আর্থিক খাতে চরম অস্থিরতা চলছে। পুঁজিবাজারে দরপতন অব্যাহত রয়েছে। বিমা খাতে দেখা দিয়েছে আস্থাহীনতা। বেসরকারি কয়েকটি ব্যাংকের মালিকানা পরিবর্তন এবং কর্মীদের চাকরিচ্যুতির ঘটনায় আতঙ্ক বিরাজ করছে। কয়েকটি ব্যাংক তারল্য সংকটে ভুগছে। অন্তত ১০ বছর ধরে শেখ হাসিনা সরকারের সময় ব্যাংক খাতে চরম লুটপাট চলেছে। বিভিন্ন শিল্পগোষ্ঠী নামে-বেনামে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়েছে। তবে তাদের বিরুদ্ধে কার্যত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফলে এ খাতের সংকট দিনদিন ঘনীভূত হয়েছে। তবে অন্তর্বর্তী সরকার আর্থিক খাত স্বাভাবিক করতে নানা উদ্যোগ নিচ্ছে।
সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার মুনাফা তোলার চাপে ডিএসইর সূচকের পতন হয়েছে ৩০ দশমিক ৭৪ পয়েন্ট। লেনদেনও কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে। গত মঙ্গলবার ডিএসইতে লেনদেন হয়েছিল ৮৩৯ কোটি ৭০ লাখ টাকা। বুধবার লেনদেন হয়েছে ৬৫১ কোটি ২০ লাখ টাকা। বৃহস্পতিবার লেনদেন আরও কমে দাঁড়িয়েছে ৫৪১ কোটি ৫৫ লাখ টাকায়। তবে বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, সূচক-লেনদেন কমলেও বাজার এখন ধীরগতিতে স্বাভাবিক হচ্ছে। এ ছাড়া, বাজারে নতুন বিনিয়োগকারীও আসছেন। এদিকে আইসিবিও সরকারের কাছ থেকে ৩ হাজার কোটি টাকার ফান্ড পেয়েছে। ফলে পুঁজিবাজারে সুদিন ফিরবে বলে মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা। বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত মাসে ডিএসইতে লেনদেন কেবল ৩১ তারিখে ৫০০ কোটি ছাড়িয়েছিল। বাকি দিনগুলোতে লেনদেন ছিল ৫০০ কোটির নীচে। ওই মাসে লেনদেন নামে ৩০০ কোটি টাকার নীচেও। তবে চলতি মাসে এখন পর্যন্ত সূচক ও লেনদেনে ইতিবাচক ধারা অব্যাহত রয়েছে। বেশিরভাগ কর্মদিবসে লেনদেন ছাড়িয়েছে ৫০০ কোটি টাকা। শুধু এক দিন লেনদেন হয়েছে ৫০০ কোটি টাকার নীচে। গত বুধবার লেনদেন হয়েছে প্রায় ৮৪০ কোটি টাকা। অন্যদিকে, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) গেল সপ্তাহে ৫ কোটি ৪ লাখ টাকার শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে। সিএসইতে লেনদেন হওয়া ২১৫টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দর বেড়েছে ৭৭ কমেছে ১১৭ এবং পরিবর্তন হয়নি ২১টির। এদিন সিএসইর সার্বিক সূচক সিএএসপিআই ২৮ পয়েন্ট কমে দাঁডিয়েছে ১৪ হাজার ৮৫২ পয়েন্টে। ডিএসইএক্স সূচক কমে ১৩২ পয়েন্টে দাঁড়ালে গত ২ অক্টোবর মতিঝিলে ডিএসই ভবনের সামনে বিক্ষোভ করেছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।
এদিকে, অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়েছে দেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলোতেও। বিশেষ করে জোর করে মালিকানা পরিবর্তন করা ব্যাংকগুলোতে শুরু হয়েছে মালিকানা ফিরে পাওয়ার আন্দোলন। ব্যাংক খাতে তীব্র তারল্যসংকট বিরাজ করছে। ফলে চাহিদা অনুযায়ী সরকারি ও বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের ঋণের জোগান দিতে পারছে না ব্যাংকগুলো। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ১৫ বছর আগে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের সময় দেশে খেলাপি ঋণ ছিল প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা; যা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা। তবে পুনঃতফসিল করা ঋণ, আদালতের আদেশে স্থগিত করা ঋণ মিলিয়ে প্রকৃত খেলাপি ঋণ প্রায় ৪ লাখ কোটি টাকা হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
