়া ব্যাংকগুলোকে ধার দিতে উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সাতটি ব্যাংক ঘুরে দাঁড়াতে প্রায় ২৯ হাজার কোটি টাকা চেয়েছে। এর মধ্যে ৫টি ব্যাংককে ১৯ হাজার কোটি টাকা সহায়তা করতে রাজি হয়েছে অতিরিক্ত তারল্য থাকা সবল ১০ ব্যাংক। এসব ব্যাংকের ঋণে গ্যারান্টি বা নিশ্চয়তা দিতে রাজি হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যে ১০ ব্যাংক ঋণ দিতে সম্মত হয়েছে, সেগুলো হলো—রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক, বেসরকারি খাতের ব্র্যাক, ইস্টার্ন, দ্য সিটি, শাহজালাল ইসলামী, মিউচুয়াল ট্রাস্ট, পূবালী, ঢাকা, ডাচ-বাংলা ও ব্যাংক এশিয়া।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক হুসনে আরা শিখা সাংবাদিকদের জানান, বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্যারান্টির মানে হলো—কোনো কারণে কোনো ব্যাংক ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ওই টাকা দেবে। আপাতত কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরাসরি টাকা না দিয়ে অন্য ব্যাংক থেকে ধারের ব্যবস্থা করছে। অর্থাৎ বাজারের টাকা এক ব্যাংক থেকে আরেক ব্যাংকে যাবে। দুর্বল ব্যাংকগুলোকে দেওয়া ঋণের টাকা ফেরত চাইলে সবল ব্যাংকগুলোকে তিন দিনের মধ্যেই তা ফেরত দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। কোনো ব্যাংক ঋণ দেওয়ার জন্য কোনো টাকা নিতে পারবে না। কোনো ব্যাংককে কত টাকার তারল্য সহায়তা দেওয়া হবে, সেটি নির্ধারণ করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ছাড়া দুই ব্যাংকের সমঝোতার ভিত্তিতে ঋণের সুদহার নির্ধারিত হবে।
এ খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একদিকে ব্যাংকগুলোতে দুর্নীতির ফলে তারল্য সংকট তৈরি হয়েছে, অন্যদিকে দুর্নীতির খবর প্রকাশ হবার পর আস্থা হারিয়ে এসব ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিতে শুরু করেছে গ্রাহকরা। ফলে তারল্য সংকটের মুখোমুখি হয় এসব ব্যাংক। দুই কারণে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বলে উল্লেখ করছেন ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের নতুন বোর্ডের চেয়ারম্যান আবদুল মান্নান।
তিনি বলেন, কিছু সংখ্যক গ্রাহকের হাতে দেশের সম্পদের বড় অংশ পুঞ্জীভূত হয়েছে। সারাদেশে কেবল ডিপোজিটরের সংকট তৈরি হয়নি; বিনিয়োগেরও সংকট তৈরি হয়েছে। ডিপোজিটররা ব্যাংকের প্রকৃত মালিক। ৯০% টাকা তাদের। সেই মালিকদের অবজ্ঞা করা হয়েছে। ১০% শেয়ার হোল্ডিং যাদের, তারা নিজেদের মালিক হিসেবে দাবি করেছেন বা মালিক হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। পরিচয় দিয়ে এই ব্যাংকগুলো কুক্ষিগত করে এক ধরনের দুর্বৃত্তায়ন ঘটিয়েছেন ব্যাংকিং সেক্টরে। ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালক আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, গত ১০ বছরে বাংলাদেশের অনেকগুলো ব্যাংক থেকে অনিয়ম করে লোন দেওয়া হয়েছে; যেগুলো ফেরত আসছে না। অনেকে টাকা পাচার করে ফেলেছে। তারা দেশেও নাই। এছাড়াও পত্র-পত্রিকায় সবল-দুর্বল ব্যাংক নিয়ে নানা খবর প্রকাশিত হওয়ার প্রভাবও পড়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। তিনি বলেন, এসব খবরের কারণে যারা টাকা রাখে, তাদের আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। এই আস্থার সংকট যতদিন থাকবে, ততদিনই এই সংকট থাকবে। তবে ‘ব্যাংক টাকা দিতে পারবে না কিংবা বন্ধ হয়ে যাবে—কোনো ব্যাংকই এখনও এমন অবস্থায় পৌঁছায়নি’ বলে মনে করেন তিনি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকই এই সমস্যার সমাধান করতে পারবে বলে মনে করেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ব্যাংকিং ইন্টারপ্রেনারশিপ ডেভলপমেন্ট অ্যান্ড এসএমই ম্যানেজমেন্টের পরিচালক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মহিউদদীন প্রতিবেদককে বলেন, দুর্বল ব্যাংক, সবল ব্যাংক নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করাটাই পুরো সেক্টরটাকে ধ্বংস করার জন্য যথেষ্ট। ব্যাংক চলেই বিশ্বাসের ওপর। পাবলিক যখন জেনে গেল যেকোনো ব্যাংকে পর্যাপ্ত মূলধন নেই, তখন তারা দ্রুততম সময়ের মধ্যে সেসব ব্যাংক থেকে তাদের সঞ্চয় তুলে নিল। আর নতুন করে কোনো ডিপোজিট রাখলো না। এতে কি হলো—ব্যাংকগুলো আরও দুর্বল হয়ে পড়লো; গ্রাহকের আস্থাহীনতার কারণে ব্যাংকিং সেক্টরেই একটা হচপচ লেগে গেল। কিছুদিন পরই আবার সরকার ঘোষণা করল যে, যেসব ব্যাংকে মূলধন পর্যাপ্ত আছে, সেখান থেকে ৪% সুদে দুর্বল ব্যাংকগুলো ঋণ নিতে পারবে। ফলে গ্রাহকদের মধ্যে বিশ্বাসের ঘাটতি আরও বেড়ে গেল। আর এ সবই হলো অনভিজ্ঞতার কারণে। আমি মনে করি সরকারের উচিত দুর্বল ব্যাংকগুলোতে কঠোর নজরদারিতে রেখে বহুল প্রচারণায় যাওয়া যে, ব্যাংকিং সেক্টর খুব ভালো অবস্থানে আছে। এটা করলে গ্রাহকের আস্থা বাড়বে। ফলে ব্যাংকিং সেক্টর নিয়ে তৈরি যে অস্থিরতা তা অনেকাংশে কমে যাবে বলে আমি মনে করি।
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য