বিমা খাত: স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সাল থেকে বাংলাদেশে শুরু হয় ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিগুলোর পথচলা। সময়ের পরিক্রমায় এখন দেশের বিমা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৮৩টি। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের যে বাজারের আকার তাতে দশটি লাইফ ও দশটি নন লাইফ এই বিশটির বেশি কোম্পানি থাকা উচিত নয়। বাংলাদেশে বিমা খাতে ব্যাপক সম্ভাবনা থাকলেও এই খাতে আস্থার সংকট যেন কাটছেই না। প্রায় ১৭ কোটি মানুষের বাজার, উদীয়মান অর্থনীতির দেশ হওয়া সত্ত্বেও ইন্স্যুরেন্স পেনিট্রেশন কিংবা বিমা নিষ্পত্তির হার সব কটি সূচকেই পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশের বিমা খাত। পাশাপাশি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রচুর সংখ্যক বিমা কোম্পানিকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে বর্তমানে তীব্র আস্থা সংকটে পড়েছে খাতটি। এ খাতের প্রতি আস্থা বাড়াতে স্বচ্ছতা ও সুশাসন জরুরি বলে মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
অন্যান্য খাত: টানা তিন মাস সংকোচনের পর গত অক্টোবরে দেশের অর্থনীতি সম্প্রসারণের ধারায় ফিরেছে। অক্টোবর মাসে অর্থনীতির মূল চারটি কৃষি, নির্মাণ, সেবা ও উৎপাদন খাতের সম্প্রসারণ হয়েছে। ফলে পারচেজিং ম্যানেজার্স ইনডেক্স বা পিএমআই সূচক ৬ পয়েন্ট বেড়ে ৫৫ দশমিক ৭ পয়েন্টে পৌঁছেছে। যা সেপ্টেম্বরে ছিল ৪৯ দশমিক ৭ পয়েন্ট। অর্থনীতির মূল চারটি খাতের মধ্যে অক্টোবরে কৃষির পিএমআই সূচক দাঁড়িয়েছে ৫৩ পয়েন্ট, যা আগের মাসে ছিল ৪৭ পয়েন্ট। উৎপাদন খাতের সূচকের মান ছিল ৫৬ দশমিক ৬ পয়েন্ট। এ খাত অবশ্য অক্টোবরেও সম্প্রসারণের ধারায় ছিল। সেই মাসে এই সূচকের মান ছিল ৫২ দশমিক ৬ পয়েন্ট। নির্মাণ খাতের পিএমআই সূচকের মান ছিল ৫০ দশমিক ১ পয়েন্ট, যা আগের মাসে ছিল ৪৬ পয়েন্ট। সেবা খাতের পিএমআই সূচকের মান ছিল ৫৬ দশমিক ৯, যা আগের মাসে ছিল ৪৯ দশমিক ৪ পয়েন্ট।
প্রতি মাসে যৌথভাবে এ সূচক প্রণয়ন করে মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স (এমসিসিআই) ও পলিসি এক্সচেঞ্জ। ভবিষ্যৎ ব্যবসা সূচকের ক্ষেত্রে কৃষি, উৎপাদন, নির্মাণ এবং সেবার সব মূল খাতেই ধীরতর প্রসারণ হার রেকর্ড করা হয়েছে। যদিও অর্থনীতির সব গুরুত্বপূর্ণ খাত সম্প্রসারণের লক্ষণ দেখাচ্ছে, তবুও দেশ এখনো অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ যেমন ঘনঘন প্রতিবাদ, আইনশৃঙ্খলার মন্থর উন্নতি এবং জনপ্রশাসনের ধীরগতি ইত্যাদিতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মুনসুর জানিয়েছেন, মূল্যস্ফীতি কমিয়ে প্রাইস লেভেল সহনশীল করতে ২-৩ বছর লাগবে। একই সঙ্গে বর্তমানে ফরেন এক্সচেঞ্জের কোনো সংকট নেই। যে কেউ এলসি খুলতে পারবে। বাজারে টাকা পাবেন না কিন্তু ডলার পাবেন। এখানে একটা বড় পরিবর্তন হয়েছে বলেও জানান তিনি। তিনি বলেন, গত মাসে দেশে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। প্রায় ১০.৮৭ শতাংশ হয়েছে। এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। পৃথিবীর সব দেশেই মুদ্রানীতি ঘোষণা করার পর ২ শতাংশ নেমে আসছে। কিন্তু সেটা ডাবল ডিজিট। শুধু যে কমেছে সেটা নয় কোনো কোনো মাসে বেড়েছেও। আমাদের যেটা হয়েছে সেটা দুইটা জিনিসের প্রতিফলন দেখা যায়। গত মাসে দেশে যে বন্যা হয়েছে সে কারণে সব কিছুর দাম বেড়েছে। আর দ্বিতীয় হয়েছে দেশে যে আন্দোলন হলো তার একটা প্রভাব পড়েছে। আমাদের যে লাভ হতো সেটা কমিয়ে দিয়েছি। এরমধ্যে ব্যাংকের লিকুইটি টাইট করে ফেলছি। এর একটা প্রভাব আগামীতে বাজারে পড়বে। আমাদের দিক থেকে যেটুকু করার আমরা সেটুকু করবো। কিন্তু সময় লাগবে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে। যেটা গত ৫ থেকে ৭ বছর ধরে আস্তে আস্তে বাড়িয়েছে সেটা ওভার নাইট ঠিক করা কঠিন। সময়তো একটু লাগবেই।
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য